দোঁহা

চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি


সাগরিকা শূর


পঁচিশে বৈশাখ। সকাল ১০টা। অন্যদিনের মতোই ছুটছি ট্রেন ধরার তাড়ায়। সাড়ে ছাব্বিশ খানা সিঁড়ি পেরিয়ে হাপাতে হাপাতে প্ল্যাটফর্মে উঠেছি, ট্রেনও ঢুকে গেছে প্রায়, হঠাৎই থমকে যেতে হল৷ চেনা সুর ভেসে আসছে কাছেই কোথাও। এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরাতেই চোখে পড়ল শেডের নীচে বসে বাঁশি বাজাচ্ছেন মাঝবয়সী এক লোক - পরনে আধময়লা লুঙ্গি আর ফতুয়া, পাকা দাড়ি, কাঁচা-পাকা চুল, পুরো চেহারায় দারিদ্র‍্যের ছাপ স্পষ্ট। সামনে একটা টিনের কৌটো, তাতে কিছু খুচরো টাকা, পথচলতি লোকেরা ফেলে যাচ্ছে, লোকটা কিন্তু একমনে বাঁশিই বাজাচ্ছেন, কোনো দিকে নজর নেই। ভদ্রলোককে এর আগেও দেখেছি বেশ কয়েকবার, একইভাবে শেডের নীচে বা প্ল্যাটফর্মের ধারে বসে বাঁশি বাজাতে, একইভাবে তন্ময় হয়ে বাজান। আজ বাজাচ্ছিলেন -

"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে"

প্রথম দু'কলি শুনতে না শুনতেই ট্রেন হুইসেল দিয়ে দিয়েছে...দাঁড়াবার উপায় নেই...শুধু ট্রেনে উঠতে উঠতে মনে হল উনি কি জানেন আজ পঁচিশে বৈশাখ? অবশ্য না জানলেই বা কী? এই যে অনাড়ম্বর সুর, যে কোনো লোকদেখানো, আচারসর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতার থেকে এর দাম অনেক বেশী...আজন্ম নিভৃতিপ্রিয়, ব্রহ্মবাদী এক মানুষকে পৌত্তলিকতার মালা পড়িয়ে নিজেদের পিঠ চাপড়ানোর শহুরে আত্মশ্লাঘা নয়...

হঠাৎ সুমনের সেই লাইনগুলো মনে পড়ে গেল...

"এ শহরে এসছো তুমি কবে কোন রাজ্য থেকে
তোমাদের দেশে বুঝি সব মানুষই বাঁশি শেখে
আমাদের স্কুল কলেজে শেখে লোকে লেখা পড়া
প্রাণে গান নাই মিছে তাই রবি ঠাকুর মূর্তি গড়া..."


সমস্ত পুজো-পার্বণ পেরিয়ে, আনুষ্ঠানিকতার বাগাড়ম্বর পেরিয়ে, অনৃত স্তবগান পেরিয়ে এই দেহাতী বাঁশিবাদকের পাশে বসে যিনি নিঃশব্দে সুরসিঞ্জন করেন, তিনি আর কেউ নন - কবি...

"আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে"

এ গানের পিছনের গল্প আমার আজানা...অনেকে শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ছোট ছেলে শমীর কথা ভেবে এ গান লেখা বলে থাকলেও তা নিয়ে মতভেদের অবকাশ আছে, কারণ সময়কালে একটা তফাৎ ঘটে...তবে যে কারণেই লেখা হয়ে থাক, এ গান যে এক আকুল, অনন্ত প্রতীক্ষার কথাই বলে তা বলবার অপেক্ষা রাখে না...কিন্তু এ প্রতীক্ষা কীসের? শুধুই কি প্রেমাস্পদের প্রতীক্ষা? আমার সত্তায় কখন, কীভাবে এ গান জড়িয়ে গেছে আজ আর মনে নেই...তবে কথাকে ভেঙে ভেঙে দেখতে শেখার বয়সে পা দেবার আগে অব্দি কিন্তু মনে হয়েছে এ গানে কোনো বিষাদ নেই...কোনো খেদ নেই কোথাও...বেশ তো সুন্দর সুরের চলন...আর যাঁরা গান তাঁদেরও তো গলা ভারি হয় না কোথাও...আর্দ্র লাগে না তো কোনো স্বর...একটা বয়সের পর আবার মনে হয়েছে এ গান কি তবে অভিমানের?

"যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে -
         এই নিরালায় রব আপন কোণে।"

এ তো অভিমানের কথা! দুরন্ত অভিমানে যখন আমি সবার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিই, যখন অভিমান করে বলি, "চলে যাও", কিংবা জানিয়ে দিই আর কথা বলব না, এ তো তেমনই! এই নিরালায় থেকে, বাইরের মাতাল সমীরণের বসন্তযাপন থেকে, জ্যোৎস্নায়-গা-মুছিয়ে-দেওয়া-উৎসব থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার অর্থই তো এক নিদারুণ অভিমান! কিন্তু অভিমান বুঝলেও তার কারণ বুঝিনি সেদিন...তারপর একটু একটু করে কথার মোড়ক খুলতে খুলতে মনে হয়েছে এ এক অনবদ্য প্রতীক্ষা, যে প্রতীক্ষা মানুষকে অন্তর্লীন করে...স্থিত হতে শেখায়...কিন্তু কোনো ব্যক্তি মানুষের জন্যই বুঝি এই প্রতীক্ষা...

সাহানা বাজপেয়ীর গলায় এস্রাজের সুরে এ গান শুনতে শুনতে বারবার মনে হয়েছে কোথাও এক অদ্ভুত মৃত্যু সংলগ্ন হয়ে আছে গানে...যেন কেউ মারা যাবার পর কোথাও গানটা বাজছে...যে খুব বাঁচতে চেয়েছিল...যার বড় প্রাণ ছিল...
শুধু এই মুহূর্তে এ গান শুনে মনে হচ্ছে এ প্রতীক্ষা আর কারো নয়, এ প্রতীক্ষা নিজের...নিজেকে দেখার প্রতীক্ষা...চারপাশের সবকটা আলো যখন একটু একটু করে ম্লান হয়ে আসে, অন্ধকার গাঢ়তর হয়, শ্লথ হয় বিশ্বাসের সবটুকু, তখনই এ গান এসে পাশে বসে...

       "আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে
                 ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।
আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে,
                 যদি আমায় পড়ে তাহার মনে"


সমস্ত ভাঙন থেকে নিজেকে অল্পে অল্পে আবার জাগিয়ে তোলার জন্য এ প্রতীক্ষা...আবার একটু একটু করে অন্তরের ঘরটুকুকে সাজিয়ে তুলতে হবে...পরম যত্নে, নিরবচ্ছিন্ন মমতায়...
অপেক্ষা করতে হবে সেই মুহূর্ত পর্যন্ত যতক্ষণ আবার আলো না জ্বলে...

"আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে"...

জানিনা কেন ছোটবেলা থেকেই এ গান শুনলে চোখে জল এসে যায়, অজান্তেই। অত ছোটবেলায় তো বিচ্ছেদ কী বুঝিনি, বুঝিনি বিরহ কাকে বলে, বুঝিনি কী অসীম যন্ত্রণায় কেউ বলে,

 "সে চলে গেল, বলে গেল না - সে কোথায় গেল ফিরে এল না।"
 

কী করুণ, গভীর এ হাহাকার! তখন একটা ক্যাসেট ছিল বাড়িতে, তাতে ইন্দ্রাণী সেনের গলায় সম্ভবত শুনতাম এ গান, তারপর আরও অনেকের কণ্ঠে শুনেছি। ঠিক ওই "ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে", যতবারই শুনি, যতবার, যার কণ্ঠেই শুনি, ওই জায়গাটায় এসে বারবার মনে হয় সত্যিই ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল যেন। আর বারবার নতুন করে ভাবি কীভাবে এমন সুর দেওয়া সম্ভব, যাতে শুনলেই এই ছোঁয়াটুকু ধরা যাবে। আজ সকালে এক বন্ধু গানটার কথা মনে করাল, সদ্য সে এক অতি প্রিয় মানুষকে হারিয়েছে। সেই বেদনা কোথাও যেন পরতে পরতে ছড়িয়ে গেল আমার ভেতরেও। এই প্রায়-সাতাশে হারিয়েছি বহুকিছুই, মানুষ, সম্পর্ক সবই। প্রত্যেকবারই ভেতরে ভেতরে অনুভব করেছি এই হাহাকার, সব হারিয়ে ফেলবার এক অমোঘ বেদনা। আর প্রত্যেকবারই অবাক হয়ে দেখেছি উল্টোদিকে সেই অনুভব নেই। কী অবলীলায় তারা অতিক্রম করে গেছে আমার অনুপস্থিতি! মৃত মানুষের অনুভব থাকে না, তাই সে কী ভাবে তা জানা যায় না, বরং সে-ই রেখে যায় এক পৃথিবী নিস্তব্ধতা; কিন্তু জীবিত মানুষের তো সে অনুভব থাকে, উপলব্ধি থাকে। আর সেখানেই মনে হয় সব গুলিয়ে যাচ্ছে। চিরকাল এমন মানুষ হতে চেয়েছিলাম যাকে হারিয়ে ফেলতে অন্যের কষ্ট হবে, যেমন কষ্ট হয় ছেলেবেলার ছবি হারিয়ে গেলে। 'মূল্যবান' নয়, 'প্রিয়'। আজ বহুদিন পর এ গান শুনতে শুনতে মনে হল এ বেদনা শুধুই প্রিয় কাউকে হারাবার বেদনা নয়, হাহাকার নয়, নিজেকে হারাবার বেদনাও বটে। যে সহজ আমি কী অবলীলায় মানুষকে বিশ্বাস করতাম, ভালোবাসতাম, সেই সহজতাকে হারিয়ে ফেলবার বেদনা।
 
"সে ঢেউয়ের মতো ভেসে গেছে, চাঁদের আলোর দেশে গেছে"

যবে থেকে জানা হয়ে গেছে, বিশ্বাস করা হয়ে গেছে রূপকথা বলে কিছু হয় না, যবে থেকে শেখা হয়ে গেছে, "ছাড়া তো খুব সহজ এবং/ছাড়া তো খুব সহজ" তবে থেকেই নিজেকে হারানোর পাঠ শুরু। এখন নিজের দিকে তাকালে সেই বিচ্ছেদের স্বর জেগে ওঠে, আঘাতে, অপমানে ফেলে আসা একটা মানুষের, মননের বিচ্ছেদ -
 
           "মনে হল আঁখির কোণে আমায় যেন ডেকে গেছে সে।
আমি কোথায় যাব, কোথায় যাব, ভাবতেছি তাই একলা বসে।"


"অন্ধকারে রইনু পড়ে স্বপন মানি।
ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা তাই কি জানি!"

গানটি বহুশ্রুত। সেই ফ্রক পড়া বয়স থেকেই কতবার কতভাবে শুনেছি মনে নেই। প্রথম বোধহয় দেবব্রত বিশ্বাসের গমগমে গলাতেই শুনি, এবং অদ্ভুতভাবে ওই কণ্ঠস্বর শোনার পর আর কারোর গলায় গানটি শুনতে ইচ্ছে হয়নি, ওই গায়কীটিই মনে গেঁথে যায় বরাবরের মতো। যদিও পরে সুচিত্রা মিত্র, নীলিমা সেন, হেমন্ত মুখার্জী বা পরবর্তীকালের ইন্দ্রাণী সেন, শ্রাবণী সেন, হৈমন্তী শুক্লা কিংবা রূপা গাঙ্গুলীর গলাতেও শুনেছি। এঁদের মধ্যে রূপা গাঙ্গুলীর গাওয়া কিছুটা ভালো লাগলেও বারবারই ফিরতে হয়েছে দেবব্রত'য়। ঠিক যেমন বারবার ফিরতে হয়েছে এই গানের কাছে, ঠিক এই কথাগুলোতেই..
          
"ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা তাই কি জানি"..
          
আসলে কিছু কিছু গান বোধহয় এমনই হয়..যারা সুর, কথা, লয়, রাগ মিলিয়ে-মিশিয়ে কখন যেন জীবন হয়ে যায়..তবু প্রত্যেকবার কী আশ্চর্য নতুনভাবে ধরা দেয় প্রতিটা শব্দ, বাঙ্ময় হয়ে ওঠে সুর আর কথার গভীরে প্রথিত সমস্ত নীরবতা...আর এই শব্দ আর নৈঃশব্দ্যের মধ্যিখানে ভেসে ওঠে আরও গভীর কোনো বীক্ষণ...গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয় অনুভূতির পারদ...

প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গানটা সেদিন ঠিক কী মনে হয়েছিল মনে নেই...হয়তো কিছুই মনে হয়নি, শুধু এক অদ্ভুত ভালোলাগার গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেছিল চিরকালের জন্য...বোঝা-না বোঝার এক আলো-আঁধারী, নিবিড় কোনো আকর্ষণ ফ্রেমবন্দী হয়ে গেছিল বরাবরের মতো...ভাষা সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান হওয়ার পর যতবার ভাবতে বসেছি উপহারের মোড়ক খোলার মতো প্রত্যেকবার দু' হাত ভরে নতুন কিছু পেয়েছি...ঠিক যেখানে বলছেন,

"জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে"

কে এই 'তুমি'? 'গীতবিতান' অনুযায়ী তিনি ঈশ্বর, কারণ গানটা পূজা পর্যায়ের...ক্লাস নাইন-টেনে পড়তে বরাবর মনে হয়েছে কবি প্রেমের কথা বলছেন...সেই প্রেম যা সব ভেঙে আবার নতুন করে জুড়তে পারে...

"সকালবেলায় চেয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে আছ তুমি এ কি"

এ যেন একাকী বিরহী রাতের পর, 'ঘরভরা' 'শূন্যতার' পর, সমস্ত স্তব্ধ অশ্রুবিন্দুর পর মিলনের সাক্ষী-থাকা কোনো ভোর...তারপর যত বড় হয়েছি প্রেম আর ঈশ্বর একাকার হয়ে গেছেন কোথাও...যিনি প্রিয়তম, তিনিই সেই 'অপাপ-পুরুষ'...তিনিই আবার 'জীবন মরণের সীমানা' ছাড়িয়ে অপেক্ষমান পরম বন্ধু...তিনি ভালোবাসেন, তাই তিনি নিষ্ঠুর...

"আঘাত সে যে পরশ তব
                   সেই তো পুরস্কার।"


আর আজ, এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই 'তুমি' হয়তো যন্ত্রনা, কিংবা মৃত্যু...সেই রাজকীয় মৃত্যু, সেই ঐশ্বরিক মৃত্যু...সেই মৃত্যু, যে কাঙালের মতো প্রাণভিক্ষা করতে আসে না, সে অভ্রভেদী রথে চারদিক অন্ধকার করে রাজার মতো আসে...হয়তো এরকম কোনো মৃত্যুর আস্বাদ পেতেই কবি John Keats লিখেছিলেন,

"Now more than ever seems it rich to die"

আর তারপর...আর একবার প্রেম, ঈশ্বর, যন্ত্রণা, মৃত্যু একাত্ম হয়ে যায়...আরও একবার নির্ভেজাল যন্ত্রণার গভীরে ডুব দিই আমি...তলিয়ে যাই যন্ত্রণার অতলান্তে...ঠিক যেখান থেকে স্বপ্নেরা জন্ম নেয়...আরও একবার...

পুজো আসলেই আমার কেমন যুগপৎ আনন্দ আর মনখারাপ হয়...ঠিক যেমন আলো আর ছায়া জড়াজড়ি করে থাকে, তেমনই।
ছোটবেলায়, ক্লাস ফাইভ, স্কুল থেকে পুজোর ছুটিতে রচনা লিখতে দেওয়া হল "আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে"। তৎকালীন মাস্টারমশাইয়ের সাথে পরামর্শ করে শরৎ নিয়ে বেশ একটা রচনা লেখা গেছিল বটে, কিন্তু মুশকিলটা হল যখন তিনি আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিলেন এ গানটা লেখার সময় রবি ঠাকুর নাকি অসুস্থ ছিলেন...তাঁর যেন মনে হচ্ছে এই রাত আর ফুরাবে না..."আশ্বিনের শারদ প্রাতে" "আলোক মঞ্জীর" তাঁর অশ্রুতই রয়ে যাবে...তবু "রাত পোহালো"...তবু কী যে এক বেদনা লেগে থাকে সারাটা গানে! তখন বুঝিনি, এখনও বুঝিনা হয়তো সব...তবে বয়সের সাথে দেখার পরিধি বাড়ে...আপাত বেদনা থেকে চোখ আটকে যায় টুকরো টুকরো কিছু শব্দে..."বেদনা হতে বেদনে"...ওই যেখানে বলছেন

 "তোমার বুকে বাজল ধ্বনি
 বিদায়গাথা, আগমনী, কত যে -"

 
কী আশ্চর্য! 'বিদায়গাথা' আর 'আগমনী' এই শব্দদু'টো কেউ পাশাপাশি লিখতে পারে? তাছাড়া এ তো শরতের গান...বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল ঋতুর গান...তাতে এত বিষাদ কেন? আবার গানের শেষে বলছেন,

"সময় যে তার হল গত
নিশিশেষের তারার মতো -
     শেষ করে দাও শিউলি ফুলের মরণ-সাথে।"


এ গানের ইতিহাস আমার জানা হয়নি অনেক চেষ্টা করেও...শুধু এই শব্দের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে কখন যেন বিষাদমাখা কিছু শিউলিভোর চুপিচুপি ঢুকে পড়েছে আঙিনায়...পুজো এলেই আমার উঠোনের সামনের শিউলি গাছটার জন্য খুব মন খারাপ করে...যে সারাবছর ফুল দিতে দিতে একদিন কী করে যেন মরে গেল...পুব দিকের পাঁচিল ঘেঁষে চায়ের দোকানের সামনের শেওড়া গাছটার কথাও বড্ড মনে পড়ে এই সময়টাতেই...যাকে কারোর কক্ষনো পছন্দ ছিল না...অমন ঝাকড়া, বেমক্কা একখানা গাছ! যে আলো আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিল অন্তত এক দশক...সে গাছও কাটা পড়ল একদিন...ঠিক এই সমস্ত ছাতিমের গন্ধ-মাখা দিনেই আমার পিসিমণির কথাও মনে পড়ে...

"আগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে;
হানে মৃদঙ্গ বাতাসে প্রতিধ্বনি :"


"আরব্ধ আগমনী"র "মূক প্রতীক্ষা" বলে দেয় কত কত প্রতীক্ষার শেষ হয়ে গেছে এক একটা বছরে...একটা পুজো থেকে আর একটা পুজো, কিংবা আরও দুই কিংবা তিন পুজোর ব্যবধানে যেসব বন্ধুত্ব সময়ের কাছে হেরে গেছে, তাদের জন্যও ঠিক এই সময়টাতেই মন হু হু করে...না-উল্টানো পূজাবার্ষিকীর পাতা আর পঞ্চমী থেকে ভাইফোঁটার দীর্ঘ ছুটির হিসেব কমতে কমতে বিসর্জনের তাড়ায় লেপ্টে থাকা দেখে বুঝি বড় হয়ে গেছি...শুধু এক অন্তঃসলিলা হরিষ ও বিষাদ হাত ধরাধরি করে চলে...কখনও আনন্দ ফুৎকারে বিষাদ নস্যাৎ করতে করতে এগোয়...কখনও বিষাদ তার গলা টিপে ধরে...শুধু এখনও এক মায়াময় মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয়, এই তো সব একই আছে...এই তো আবার সব নতুন করে শুরু করা যায়...এই তো তার দশহাতে রয়েছে কোনো মুশকিল আসানের যাদুমন্ত্র...তার দীঘল চোখে কোন ভালোবাসার মায়াকাজল...তার নিরঞ্জনে অনাগত শুভের আহ্বান...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন