দোঁহা

যে বইয়ের লেখক নেই: রহস্যমোড়া কবিতার গল্প

 


 আজব বুকশেলফ [দ্বিতীয় কিস্তি]

ঋত্বিক মল্লিক


সিডনির কাছে আধা-শিল্পশহরে অস্পষ্ট এক সন্ধেবেলায় শেকসপিয়রের একটি রচনাসংগ্রহ, জমা জলে মশার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে লেখা একটি মামুলি ড্রেনেজ রিপোর্ট, একটা বাজারচলতি উদ্ধৃতিসংগ্রহ আর একটা জীবনবিজ্ঞানের টেক্সট বই—এইসব অবান্তর আর নিঃসম্পর্ক গুটিকয় ছড়ানোছিটোনো জিনিস থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় জন্ম নিল ‘দ্য ডার্কেনিং এক্লিপটিক’ নামে একটি কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি। ছোটো বড়ো মিলে ষোলোটি কবিতা এবং একটি ভূমিকা রইল সে বইয়ে। আর একেবারে শুরুতে রইল একটি প্রাচীন প্রবাদ: “ছোটো ছোটো পাহাড়ে ঘেরা মাঠে গোপন কথা কখনও বোলো না”। এই পাণ্ডুলিপির লেখকের নাম আর্ন ম্যালে।


১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে ‘অ্যাংরি পেঙ্গুইন’ পত্রিকার দপ্তরে এসে পৌঁছেছিল একটি প্যাকেট। পত্রিকার সম্পাদক ম্যাক্স হ্যারিস দেখলেন প্যাকেটের ভিতরে রয়েছে ইথেল ম্যালে নামে জনৈকা মহিলার একটি চিঠি আর দুয়েকটি কবিতা। হ্যারিসের কিন্তু মনেই পড়ল না, এই নামে আদৌ কোনো মহিলাকে তিনি চেনেন কি না! দেখা গেল, মহিলা চিঠিতে লিখেছেন যে, তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর পর ভাইয়ের লেখা বেশ কয়েকটি কবিতা তিনি খুঁজে পেয়েছেন। নিজে খুব একটা কবিতা বোঝেন না বলে, খানিকটা উপযাচক হয়েই সেই কবিতাগুলি তিনি দেখান তাঁর কিছু বন্ধুকে, যাঁরা কবিতা পড়েন। সেই বন্ধুরা অবশ্য এ নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত, তাঁদের মতে কবিতাগুলি খুব উঁচু দরের, নতুনত্বে ভরপুর আর অবশ্যই প্রকাশযোগ্য।

গোড়ার দিকে নিতান্ত আলগোছেই হ্যারিস চোখ বোলাতে থাকেন কবিতাগুলোর ওপর। প্রথম কবিতাটা পড়েই কিন্তু মুগ্ধ হয়ে যান তিনি আর পরের লেখাটি তাঁকে যেন গ্রাস করতে থাকে। এমন কবিতার কথাই তো তিনি বলতে চেয়েছেন বারবার। আরও আরও কবিতা চেয়ে ইথেল ম্যালেকে চিঠি লেখেন হ্যারিস। ইথেল ম্যালে এইবার তাঁকে পাঠিয়ে দেন পুরো পাণ্ডুলিপিটি। পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে হ্যারিসের মনে হয়, তিনি যেন খোঁজ পেয়েছেন এক এল ডোরাডোর, অস্ট্রেলিয়ার কবিতা বুঝি এই এতদিনে পা দিল সাবালকত্বে।

বিশ শতকের প্রথম অর্ধে অস্ট্রেলীয় কবিতা ছিল প্রথাগত আর আদর্শায়িত। শান্তি, স্বাধীনতা এবং সামাজিক ন্যায়ের সঙ্গে বাস্তবতার মিশেল। অথচ সেই সময় পৃথিবী জুড়ে কবিতার মধ্যে যে বদল ঘটছিল, তা থেকে অনেক দূরে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল অস্ট্রেলীয় কবিতা। এই প্রধান ধারাকে অস্বীকার করে নতুন যে প্রজন্ম কবিতা লিখতে চাইছিল, তারা ক্রমশ জড়ো হচ্ছিল ম্যাক্স হ্যারিসের চারপাশে।

ম্যাক্স হ্যারিসের জন্ম ১৯২১ সালে। ১৮ বছর বয়সেই কবি হিসেবে এবং একই সঙ্গে কিছুটা নৈরাজ্যবাদী হিসেবেও হ্যারিস বেশ খ্যাতি পেতে থাকেন। ফরাসি প্রতীকবাদ বা সেই সময়ে নবাগত অধিবাস্তববাদকে কবিতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়, সে পথে হ্যারিসের ভূমিকা উজ্জ্বলতর হতে থাকে। হ্যারিস আর তাঁর অনুগামীরা ১৯৪০ সালে অ্যাডিলেডে শুরু করেন ‘অ্যাংরি পেঙ্গুইন’ নামে একটি কাগজ। প্রথম থেকেই অস্ট্রেলীয় কবিতাজগতে সাড়া ফেলে দেয় এই কাগজ আর এর ফলে কাব্যজগৎ দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে প্রথাগত কবিতার ধারা, অন্যদিকে আধুনিকতর কবিতার চর্চা। সব দেশে সব ভাষার ক্ষেত্রেই যা হয়ে থাকে, তার ব্যত্যয় ঘটল না এখানেও। নতুন কবিতার ধারাকে ‘দুর্বোধ্য’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলতে থাকল প্রথাগত বাস্তববাদী সমর্থকদের দিক থেকে।

আর্ন ম্যালে-র পাণ্ডুলিপিতে এই অধিবাস্তববাদ আর প্রতীকবাদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ দেখতে পেলেন হ্যারিস। আর সেটাকেই অস্ট্রেলিয়ার কাব্যরসিকদের সামনে আনার জন্য ‘অ্যাংরি পেঙ্গুইন’-এর ১৯৪৪ সালের শরৎ সংখ্যায় আর্ন ম্যালে-র পুরো পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ করলেন। পত্রিকার প্রচ্ছদে লেখা হল: ‘1944 Autumn Number to Commemorate the Australian Poet Ern Malley’। বড়ো করে রইল সিডনি নোলান-এর আঁকা ‘The Sole Arabian Tree’, পাশে উদ্ধৃত হল ম্যালে-র কবিতার কয়েকটি পঙ্‌ক্তি: “I said to my love (who is living)/ Dear we shall never be the verb/ Perched on the sole Arabian Tree”। এই “সোল অ্যারাবিয়ান ট্রি” থেকে প্রভাবিত হয়েই সিডনি নোলান ছবিটি আঁকেন।

এই বিশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হলে হ্যারিস চেষ্টা করলেন অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় তো বটেই, এমনকি অন্যান্য দেশেও এটি ছড়িয়ে দিতে। নিজে এককপি কাগজ নিয়ে হাজির হলেন অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ব্রায়ান এলিয়টের কাছে। ব্রায়ান ছিলেন হ্যারিসের মাস্টারমশাই এবং এই নতুন ধারার সমর্থক। প্রথম কবিতা ‘Durer: Innsbruk, 1495’ পড়ামাত্রই ব্রায়ানের মনের ভিতর শুরু হল অস্বস্তি। তারপর প্রায় গিলে চললেন আর সব লেখা। বারবার পড়লেন। শেষপর্যন্ত তাঁর মনে হল এই লেখা আসলে হ্যারিসের নিজেরই, হ্যারিস হ্যাড রিটেন আর্ন ম্যালে অ্যাজ আ জোক এগেনস্ট হিমসেলফ: এতদিন ধরে হ্যারিস যে সব বোকামি করেছেন, এখন সজ্ঞানে সেগুলোকেই ব্যঙ্গ করছেন তিনি। যদিও এ কথা শোনামাত্র তা অস্বীকার করেন হ্যারিস। অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজ ‘অন ডিট’-এ ব্রায়ানের এই সন্দেহের কথা প্রকাশিত হল:

LOCAL LECTURER CRIES ‘HOAX’
IS MALLEY, MALLEY OR MALLEY, HARRIES

-OR WHO


ব্রায়ানের এই সন্দেহ দ্রুত আচ্ছন্ন করে ফেলল অস্ট্রেলিয়ার কাব্যজগৎকে। হ্যারিসও বিব্রত হলেন, কারণ সবাই মনে করছে আর্ন ম্যালে-র আড়ালে রয়েছেন হ্যারিস নিজেই। কিন্তু হ্যারিস তো জানেন আসল সত্য কী। এই আসল সত্য জনমানসের সামনে আনার ক্ষেত্রে একটাই উপায়, আর্ন ম্যালে সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য জোগাড় করে তাঁর পরিচয় উদ্‌ঘাটন করা। হ্যারিস যোগাযোগ করলেন ব্যানিসটার নামে এক প্রাইভেট ডিটেকটিভের সঙ্গে। চিঠির ঠিকানা অনুযায়ী ইথেল ম্যালে-র সঙ্গে দেখা করা এবং আর্ন ম্যালে সম্পর্কে তাঁর বিবৃতি নেওয়ার ভার দিলেন তাঁকে। কিছুদিন পর কিন্তু সেই ডিটেকটিভ জানালেন, ওই ঠিকানায় ইথেল ম্যালে বলে কেউ কোনোদিন থাকতেন না, এমনকি আর্ন ম্যালে বলেও কারোর কথা আশপাশের লোকজন বলতে পারেননি। বহু চেষ্টাতেও সেই দুই ভাইবোনের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া গেল না। ইতিমধ্যে কাব্যসমাজে নানা সন্দেহ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগল। বাধ্য হয়ে অ্যাংরি পেঙ্গুইন এর পক্ষ থেকে দুই সম্পাদক (ম্যাক্স হ্যারিস আর জন রিড) যৌথ বিবৃতি দিয়ে বললেন যে আর্ন ম্যালে যেই হোন, বা এই নামের আড়ালে যিনিই থাকুন তিনি খুবই শক্তিশালী কবি। অস্ট্রেলীয় কবিতার স্বার্থে উচিত তাঁর পরিচয় প্রকাশ করার। কিন্তু একজনকেও পাওয়া গেল না যিনি এ বিষয় সামান্য আলোকপাত করতে পারেন।


আলোকপাত আর হবেই বা কী করে? গোটাটাই তো ছিল একটা লোকঠকানো মজার খেলা! আর্ন ম্যালে আর ইথেল ম্যালে নামে আদৌ কেউ থাকলে তবে না লোকে খুঁজে পাবে তাদের! আধুনিক কবিতা আসলে চমক ছাড়া আর কিছুই নয়, শুধু এই প্রতিপাদ্যটা প্রমাণ করার ঠেলায় অস্ট্রেলিয়ার আধুনিক কবিতাকে ঘিরে এক মধুর প্রতিশোধের খেলার ফাঁদ পেতেছিলেন সিডনির একেবারে গরিব, শ্রমজীবী সমাজ থেকে উঠে-আসা দুই প্রতিভাধর যুবক জেমস ম্যাকাউলে আর হ্যারল্ড স্টিউয়ার্ট। এঁরা দুজনেই প্রথমে বিখ্যাত ফোর্ট স্ট্রিট স্কুলে এবং পরে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং তারপর কবিতার নেশায় পেয়ে বসে তাঁদের। স্বভাবের দিক থেকে প্রায় বিপরীত এই দুজনের মধ্যে একমাত্র মিলের জায়গা ছিল কবিতার প্রতি অদম্য এই টান। প্রথম দিকে আধুনিক কবিতার সমর্থক হলেও কিছুদিনের মধ্যেই নতুন প্রজন্মের কবিদের কাব্যভাষার প্রতি বিরোধিতা তৈরি হয় এঁদের মনে। বিমূর্ততার নামে অস্পষ্টতা, গভীরতার নামে দুর্বোধ্যতা আর কবিতার নামে ধাঁধার খেলা চলছে আধুনিক কবিতায়—এই-ই ছিল তাঁদের মূল অভিযোগ। কিন্তু কবিতা নিয়ে মনের মধ্যে তৈরি হওয়া এইসব প্রশ্ন আর সন্দেহের কথা সুধীসমাজে পেশ করতে হলে চাই প্রমাণ। এই প্রমাণের তাগিদেই এক নিদারুণ খেলার চাল চাললেন এই দুজন। সিডনির কাছে অস্পষ্ট সেই সন্ধেবেলায় শেকসপিয়রের একটি রচনাসংগ্রহ, জমা জলে মশার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে লেখা একটি মামুলি ড্রেনেজ রিপোর্ট, একটা বাজারচলতি উদ্ধৃতিসংগ্রহ আর একটা জীবনবিজ্ঞানের টেক্সট বই—এইসব অবান্তর আর নিঃসম্পর্ক গুটিকয় ছড়ানোছিটোনো জিনিস থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় এই দুজন তৈরি করলেন ‘দ্য ডার্কেনিং এক্লিপটিক’ নামে একটি কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি আর বানিয়ে তুললেন কল্পিত কবিচরিত্র আর্ন ম্যালে আর তাঁর বোন ইথেল ম্যালেকে।

এর অভিঘাত এতটাই যে পরবর্তী কালে বহু প্রকাশকই বহুলচর্চিত আর্ন ম্যালে-র এই ‘দ্য ডার্কেনিং এক্লিপটিক’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেন। আর আশ্চর্যের বিষয়, ম্যাক্স হ্যারিসের ‘অ্যাংরি পেঙ্গুইন’ পত্রিকা যে এককালে আধুনিক অস্ট্রেলীয় কবিতার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করেছিল, সে কথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুলে গেল মানুষ। বরং পৃথিবীর কবিতার ইতিহাসে ‘অ্যাংরি পেঙ্গুইন’ স্মরণীয় হয়ে থাকল প্রথম ভুয়ো কবির কবিতা প্রকাশের জন্য।

তবে, এই ‘আর্ন ম্যালে রহস্য’ কীভাবে উন্মোচিত হল, সেই গল্প বলতে বসলে হুডানইট মার্কা একখানি থ্রিলারকেও হার মানাবে। সেই থ্রিলিং কাহিনি বলার জায়গা এটা নয়, সব নথিপত্র সাজিয়ে আর আর্ন ম্যালে-র কবিতাগুলোর বাংলা তরজমা নিয়ে একটি বই তৈরি করছি, সেখানে চেষ্টা করব খুঁটিনাটি সব বলার। না-কবিতা দিয়ে কবিতা গড়ে তোলার যে দুই কারিগর থেকেও নেই হয়ে ছিলেন, তাঁদের খুঁজে বের করতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল সেদিন, আপনারা নাহয় এটুকু অপেক্ষাই করলেন!

The Darkening Ecliptic
Ern Malley
ETT Imprint
Australia


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন