দোঁহা

গীতাঞ্জলি থেকে ‘HOHE LIEDER’

 

 

অরুন্ধতী দাস

 প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে উইলি হ্যাস এবং কার্ট পিনথুস, এই দুই জার্মান রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ইংরেজি তরজমা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এই একই সময়ে জার্মানির ‘Kurt Wolff Publishing House’ বিশ্বসাহিত্যের সেরা সৃষ্টিগুলি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে একে একে প্রকাশ করছিল। গীতাঞ্জলির জার্মান অনুবাদ প্রকাশ করার ব্যাপারে এই দুই ভদ্রলোকের কাছে প্রকাশন সংস্থাটি পরামর্শ চাইলে তাঁরা বলেন যে, জার্মান জনমানসে গীতাঞ্জলির অনুবাদ কোনোরকম সাড়া জাগাতে পারবে বলে তাঁরা মনে করেন না। ফলে, গীতাঞ্জলির জার্মান অনুবাদ প্রকাশে তাঁরা অনাগ্রহই প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যে, ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি নোবেল পুরস্কার লাভ করলে ‘Kurt Wolff Publishing House’ তা প্রকাশ করে এবং সেই দেশে রবীন্দ্রনাথের এমনই জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয় যে, কিছু মানুষ তখন একে ‘টেগোর ম্যানিয়া’ বলে পর্যন্ত বর্ণনা করেছিলেন!
       

ইংরেজি গীতাঞ্জলি পড়ে মুগ্ধ হন স্টকফোর্ড ব্রুক-ও। তবে তিনিও এই সন্দেহই পোষণ করেন যে, এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে সাধারন পাঠকমহলে কোনো বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি হবে না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও লিখেছিলেন অজিতকুমার চক্রবর্তীকে, “আমি নিজে কতবার মনে করেছি এবং তোমাদের বলেছি, বাংলা ভাষাতেও এগুলো ঠিক সাহিত্যের মধ্যে গণ্য হবার যোগ্য নয়—এ কেবলমাত্র আমার নিজের মনের কথা, আমারি প্রয়োজনে লেখা।” আসলে রবীন্দ্রনাথ কবিতাগুলি লিখেছিলেন কোনো সোজাসুজি পঙ্‌ক্তিবিন্যাসে সংক্ষোভ সৃষ্টি করে নয়, পাঠকের সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের কোনো চেষ্টা, কোনো সংলাপধর্মিতাও এর মধ্যে নেই। সম্পূর্ণভাবেই অন্তর্মুখী কবিতাগুচ্ছের সংকলন গীতাঞ্জলি।
       

ঠিক এই কারণেই অনুবাদে অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায় এর অন্তর্গত সুর। এমনিতেই রবীন্দ্রনাথ সার্জ মুর-কে লিখেছিলেন যে অনুবাদ হল “...putting them inside a case which is not their own body”। আর গীতাঞ্জলির মধ্যেকার এই নির্জনতা, একান্ত ভারতীয় পরিবেশ এবং সংগীতের মূর্ছনা প্রভৃতির অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের দিকেই ইঙ্গিত করে। তবু অনূদিত গীতাঞ্জলিই রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের দরবারে। ইংরেজি ভাষায় গীতাঞ্জলির অনুবাদে হাত ছিল ইয়েটস-এর। ফরাসি ভাষায় গীতাঞ্জলির সম্পূর্ণ অনুবাদ করেন আঁদ্রে জিদ। এই দুই ভাষায় গীতাঞ্জলির ভাষান্তর করেছিলেন দুই ভাষারই দুই স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। এই বিশেষ ব্যাপারটি লক্ষ করেছিল জার্মানির ‘Kurt Wolff Publishing House’। ফলে, তাঁরা চাইলেন জার্মান ভাষায় অনুবাদের দায়িত্ব নিক সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ জার্মান কবি রাইনার মারিয়া রিলকে।
       

রিলকের কাছে এই প্রকাশনা সংস্থাটি অনুবাদের জন্য চিঠি দিলে তার প্রত্যুত্তরে রিলকে একটি দীর্ঘ চিঠি দেন। সেই চিঠি যে শুধু মি. উলফকেই হতাশ করেনি তা নয়, হতাশ করেছে প্রতিটি কবিতাপ্রিয় পাঠককেও। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির রিলকে-কৃত জার্মান অনুবাদ রসের সৃষ্টিতে যদি ব্যর্থও হত, তা সত্ত্বেও এ কথা নিশ্চয়ই বলা চলে যে, জার্মান অনুবাদটি আর-একটি সমান্তরাল শ্রেষ্ঠ কাব্যের জন্ম দিত। শুধু রিলকেই নন, রবীন্দ্রনাথের এ কাব্যগ্রন্থ পাঠ করেন জার্মান সাহিত্যের আর-এক বিখ্যাত সাহিত্যিক হেরমান হেস। তিনি গীতাঞ্জলির সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, ”These songs consist of prayers, conversations with God, invocations and fairy tales of the soul, full of India’s ancient pantheistic spirit...”। হেস বর্ণিত ভারতের প্রাচীন শব্দেশ্বরবাদ এবং এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত “নিজের মনের কথা” যুক্ত হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই অস্পষ্টতা সৃষ্টি হয়েছে ইংরেজি অনুবাদে। হেস শুধু ধর্মীয় কথা বলেই থেমে থাকেননি, তিনি এর মধ্যে শান্তি এবং সমস্ত পৃথিবী থেকে নির্বাসিত এক জগতের কথাও বলেছেন—“These are not the songs of a quiet, noble dreamer who spends his days, remote from the world, in poetic worship”।

হেরমান হেস-এর রবীন্দ্রনাথকে স্বপ্নদ্রষ্টা সাধক কবি বলে মনে হওয়ার পাশাপাশি আমরা রাখতে পারি ফরাসি অনুবাদক আঁদ্রে জিদ-এর অবস্থার কথাও। শঙ্খ ঘোষ জিদ প্রসঙ্গে বলেছেন, “এর মধ্যে তিনি শুনেছিলেন শুমান বা বাখ্‌-এর সংগীতের তুল্য কোনো ধ্বনি”। হেস যাকে স্বপ্ন, শান্তি, নির্জন বলেছেন, জিদ তার মধ্যে দেখছেন আলো, শুনছেন ধ্বনি। গীতাঞ্জলি এই সব কিছু নিয়েই রচিত।
       আসলে রহস্যটা অন্যত্র। গীতাঞ্জলিতে মিশে গেছে সনাতনী পুরোনো ধাঁচের গীতিকবিতার সঙ্গে একেবারে আধুনিক কবিতার চরিত্র। সুর থাকলেও কবিতার মধ্যে একটি শব্দেরও বাহুল্য নেই—মেদহীন, যেন কবিতার এক চরম সারাৎসার। তাই এই কবিতাগুলি শব্দবন্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সীমানা ছাড়িয়ে যুক্ত হয়েছিল আবহাওয়া। ব্যাপ্তির চেয়ে গভীরতা এখানে বেশি, তবে এ গভীরতা শুধু কেন্দ্রের দিকেই। ভারতীয়তার সঙ্গে ক্রমশ এইভাবে যুক্ত হয়েছিল আধুনিক কবিতার উপকরণগুলি। হেসের কথাতেও মেলে এই বক্তব্যের সমর্থন—“Yet the strong, somewhat modern identification of the highest being with personhood is worthy of note... Indian-ness is tinged with the influence of European literature”।
       

রিলকের মধ্যেও দেখতে পাই গীতাঞ্জলি সম্পর্কে একটা অস্পষ্টতার অভিযোগের আভাস। অনুবাদকের দায়িত্ব নিতে গেলে কবিতাগুলিকে যেভাবে আত্মস্থ করে নিতে হয়, সেই কাজেই সবচেয়ে বড়ো অসুবিধা হয়েছিল রিলকের। তা ছাড়া কবি মানসিকতার দিক থেকেও দুজনের অমিল আরও বড়ো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তাঁর কাছে। কবিতার সঙ্গে কবির জীবন ও দর্শন অপরিচিত থেকে গেছে রিলকের কাছে, তাই চিঠিতে দেখি রিলকে লিখছেন—“Although much in these stanzas has a familiar ring, it seems, so to speak to be worn towards me on a tide of unfamiliarity whose movement I would hardly know how to produce without somehow doing violence to myself”। ইংরেজি গীতাঞ্জলি অনুবাদকালেই যথেষ্ট পরিমাণে বাদ গিয়েছিল এর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি। তবুও সেই ইংরেজি গীতাঞ্জলির “tide of unfamiliarity”-ই ছিল রিলকের কাছে অনুবাদের সবচেয়ে বড়ো অন্তরায়। তাই তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি “I would hardly know how to produce”। এই সমস্যা শুধু রিলকেকেই আন্দোলিত করেছে এমন নয়, রিলকে ছাড়াও আরও যাঁরা এ কাব্যগ্রন্থের অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন, প্রায় কেউই এর অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনার সমস্যাটিকে ভাষান্তরে জয় করতে পারেননি। শেষপর্যন্ত জার্মান ভাষায় গীতাঞ্জলির অনুবাদ করেন Marie-Luise Gothein। কিন্তু সেই অনুবাদও ভাব পরিস্ফুটনে গীতাঞ্জলির সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি। ঠিক সেইসব জায়গাতেই এই অনুবাদ মুখ থুবড়ে পড়েছে, যেগুলি রিলকে অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, পূর্বে উল্লিখিত দীর্ঘ চিঠিতে তার সাক্ষ্য রয়ে গেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন