দোঁহা

পিতা-পুত্র সংবাদ: বিষাদসিন্ধু পারাবারে

 


প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত 


গানটি দু'বার ঘুরেফিরে এসেছিল পর্দায়। দুটি ভিন্ন সময়, দুটি ভিন্ন দৃশ্যপট। অথচ গান, একটাই।

শক্তি সামন্তের অবিস্মরণীয় 'অমর প্রেম'-র  ওপেনিং ক্রেডিটস-এ, প্রথম বার, লম্পট স্বামীর হাতে লাঞ্চিত, প্রত্যাখ্যাত পুষ্পা শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে তাঁর বাপের বাড়ির দিকে। 

গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎই সে দেখে পালকি'তে করে বউ যাচ্ছে। থমকে যায় পুষ্পা। এক মুহূর্তে যেন ফিরে যায় তাঁর সুখের দিনগুলোয়। সে'ও ঘর বাঁধতে চেয়েছিল। চেয়েছে স্বামী, সন্তান, সংসার। কিন্তু নিয়তির অমোঘ পরিহাস। ঘর ছেড়েই বেরিয়ে আসতে হয়েছে তাঁকে। 

বিষাদঘন পরিবেশে প্রথমবার শোনা যায় গানটি। 

দ্বিতীয়বার শোনা যায় ছবির শেষাংশে। পুষ্পা তখন প্রৌঢ়া। জীবনের কঠিন বাস্তব পাক ধরিয়েছে চুলে, ঢিলে হয়েছে টান, হাতের চামড়ায়। এই ক'বছরে বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছে সে। দুর্ভাগ্য তাঁর হাত ধরে নিয়ে গেছে বেশ্যালয়ের অন্ধকারে। একচিলতে সুখ তবু এসেছে আনন্দবাবু, আর নন্দুর হাত ধরে। প্রতিবেশির সন্তান নন্দুকে পুষ্পা মাতৃস্নেহে ভরিয়ে তোলে। তার মুখ চেয়ে বাঁচে। 

এরপর বহু জল বয়েছে গঙ্গায়। সে এখন বয়স্কা। বাড়ি বাড়ি কাজ করে দিন গুজরান। একদিন হঠাৎই শুনতে পায় তাঁর স্বামীর মৃত্যুর খবর। সেই স্বামী যে কি না, অন্য এক নারীর জন্য একদিন তাঁকে পরিত্যাগ করেছিল। ঠেলে দিয়েছিল তাঁর জীবন নিকষ আঁধারে। আজ সে মৃত। 
 

 
 মুহূর্তে বৈধব্য গ্রাস করে তাঁকে। মন ভেঙে যায় তাঁর৷ যে স্বামী কোনওদিন তাঁকে স্বীকৃতি দেয়নি, আজ তাঁর জন্য মনকেমন করে ওঠে পুষ্পার। গঙ্গার তীরে পাথর দিয়ে ভেঙে ফেলে শাঁখা, পলা। এতদিনে যেন মায়া কাটিয়ে অন্য এক মুক্তির স্বাদ পায় সে। তবু অনির্বচনীয় এক বিষাদ সেই মুক্তির আলো স্পর্শ করে থাকে। 

নেপথ্যে আবারও শোনা যায় গানটি। দ্বিতীয় বার। 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হিঙের কচুরি'কে এই ভাবেই বড় পর্দায় উঠিয়ে আনেন পরিচালক শক্তি সামন্ত। নাম দেন 'অমর প্রেম' (১৯৭২)। দু বছর আগেই অবশ্য অসাধ্যসাধনটি করে ফেলেছিলেন আরেক বর্ষীয়ান পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। উত্তম-সাবিত্রীকে নিয়ে 'নিশিপদ্ম'-এ (১৯৭০) । সেই আলোয় পথ হেঁটে ছিলেন শক্তি। 

শক্তি পুত্র অসীম সামন্ত বলেছিলেন, "রাহুল দেব বর্মনের সুরে সিনেমায় এত গুলি হিট গান, লতা মঙ্গেশকরের 'র‍্যয়না বীতি যায়' বা 'বড়া নটখট হ্যায় ইয়ে' বা কিশোর কুমারের কণ্ঠে 'কুছ তো লোগ কহেঙ্গে', 'ইয়ে কেয়া হুয়া' বা 'চিঙ্গারি কোই ভরকে'-র মত দুর্দান্ত সেমি-ক্লাসিকাল স্কোর থাকা সত্ত্বেও আলাদা নজর কেড়েছিল এই গান। শচীন দেব বর্মনের কণ্ঠে ভাটিয়ালি ধুন আশ্রিত 'ডোলি মে বিঠাই কে কহার'..."
 
 

 
গান বা কম্পোজিশন নিয়ে অসাধারণ বোঝাপড়া ও ততোধিক তুমুল মতবিরোধ ছিল পিতা-পুত্রের। শচীন এবং রাহুল দেব বর্মন, দুজনেরই। দুজনেই সংগীত পরিচালনার জগতে দুই মহীরুহ। নিজ নিজ সময়ে সংগীত পরিচালক হিসেবে রীতিমতো মৌরসীপাট্টা কায়েম করেছেন তাঁরা। তবু খুব কম ক্ষেত্রে পিতা ও পুত্রকে একত্রে কোনও গানের রূপদানে দেখা গেছে। 

অথচ রাহুলের করা বহু সুর 'ইম্প্রোভাইজ' করে তা ব্যবহার করেছেন শচীন দেব বর্মন স্বয়ং। রাহুলও তাঁর বাপের একাধিক সুর ব্যবহার করেছেন নিজ রচনায়। তিনি অম্লান বদনে বলতেন, "বাপ কা মাল হ্যায়, আপনা হী হ্যায়!" রাহুলের বিভিন্ন কম্পোজিশনের নেপথ্যে, অলক্ষ্যে রয়ে গেছে শচীন কত্তার 'ফাইন টাচ'। 

মান্না দে বলেছিলেন, "শচীনদা সারাজীবনে এত অসাধারণ সব গানে সুর দিলেন, এত গান গাইলেন অথচ জীবনের সেরা গানটি গাইলেন কি না তাঁরই ছেলের সুরে৷ এ এক বিরাট প্রাপ্তি।" কিন্তু এতটাও সহজসাধ্য ছিল না তা। কারণ রাহুল ও শচীন দেব বর্মনের দুনিয়াটা সুরের মায়াজালে মোড়া হলেও, তাঁদের মধ্যে ছিল যোজন খানেক দূরত্ব। 

গানের ব্যাপারে ভীষণ 'চুজি' ছিলেন শচীন দেব বর্মন। কোনও গান যতক্ষণ না তাঁর অন্তঃস্থল স্পর্শ করছে, ততক্ষণ তার দিকে ঘুরেও তাকাতেন না শচীন কত্তা। এতটাই নিজের কাছে 'দায়বদ্ধ', সৎ থাকতেন তিনি। ছেলেকেও রেয়াত করেননি সেই মতাদর্শের জায়গায়। ভালো লাগলে যেমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন, খারাপ লাগলে প্রকাশ্যেই ঘুরিয়ে নিয়েছেন মুখ। ছেলেও তেমনই - 'বাপ কা বেটা, সিপাহি কা ঘোড়া...'

'অমর প্রেম'-এর গীতিকার আনন্দ বক্সী বলেছেন, গোটা সিনেমায় সংগীত পরিচালনার গুরু দায়িত্ব রাহুল দেব বর্মনের হলেও, প্রতি ক্ষেত্রে সেখানে হস্তক্ষেপ করেছেন শচীন কত্তা। প্রতিটি গান নিয়ে জানিয়েছেন নিজের মতামত, আরও কী ভাবে তা সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা যায় তা নিয়ে দিয়েছেন অক্লান্ত পরামর্শ। রাহুলও সেই মতো নিজেকে ঘষে মেজে গড়ে পিঠে নিতেন। অনেক ক্ষেত্রে বাবার পরামর্শ মানেননি, আবার বহু ক্ষেত্রে তা মেনেও নিয়েছেন। এতটাই স্বতন্ত্র, আপোষহীন পিতা-পুত্রের জগৎ। তাই শচীন কত্তাকে দিয়ে এই সিনেমায় গান গাওয়ানো এতটাও সহজ ছিল না। 

মজার বিষয়, শচীন কত্তা প্রথমে গানটি গাইতে রাজিই হননি। সে এক শিশুসুলভ বায়না। যতক্ষণ না মনে ধরবে, তিনি গাইবেন না। এদিকে গানটি প্রাথমিক স্তরে খারিজই করে দিয়েছিলেন শচীন কত্তা। অন্যদিকে ছেলে রাহুলও অনড়। সে এক বিদঘুটে পরিস্থিতি, বাপ-বেটার মধ্যে গড়ে ওঠা ঠাণ্ডা লড়াই নিয়ে৷ ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন কিশোর কুমার ও শক্তি সামন্ত। দুই বন্ধুর মিলিত প্রচেষ্টায় রাজি হন শচীন দেব বর্মন। আবার নতুন করে শুনলেন 'পিস'টি। মুখে ফুটলো হাসি, চোখে নামলো জল। ছেলে রাহুলকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বাকিটা ইতিহাস। 
 

 
 কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মজার বিষয়, গানটি গাইতে গিয়ে বহুক্ষেত্রে নিজের 'মাস্টার স্ট্রোক' দেন শচীন কত্তা। মূল রচনা ও সুরের কাঠামো বজায় রেখে আদ্যোপান্ত অনেক ক্ষেত্রেই নিজস্ব ট্রিটমেন্ট ঢুকিয়ে দেন তিনি। একে ভাটিয়ালি ধুন, তায় পালকি চলার ছন্দ। তাঁর চেয়ে ভালো 'এগজিকিউশন' আর কেই-বা করতে পারবে? তাই শেষপর্যন্ত এক আঁজলা 'পদ্মা'র জল তিনি অসামান্য দক্ষতায় মিশিয়ে দেন আকাশগঙ্গা'য়। তৈরি হল এক কালোত্তীর্ণ সৃষ্টি। গান রেকর্ড করে অশ্রুসজল চোখে ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে ছিলেন শচীন দেব বর্মন। প্রাণ ভরে করেছিলেন আশীর্বাদ। 

"ডোলি মে বিঠাই কে ক্যহার" আজও একটি মাইল স্টোন। এক অভূতপূর্ব সৃষ্টি। যার পরতে পরতে মিশে আছে দুই গানপাগল মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং নাছোড়বান্দা চিন্তাভাবনা ও আপোষহীন ছোঁয়া। আদ্যোপান্ত বিষাদ ভাটিয়ালির সুরে অপার্থিব জীবনদর্শন, অদৃষ্টকে স্পর্শ করবার তাড়না মিশে আছে যার আর্তি-তে৷ এখানেই গায়ক, পরিচালক পিতা-পুত্রের অপার্থিব যুগলবন্দী। যুগ যুগ ধরে যা পথ দেখাবে আগামীর সুরকারদের।

এখানেই ভেসে ওঠা সমর্পণের সন্ধিপ্রকাশ। দুই সুরসাধক পিতা-পুত্রের দ্বৈত আরাধনা। দুটি জীবন ও তার পারস্পরিক অখণ্ড 'অমর প্রেমে'র অশ্রুত আখ্যান।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন