দোঁহা

চলচ্চিত্র : সমালোচনা ও সমালোচক

 

প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী

 অভিরূপ মুখোপাধ্যায়


ফিল্ম রিভিউয়ার ও ফিল্ম ক্রিটিক... এ-দুয়ের মধ্যে রয়েছে এক বিভাজনরেখা। কাকে বলব ফিল্ম রিভিউয়ার? আর কাকেই বা বলব ফিল্ম ক্রিটিক? দু-জনেই কি এক? না। সম্প্রতি শ্যাম বেনেগল একটি ভাষণে বলেছেন: 

I have to make this difference between a film critic and a film reviewer. A person who reviews films, is a person who is simply dealing with an audience, that is lightly audience of that particular film and the reviewer tells that audience of the basis of the readership profile…, the kind film that is, whether will they like it or won’t like it. So, that’s a job of a film reviewer. 
But a film critic is actually analyzing a film in the context of cinema itself and the evolution of the cinema is very important for that person to be aware of.  

   শ্যাম ফিল্ম রিভিউয়ার-এর প্রসঙ্গে যা বললেন, তেমন রিভিউ প্রায়শই পড়তে পাই আমরা। কোনো ছবি মুক্তি পেলে সে-ছবি সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা সাধারণত এইসব রিভিউ পাঠকের সামনে রাখতে চায়। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হই আমি। যেমন অনেক সময় কোনো কবিতা, বা কোনো উপন্যাস, কিংবা গান- প্রথমবারেই তার সম্পূর্ণ অর্থ আমাদের সামনে উন্মোচন করে না। অভিজ্ঞতার স্রোতে ধীরে-ধীরে সেই সমস্ত শিল্পের কাছে পৌঁছোতে হয় আমাদের। তেমনভাবেই একটি ছবিকে, কেবল একবার দেখেই তার বিবিধ চরিত্রগুণ কি বলে দেওয়া যায়? এ কি সম্ভব? 
   ঠিক এখানেই দরকার হয় একজন ফিল্ম ক্রিটিক-এর উপস্থিতি। যিনি একটি ছবি সম্পর্কে লেখার সময়ে, পৃথিবীর চলচ্চিত্রের বিরাট ইতিহাসকে নিজের মধ্যে জাগিয়ে রাখেন। কেবল ত্রুটিসন্ধান অথবা প্রশংসা নয়, বিশ্লেষণের মাধ্যমে শিল্পের এক আনন্দভূমিতে আমাদের পৌঁছে দেওয়াই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর আলোচনার প্রধান কাজ।
   এমনই একজন চিত্র-সমালোচক ছিলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত। তাঁর লেখায় চলচ্চিত্রের সর্বাঙ্গীণ আলোচনা সব সময় স্পর্শ করে থাকত এক নিরপেক্ষ দৃষ্টিকে। সিনেমা সম্পর্কে তাঁর চিন্তা ছিল স্পষ্ট ও নির্ভীক। এখন যে আমরা সেন্সরশিপ-এর ছুৎমার্গ নিয়ে এত কথাবার্তা বলি, বহু বছর আগে এ-সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারে চিদানন্দ বলেছিলেন:

আমাদের সেন্সরশিপেরও মাথামুণ্ডু নেই। কামশাস্ত্র, বাৎস্যায়নের দেশে অত ভিক্টোরিয়ানদের মতো নাক উঁচু হলে চলবে না; ইংরেজ মিশনারিরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে যা শিখিয়ে গেছে তাই আমাদের ধর্ম হয়ে গেছে, এটা তো আমাদের নিজেদের নয়।  

   এই একই সাক্ষাৎকারে একজন চলচ্চিত্রকার ও একজন চলচ্চিত্র সমালোচকের মধ্যের ভেদাভেদ সম্পর্কে চিদানন্দ দাশগুপ্ত বলেছিলেন:

চলচ্চিত্রকার আর সমালোচকের একটা তফাত আছে। একজন চলচ্চিত্রকার যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যে ধরনের ছবি করতে ভালোবাসে সেই জিনিস যদি অন্য চলচ্চিত্রকারের মধ্যে দেখে তাহলে তার কাজের প্রতি অনুরাগ জন্মায় কিন্তু বিপরীতধর্মী কাজ দেখলে সব সময় হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই হয় না। অন্য ঢঙের ছবি দেখলে একটা অবজ্ঞা দেখা যায়। চলচ্চিত্র সমালোচকের কিন্তু সব ধরনের ছবি সম্পর্কে সমান শ্রদ্ধা থাকে। যেখানেই সে দেখেছে একটা সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ পাচ্ছে সেটা যে ঢঙেই হোক যে দৃষ্টিভঙ্গিতেই হোক যে শিল্পরীতিতেই হোক তাতে তার কিছু এসে যায় না। তার কাছে বিরাট কিছু ব্যাপার হিসেবে সেটা আসে না। কিন্তু চলচ্চিত্রকারদের কাছে সেটা বিরাট হয়েই আসে। সে নিজের জিনিসটা বোঝে, কিন্তু অপরেরটা বুঝতে চায় না। 

সিনেমা সম্পর্কে এমন আশ্চর্য চিন্তার পরিচয় চিদানন্দ দাশগুপ্ত তাঁর সারাজীবনের লেখাগুলির ভেতর দিয়ে ক্রমান্বয়ে পাঠকের সামনে রেখে এসেছেন। এ-বছর চিদানন্দ দাশগুপ্ত জন্মশতবর্ষ চলছে। সেই উপলক্ষে দে’জ পাবলিশিং প্রকাশ করেছেন চিদানন্দ দাশগুপ্তের ‘গদ্যসংগ্রহ’-এর প্রথম খণ্ড, যা সম্পাদনা করেছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানেই এই সাক্ষাৎকার খুঁজে পাওয়া যাবে।
   চিদানন্দ দাশগুপ্তের ‘গদ্যসংগ্রহ’-এর অন্তর্গত লেখাগুলিকে সাতটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এইমাত্র যে-সাক্ষাৎকারটির কথা বললাম তা রয়েছে একেবারে প্রথমে। দ্বিতীয় পর্যায়টির নাম ‘চলচ্চিত্রের সপক্ষে আন্দোলন’। এ-বইয়ের এই অংশটি এক অমূল্য ইতিহাস-সম্পদকে ধারণ করে আছে। এ-কথা বলছি কারণ, ‘কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি’ যাঁদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাঁর মধ্যে যেমন সত্যজিৎ রায় ছিলেন, তেমনই তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত-ও। সেই ‘কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি’-র সূচনার অভ্যন্তরীণ চিত্রপট, নানা কথা, ফিল্ম সোসাইটির আন্দোলনের অভিমুখ-এই অংশের চারটি লেখার মধ্যে বলে দিয়েছেন চিদানন্দ। 
   স্বপ্ন, স্বপ্নবাস্তব ও বাস্তব-কীভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্রে দেখতে পাওয়া যায় সে-সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা রয়েছে এই সংগ্রহে। রয়েছে কেবল বাংলা চলচ্চিত্রকে নির্ভর করেই একটি পর্যায়। যেখানে ‘মাইকেল’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘চলাচল’, ‘কাবুলীওয়ালা’-র মতো পুরোনো বাংলা ছবি বিষয়ে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করেছেন লেখক। সেইসব আলোচনার ভেতর বাংলা সিনেমার ধারাপথের দিকচিহ্নগুলি খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাই আমরা। ঠিক এর পাশাপাশি বাংলা চলচ্চিত্রে নিউ রিয়ালিজিম-এর গুরুত্ব ও অবদান সম্পর্কেও আমাদের সচেতন করে দেয় চিদানন্দ দাশগুপ্তের লেখা।
   আরও দুটি পর্ব সম্পর্কে এখানে বিশেষভাবে বলতে হয়। যার মধ্যে একটি পর্বে রয়েছে কেবল সত্যজিৎ রায়ের ছবি সম্পর্কে চিদানন্দ দাশগুপ্তের বারোটি রচনা। এবং আরেকটি পর্ব, যার নাম ‘চরিত্রায়ন: অভিনেতা, অভিনেত্রী’, সেখানে রয়েছে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ এবং উৎপল দত্তের মতো অভিনেতাদের অভিনয় সম্পর্কে চিদানন্দ দাশগুপ্তের দৃষ্টিকোণ, যা নিঃসন্দেহেই যে-কোনো চলচ্চিত্র-উৎসাহীর কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হিসেবে থেকে যাবে। 
   চলচ্চিত্র সমালোচক ছাড়াও চিদানন্দ দাশগুপ্ত নিজে চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছিলেন। তাঁর পরিচালিত ‘রক্ত’ ছবিটি দেখার পর সত্যজিৎ বলেছিলেন: ‘কলকাতাকে তুমি যেভাবে ধরেছ তা বাংলা ছবিতে এখনও এভাবে কেউ ধরেনি।’ ‘রক্ত’ ছাড়াও তাঁর নির্মিত সিনেমাগুলির মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘বিলেত ফেরত’, ‘দ্য ডান্স অফ সিভা’, ‘আমোদিনী’, ‘জারুরাত কি পুরতি’। এইসব ছবির নির্মাণ-ভাবনার বহুবিধ গতিপথ সম্পর্কেও অনেক কিছু জানতে পারা যায় চিদানন্দ দাশগুপ্তের এই ‘গদ্যসংগ্রহ’ থেকে। 
   চিদানন্দ দাশগুপ্তের অনেক লেখা একসঙ্গে এ-গ্রন্থে খুঁজে পাওয়া গেলেও তাঁর অজস্র লেখা এখনও বহু পত্রিকার পাতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বইটির ভূমিকার শেষাংশে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন: ‘পাঠকদের কাছে আবেদন রইল, আরও লেখার সন্ধান পেলে আমাদের জানাবেন। তাঁর জন্মশতবর্ষেই ওই খণ্ডটি (দ্বিতীয় খণ্ড) প্রকাশে আমরা সংকল্পবদ্ধ।’ এই অতুলনীয় বইটির একজন সামান্য পাঠক হিসেবে এই আবেদন আমারও তরফ থেকে রইল। কারণ, এ-কথা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই যে, এই সংগ্রহ বাংলা তথা ভারতবর্ষের চলচ্চিত্র সম্পর্কে আকর গ্রন্থগুলির মধ্যে এক আলোকময় সংযোজন।
 
 
গদ্য সংগ্রহ ১
চিদানন্দ দাশগুপ্ত
দে'জ পাবলিকেশন্স,কলকাতা
 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন