দোঁহা

পোড়োজমির কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ

প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী


অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস, ফোটায়
লাইলাক কোনো মৃত জমি থেকে, মেশায়
স্মৃতি ও অভিলাষ, কাঁপায়
বিবর্ণ মূল বসন্তবৃষ্টিতে।


[‘বন্ধ্যা ভূমি’, টি এস এলিয়ট, স-টীক অনুবাদঃ দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য]

...আবারও আমরা এক অবিশ্বাস্য এপ্রিল পেরিয়ে এসেছি। পৃথিবী জুড়ে আবারও যুদ্ধের দামামা বেজেছে। অতিমারির অনিশ্চয়তাকে পেরিয়ে, আবারও নতুন করে মনুষ্যসৃষ্ট অশান্তি ও অত্যাচারের এই পৃথিবীতে আমাদের ঘুম ভেঙেছে। এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে এলিয়টের স্মরণ নেওয়াটাই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ। যে এলিয়ট, বামপন্থী সমর সেনের কথাতেও, “আমাদের বখাটে জেনারেশনের শ্রেষ্ঠ কবি”।

যে বইটাকে হাতে তুলে নিয়েছিলাম, তার শিরোনাম হলো ‘বন্ধ্যা ভূমি ও চতুরঙ্গ’ (টি এস এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্টল্যাণ্ড’ ও ‘ফোর কোয়ার্ট্রেটস’এর স-টীক অনুবাদ), অনুবাদে দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য। এই অবধি পড়েই সুধীজনেরা কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন আসল এলিয়টকে না পড়ে, হঠাৎ অনুবাদেরই বা স্মরণাপন্ন হওয়া কেন? যেখানে স্বয়ং রবার্ট ফ্রস্ট সুস্পষ্ট ভাবে সাহিত্যের অনুবাদ প্রসঙ্গে বলে গিয়েছেন, “অনুবাদের ফলে যতটুকুকেই আমরা হারিয়ে ফেলি, ঠিক ততটুকুই আদতে কবিতা।” কবির এই বক্তব্য সত্ত্বেও, এখানে কেবল বলতে চাইব – ঠিক এই জায়গাটিতেই একজন অনুবাদকেরও সার্থকতা। ব্যক্তিগত সূত্রে কিছু অনুবাদকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পেরেছি, কিছু অনুবাদ-সাহিত্যকে উপভোগ করতে পেরেছি বলেই একথা বলতে পারি, একজন সার্থক অনুবাদককেও অনেকাংশে সেই সাহিত্যিক বা তাঁর সেই সাহিত্যেরই কাছাকাছি পৌঁছিয়ে যেতে হয়। উপলব্ধি করতে হয় মূল রচয়িতার মনের সমস্ত গহিন গভীরতাকে। তাঁরই সঙ্গে একত্রে ডুবে যেতে হয় সেই রচনার সমকালে। অনুবাদ করতে যাওয়া রচনাটির প্রেক্ষিতটুকুকে বুঝে নিতে হয় নিশ্চিত আত্মবিশ্বাসে। তবেই সে অনুবাদ সার্থক হয়ে ওঠে।

বাংলায় অনুবাদ সাহিত্য বরাবরই একটি নিজস্ব ঘরানার পরিচয় দিয়ে এসেছে। মৌলিক সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলায় অনুবাদ সাহিত্যেরও নিজস্ব একটি পরিসর, নিজের যোগ্যতাতেই তৈরী হতে পেরেছে। সেই সূত্রে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের বাংলা অনুবাদকে হাতে তুলে নিতে গিয়ে বেশীরভাগ সময়েই তৃপ্তির অনুভূতি জাগে। এই বইটিও ব্যতিক্রম নয়। “এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস, ফোটায় লাইলাক কোনও মৃত জমি থেকে...”

এলিয়ট তাঁর ‘ওয়েস্টল্যাণ্ড’ কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯২২ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে মনে রেখে। যুদ্ধদীর্ণ ইয়োরোপ তখন এক কাদামাটির পোড়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত। সেই বন্ধ্যাজমিকে অনুভব করেই কবির এই রচনা। বিষ্ণু দে থেকে সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু এমনকি সমসাময়িক রবীন্দ্রনাথ – এঁদের সকলেরই এলিয়ট পাঠের সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রথম তিনজনকে বিশেষ ভাবে নাড়িয়ে তুলেছিল ‘ওয়েস্টল্যাণ্ড’। আশ্চর্য এক সমাপতন বলে মনে হয়। ১৯১৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ডে এক ঘরোয়া সাহিত্যসভায় রবীন্দ্রনাথ উপনিষদ ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছিলেন। পাঠ করেছিলেন তখনও অবধি অপ্রকাশিত, তাঁর লেখা ‘ডাকঘর’ নাটকের কিছু অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র এলিয়ট সেদিনের সাহিত্য সভাতে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনেকেই মনে করেন ঋষিপ্রতিম রবীন্দ্রনাথের সেই উপনিষদ ব্যাখ্যাই তাঁকে ভারতীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি সংস্কৃত অধ্যয়ন করেন, এবং ‘ওয়েস্টল্যাণ্ড’এর শেষ অংশটিতে জুড়ে দেন উপনিষদের শান্তিপাঠ। যুদ্ধদীর্ণ মরুভূমি-সম সেই মহাদেশের উপর যেন বা সেই সময়ের এক দগ্ধ-দীর্ণ কবির [মান্না]-বর্ষণের এক আকুল প্রচেষ্টা। এই যে অসামান্য একেকটি সমাপতন, তারও খোঁজ পেতাম না – যদি না শ্রীভট্টাচার্য তাঁর স-টীক অনুবাদটিতে এই সমস্ত বিষয়গুলিকেই না উল্লেখ করে দিতেন। বইটি পড়তে পড়তে আক্ষরিক অর্থেই বলতে পারি, ‘ওয়েস্টল্যাণ্ড’ বা ‘ফোর কোয়ার্ট্রেটস’কে নয়, আমরা যেন আদতে এলিয়টকেই পড়ছিলাম। তাঁর বিবর্তনকে পড়ছিলাম।

‘ফোর কোয়ার্ট্রেটস’ লেখা হয় ১৯৪৩-এ। ততদিনে আরও একটি বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে পৃথিবী। ষাট ছুঁতে চলা ‘ওয়েস্টল্যাণ্ড’এর কবিও তখন আরও বেশী করে ঝুঁকে পড়েছেন ধর্মীয় চেতনায়, আশ্রয় খুঁজতে চেয়েছেন পুরাণে, ঐশ্বরিক কিছুতে। ‘ফোর কোয়ার্ট্রেটস’এর কবিকে দেখলে অনেকেই মনে করতে পারেন কি ভাবে এমন একজন ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষকে ‘আদর্শ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন সেকালের সমর সেন অথবা বিষ্ণু দে’র মতো আধুনিকেরা। আসলে তাঁরা দেখেছিলেন ‘ওয়েস্টল্যাণ্ড’এর কবিকে। এই বিষয়েও অসাধারণ একটি আলোচনা উঠে এসেছে এই বইটির মুখবন্ধ অংশটিতে, যেটি রচনা করেছেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার মানুষ শঙ্খ ঘোষ।

“এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস”, সেই এপ্রিলেই আমরা দেখেছি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গালিপোল্লি’র বীভৎসতাকে। সেই এপ্রিলেই, ১৯২২ পেরিয়ে আজ ২০২২এ দাঁড়িয়ে আমরা দেখেছি ইউক্রেনের নৃশংসতা। উপনিষদের শান্তিপাঠের মুহূর্তটুকুকেও তখন যেন নিষ্ফল বলে মনে হয়। এই সমস্ত টুকরো টুকরো ছবি, উপলব্ধি, অনুভব এই সবকিছুই যেন সন্ধ্যার আকাশে কালপুরুষের মতোই এই বইটির পাঠান্তে পাঠকের মনে জেগে উঠতে থাকে। স্তব্ধ হয়ে তখন উপলব্ধি করতে ইচ্ছে হয় মানবতার দৈন্যকে। হিংসার চির-আগ্রাসী অভিযানকে। কেবল আশ্বাসবাণী শোনা যায়, যখন জানতে পারি তাঁর সেই উপনিষদ পাঠ শুনে তরুণ এলিয়টের গভীর অনুভূতির কথা যখন রবীন্দ্রনাথকে জানানো হয়েছিল, জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তিনিও সেই সময়ে ততদিনে বিখ্যাত হয়ে ওঠা এলিয়টেরই একটি কবিতার অনুবাদের কাজে মগ্ন। সময়টা মে মাস, ১৯৪০ সাল। এলিয়টের কবিতাটির নাম ছিল ‘দ্য গিফট অব দ্য ম্যাজাই’, রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুবাদ কবিতাটির শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘তীর্থযাত্রী’। তার কয়েকটি পংক্তিকেই শেষাংশে উদ্ধৃত করে দিলাম,

‘এলেম ফিরে আপন আপন দেশে, এই আমাদের রাজত্বগুলোয়
আর কিন্তু স্বস্তি নেই সেই পুরানো বিধিবিধানে
যার মধ্যে আছে সব অনাত্মীয় আপন দেবদেবী আঁকড়ে ধরে।
আর একবার মরতে পারলে আমি বাঁচি।”

[‘তীর্থযাত্রী’, ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]




গ্রন্থ: ‘বন্ধ্যা ভূমি ও চতুরঙ্গ’ [টি এস এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্টল্যাণ্ড’ ও ‘ফোর কোয়ার্ট্রেটস’এর স-টীক অনুবাদ]
অনুবাদে: দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য
প্রকাশক: ঋত প্রকাশন,
প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল, ২০১৯

 


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন