![]() |
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী |
রাজর্ষি গুপ্ত
কাউন্ট আলেক্সান্দার ইলিয়িচ রস্তফ প্রাক-বলশেভিক রাশিয়ার বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা এক অভিজাত পুরুষ। মাস্টার অফ দ্য হান্ট, অর্ডার অফ সেন্ট অ্যান্ড্রু’স সম্মানে সম্মানিত, ঐতিহ্যপূর্ণ জকি ক্লাবের সদস্য তেত্রিশ বছর বয়সী কাউন্ট রস্তফের সব বিষয়েই অগাধ জ্ঞান। বাকচাতুর্য, আদবকায়দা আর ব্যবহার দিয়ে তিনি পৃথিবীকে মোহিত করে রেখেছেন। বৌদ্ধিক চর্চা আর সামাজিক আলাপ-আলোচনায় তিনি নিজেকে মগ্ন রাখেন দিনরাত, কারণ—‘জেন্টলম্যান’-দের ‘কাজকর্ম’ করার দরকার পড়েনি, পড়েও না। তাঁর ঠিকানা ক্রেমলিনের ঠিক বিপরীতে মেট্রোপোল হোটেলের আলিশান স্যুইট। দিন আর রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এহেন কাউন্ট দাঁড়াতে বাধ্য হলেন কমিউনিস্ট পার্টির বিচারসভার সামনে। ১৯১৩ সালে একটি কবিতা তিনি লিখেছিলেন যা পার্টির চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। তাঁর মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু প্রাক-বলশেভিক যুগে তিনি কিছু বীরত্বের পুণ্য সঞ্চয় করেছিলেন বলে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে পার্টির বিচারকরা তাঁকে আজীবন গৃহবন্দী থাকার সাজা দিলেন। তাঁর নতুন ঠিকানা হল হোটেল মেট্রোপোলেরই বিলাসবহুল স্যুইট ছেড়ে সাততলার একচিলতে অ্যাটিক, যেখানে তাঁর টেবিলখানাই ভালো করে আঁটে না।
এইটুকু হল ২০১৬ সালে প্রকাশিত আমেরিকান ঔপন্যাসিক আমোর টাওয়লসের দ্বিতীয় উপন্যাস A Gentleman in Moscow-র প্রাক্কথন। এর পর প্রায় চারশো পাতা জুড়ে চলেছে এক অদ্ভুত ওডিসি। মেনে নেওয়ার নয়, মানিয়ে নেওয়ারও নয়—পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্প। কিন্তু না, এ আর এক রবিনসন ক্রুসোর গল্পও নয়, যেখানে পারিপার্শ্বিক মানেই প্রতিকূলতা আর সেই পারিপার্শ্বিককে জয় করে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করাই লেখকের উদ্দেশ্য। এই কাহিনি পাঠককে বুঝিয়ে দেয় সেই চিরপুরাতন কথাটি—“change is the only constant”—সত্যি তো বটেই, কিন্তু জীবনের বয়ে চলার খাতিরে সেই পরিবর্তন ভিতর-বাহির দু তরফেই হতে হয়। এই উপন্যাসের জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গীটি বড় মজার। ১৯২০ থেকে ৫০-এর দশকের মধ্যে রাশিয়ার যে বিপুল রাজনৈতিক উত্থান-পতন ঘটছে, পৃথিবী জুড়ে পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে তার জায়গায় যে নতুন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে, তার থেকে যেন সহস্র মাইল দূরে অবস্থান মেট্রোপোল হোটেল আর সেখানে যাবজ্জীবন গৃহবন্দী থাকা কাউন্টের। স্তালিন-ক্রুশ্চেভ সেই কাহিনির সীমারেখায় মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যান। কাউন্টের জীবনে তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি ‘প্রভাবশালী’ হয়ে ওঠে ন’ বছরের বালিকা, মধ্যবয়সী আমেরিকান দম্পতি, হোটেলের কর্মচারীদের মতো ছোট কিন্তু রক্তমাংসের চরিত্রেরা। পড়তে পড়তে ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল—এই উপন্যাসকে কি ঐতিহাসিক গোত্রে ফেলা চলে, না চলে না?
কিন্তু ওসব প্রশ্ন ভুলে কাউন্ট রস্তফ নামের এক অদ্ভুত মানুষের প্রেমে পড়ে প্রায় চারশো-ত্রিশ পাতা উলটে গেলাম। তিনি চলনে-বলনে পাক্কা ওল্ডস্কুল অভিজাত, আর তাঁর প্রেমে পড়ার কারণ তাঁর আভিজাত্যই। ব্যবহারের তো বটেই, তার থেকেও বেশি চিন্তার আভিজাত্য। উপন্যাসের একদম গোড়ায় তিনি নিজেই স্বীকার করে নেন যে তিনি অভিজাত, আর অভিজাতদের কোনও 'পেশা’ থাকে না। অর্থাৎ প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেন যে আভিজাত্যই তাঁর জীবনের একমাত্র উপজীব্য, একমাত্র সম্বল। কথাটা ঘোরতর নাক-উঁচু শোনালেও আস্তে আস্তে তাঁর সম্পর্কে পাঠকের ধারণা পাল্টাতে থাকে যখন আমরা দেখি পরিবর্তিত প্রতিকূল জীবনযাত্রার মধ্যে তাঁর আভিজাত্যই তাঁর হাতে শান দেওয়া অস্ত্র হয়ে থেকে যায়। শৈশবে তাঁর গডফাদার দেমিদফ তাঁকে আভিজাত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠটি পড়িয়েছিলেন—‘মানুষ যদি তার পারিপার্শ্বিককে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তবে সে নিজে পারিপার্শ্বিকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেই।’ এই কথাটি মাথায় রেখে তিনি তাঁর অতীত-বর্তমানের হাজারো প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে চলেন আভিজাত্য মাখানো ক্ষুরধার রসবোধ, বাস্তবিক জীবনবোধ আর প্রগাঢ় প্রজ্ঞা দিয়ে। বলশেভিক ঘৃণার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে তিনি যখন অতি সাধারণ তুচ্ছাতিতুচ্ছ উত্তরও দেন, তাঁর রসবোধের গুণে হাস্যাস্পদ হয় তাঁকে নিচু নজরে দেখা মানুষগুলোই। অথচ তিনি কিন্তু কাউকে একটিবারের জন্যও ছোট করেন না। কষ্ট হলেও তিনি পরিবর্তিত বাস্তব সত্যকে মেনে নেন। আর তার মধ্যেই খুঁজে নেন জীবনের নতুন অর্থ, নতুন আনন্দ। এক চিলতে ঘরের লোহার খাটের স্প্রিংয়ের ক্যাঁচকোঁচের মধ্যে তাঁর প্রশিক্ষিত কান খুঁজে পায় ‘জি-শার্প’ সুর। পোস্টকার্ডের আয়তনের জানলায় এসে বসা পায়রার সঙ্গেও তিনি সমকক্ষের মতো গল্প জুড়ে দেন। হোটেলের ভৃত্যেরা, যাঁরা এককালে তাঁর সেবক ছিলেন, ক্রমে হয়ে ওঠেন তাঁর সহৃদয় বন্ধু ও সহকর্মী। হ্যাঁ, সহকর্মীই, কারণ যেহেতু সমাজতন্ত্রী রাশিয়া অভিজাতের ‘বসে খাওয়া’ নিষিদ্ধ তাই তাঁকে পেশা খুঁজে নিতেই হয়। ওয়াইন আর খাদ্যসংস্কৃতিতে কাউন্ট রস্তফের অসীম আগ্রহ ও জ্ঞান। কাজেই এককালের অভিজাত ভদ্রলোক হয়ে ওঠেন হোটেল মেট্রোপোলের হেড ওয়েটার। এবং তাতেও, আমরা অবাক হয়ে দেখি, তাঁর জীবনে আনন্দের খোঁজ থামে না।
এই পরিবর্তনটাই গোটা উপন্যাসটির উপজীব্য। ইতিহাস বলতে যদি কালখণ্ড বুঝি তবে রাশিয়ার ইতিহাস, সাধারণ মানুষের ইতিহাস এর চেয়ে অনেক ভালো ভাবে ‘ডকুমেন্টেড’ হয়েছে জার-যুগ থেকে সোভিয়েত-যুগ পর্যন্ত অনেকানেক উপন্যাসে। কিন্তু এই উপন্যাস ঐতিহাসিক ১৯২০ থেকে ’৫০-এর দশক পর্যন্ত ইতিহাসের মাইক্রোন্যারেটিভের ধারণে ও কারণে। থেকে হোটেলের অতিথিরা বাইরের পালটে যেতে থাকা জগতের হাওয়া নিয়ে আসেন কাউন্টের কাছে। সেই সমস্ত মাইক্রোন্যারেটিভের পরিপ্রেক্ষিতে কাউন্টের নিজস্ব মাইক্রোন্যারেটিভ বদলে বদলে যেতে থাকে। আর তা মেনেও নিতে থাকেন সদানন্দময় মানুষটি, যাঁর জীবনের মূলমন্ত্রই হচ্ছে স্মিত হেসে “Just So!” বলে অবিচল থাকা। শ্রেণীদ্বন্দ্বের কাহিনির ঊর্ধ্বে উঠে উপন্যাসটি হয়ে ওঠে বন্ধুত্ব, পিতৃত্ব এমন নানান মানবিক সম্পর্কের দলিল।
কাউন্ট তাঁর বন্দীজীবনের গুরুভারকে লঘু করে দেখবেনই—এই তাঁর পণ। জীবন তাঁকে পিষে ফেলতে চাইলেও তিনি হার মানবেন না। হাসিমুখে এগিয়ে যাবেন নিজের মূল্যবোধ আর পরিবর্তনকে সঙ্গী করে। এই অদ্ভুত চরিত্রের সমাজ-সময়ের বিরুদ্ধে আশ্চর্য প্রতিরোধ আর পরিবর্তনের বিপরীতধর্মিতাকে প্রায় সাড়ে চারশো পাতা জুড়ে ফুটিয়ে তোলা বড় সহজ কাজ নয়। আমোর টাওয়ল্স সেই দুরূহ কাজটি পেরেছেন তাঁর ভাষার গুণে। তাঁর ভাষা কোথাও অলঙ্কারময়, কখনও বা স্মৃতিমেদুর, কখনও মৃদু হাসিতে ভরপুর। ছদ্ম-মহাকাব্যিক হাস্যরসে টইটম্বুর। খাবারের পদের সঙ্গে গোমড়ামুখো ওয়েটার ভুল ওয়াইন দিতে চাইলে কাউন্ট আঁৎকে উঠে খাবার আর ওয়াইনের ঝগড়ার কথা তুলে হেক্টর-অ্যাকিলিসের মহাযুদ্ধের বর্ণনায় চলে যান। তাঁকে আজীবন গৃহবন্দী রাখার জন্য শাসনব্যবস্থার উপর প্রতিশোধ নিতে চান তিনি দল পাকিয়ে। কী সেই প্রতিশোধ? এমন এক ফরাসী পদ (বুইয়াবায়েস) রান্না করা হবে যা থেকে বেরোবে খোদ সুদূর মার্সেই বন্দরের সুবাস—এই তাঁর প্রতিশোধ। সেই প্রতিশোধে সাগ্রহে সায় দেয় তাঁর সহযোগী হোটেলের অন্যান্য কর্মচারীরা। গাম্ভীর্যকে এহেন লঘু-করে-দেখা জীবনদর্শনকে ফুটিয়ে তুলতেই টাওয়ল্স যেন গোটা উপন্যাসে ছড়িয়ে রেখেছেন মৃদু হাসির সুরভি। ঘটনা, ভাষা আর এই বিষাদ-মধুর ‘টোন’ আমাকে বাধ্য করল উপন্যাসটির প্রতিটি পাতা উলটে যেতে।
কাউন্ট রস্তফের কাহিনি পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘জলসাঘর’-এর জমিদার বিশ্বম্ভর রায়কে। এক অস্তায়িত জীবন আর জীবনদর্শনের প্রতিনিধি তিনিও। কিন্তু সেই জীবনদর্শনকে আঁকড়ে ধরে থাকার মধ্যেই তাঁর আভিজাত্য, তাঁর প্রতিরোধ। সেই আভিজাত্যের গরিমাতেই তিনি মৃত্যুর সামনে মাথা পেতে দেন, কিন্তু নতজানু হন না। কাউন্ট রস্তফ আভিজাত্যের বিরাট আশ্রয়েই নতুন জীবনের নতুন আদর্শকে মেনে নিতে শেখান, শেখান যে তাতে পারিপার্শ্বিক পৃথিবীটার সব প্রতিকূলতাকেও নিজের অনুকূলের নিয়ে আসা সম্ভব। অভিজাত রাশিয়ান কাউন্ট রস্তফ রবীন্দ্রনাথ পড়েননি। পড়লে হয়তো তাঁর ভালো লাগত এই লাইনগুলো—
তোমার মাপে হয় নি সবাই
তুমিও হও নি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে--
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।
আকাশ তবু সুনীল থাকে,
মধুর ঠেকে ভোরের আলো,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।…
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
A Gentleman in Moscow by Amor Towles
Windmills Books (Penguin Random House UK), 2017 edn. Paperback. Rs. 499.00.