জয়িতা ভট্টাচার্য
ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্...
আওয়াজটা এগিয়ে আসছে।
মায়া পেছন ফিরে বাসন মাজছে কুয়োতলায়। আওয়াজটা তার চেনা। খর রোদ্দুর। বেশি বেলা হয়নি, মোটে এগারোটা, তবু গলা থেকে বুকের ভাঁজ বরাবর ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। রংচটা ব্লাউজের ওপরের বোতাম কবে ছিঁড়ে গেছে। ভারি বুক ভিজে গেছে, কোমরে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
সুনীল এসব দেখে উঠোনে বসে হাফায়।রেশনের চাল তেল সাবান বিস্কুট, চকখড়ির বৃত্তে দান উৎসব।
কাল থেকে ত্রিবর্ণ সঙ্ঘ এক প্যাকেট দুধ দিয়ে যাচ্ছে মায়ার জন্য।
উঠে দাঁড়াতে কষ্ট। ভারি পেট মায়া তবু ওঠে। আধমাজা বাসন রোদে পোড়ে।
বুকের কাপড়, কোমরের কষি আলগা, মায়া জল বাতাসা নিয়ে আসে। নিজেও গলায় ঢালে ঘটি থেকে অনেকটা জল।বড় তেষ্টা। ভাসুর ভাদ্দর বউ তফাতের দিন কবেই মুছে গেছে, যেমন সুনীলের মনেই পড়ে না স্পষ্ট করে এমন একটা খর দিনের কথা। ট্রাকের চাকায় পিষে দিয়েছিল ডান পা টা। একমাস হাসপাতালে থেকে অনেক দিন পর এক পায়ে কাঠের দণ্ডে ভর করে দুর্বল কোমরে ঘরে এসেছিল সুনীল।
সেই পা টার কথা মনে পড়ে। ওখানটা বিলকুল ফাঁকা। ইচ্ছে করে সেই হারানো পা টা একবার হাত বোলাতে। টুকরো টুকরো হয়ে পথে পড়ে থাকা তার পা।
গরম চাতালে জল ঢালে মায়া,
পেটেরটা আটমাস। বুঁচি, তার বড় মেয়েটা রান্না ঘরের সামনে চাল ধুচ্ছে। ছড় ছড় জল পড়ে নেবুগাছে। নেবু চুষতে ভালো লাগে আজকাল মায়ার।
মানুষটার ওপর রাগ হয়। দুবছর হলো এই গ্রামের পঁচিশটো লোক মিলে কোথায় যেন রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে চলে গেল, অনেক দূরে কী জানি কোথায়।
দিল্লি থেকে নাকি আরো সাত ঘন্টা।
গেলোবার এসে রাতে এমন দস্যিপনা করল সারারাত...মায়ার নাকের ডগায় ঘাম। -"কী দরকার আর, এট্টা মেয়ে আছে তো।" তা শুনলে তো! যেকদিন ছিলো তার হাড় মাস এক করে যাবার দিন, গালটা টিপে বলে গেল এসে ছেলের মুখ দেখব।
"দূর হ",
আলতো হেসে কাকে যে বলল মায়া, ওই পা পা করে ঘুরে বেড়ানো এক শালিখটাকে না রাতের স্মৃতি, নাকি মানুষটাকেই।
বাবলা গাছের একটু ছায়ায় কটা কাঠবিড়াল খুনসুটি করছে। শুনশান পথঘাট।
তা মানুষটা পারে বটে পরিশ্রম করতে।ছায়া দেখে অল্প উদাস হয়। কেমন আছে কে জানে। হদ্দ পাঁচ দিন ফুন নেই। যাবার আগে দাওয়ায় নতুন করে খড় ছাইলো একা হাতে।
তার জন্য কাচের চুড়ি, নতুন শাঁখা পলা এক জোড়, পাউডার, ভাস্করের হাতে কিচু টাকাও তো দে গ্যাচে। কত্তব্য কম্ম জানে খুব।
সুনীল ঘেমো ফতুয়াটা খুলে রাখে।
অনিলের কোনো খবর নেই। তবে একসঙ্গে আছে সবাই। একা তো নয়।
দেশে নাকি মারি লেগেছে।
সে দেশেও। কাল ক্লাবের ছেলেরা বলেছে সব দেশে সব কিচু বন্ধ। গাড়ি ঘোড়া কাজ কারবার সব। লকডাডাউন বলে তাকে।
তালি, অনিলরা ফিরবে কী করে। নাকি সেখেনে থাকবে।
দুপুর বাড়ে। খিদে পায়। ঘরের সামনে মাচা করে পুঁই, লাউ ডগা চরবড়িয়ে বাড়ছে ডগমগে যুবতীর মতো।
লঙ্কা, কটা ঝিঙে আর কুমড়োর গাছ। ওরা সুনীলের পরিবার। চালে ডালে রোজ দুটো একটা গাছের সবজি তো জুটছে।
মনটা খচ্ খচ্ করে। বৌটা পোয়াতি, হাতে বেশি টাকা নেই। অনিলের খবর পাওয়া যায় না।
পুকুর ঘাটে আধজলে মায়া। রোদ উঠেছে টকটকে। ব্লাউজ খুলে দেয়, জলে আরেক ধাপ নেমে গায়ের কাপড়, সায়া। নগ্ন পেটের ওপর ঠাণ্ডা জল, মানুষটা কবে ফিরবে কে জানে।
একডুব, দুইডুব, তিন ডুব, মনে মনে বলে ঠাকুর গো, মানুষটার মান রেখো একটা ছেলে দিও।
ক্ষিদে পাচ্ছে সুনীলের। ভিজে চুল থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে, খালি গায়ে ভিজে কাপড়, স্পষ্ট করে সব সাজানো। সুনীল অন্ধ হয়ে থাকে।
একটু গড়িয়ে নিতেই সন্ধ্যা এসে যায়।
অন্ধকারে প্রদীপ জ্বেলে শাঁখ বাজায় মায়া। কাচা কাপড়। মোটা করে সিঁদুর।গায়ে, গলায়, বগলে পাউডার। ধূপ আর পাউডারের গন্ধ মিশে যায়।
চা দোকানের পাশের ঘরে টিভি। কত পুলিশ। সব বন্ধ। গাড়ি ট্রেন সব। ওই যে পথে লাইন করে ওরা কারা। মাথায় বস্তা নিয়ে হাঁটছে দলে দলে ওরা। সুনীল পাছা ঘষটে এগিয়ে যায়। প্রাণপন খোঁজে। ওখানেই আছে অনিল। হ্যাঁ,ওরা নাকি হেঁটে হেঁটে ফিরছে যে যার বাড়ি। কাজ গেছে। খাওয়া থাকার জায়গা নেই। কত লোক, মেয়ে মদ্দ শিশু সব লাইন করে।
পুলিশ লাঠিপেটা করছে। তুলে দিচ্ছে ট্রাকে, কেউ উঠতে পারছে কেউ পড়ে যাচ্ছে। রেল লাইন ধরেও কত লোক।
ওখানেই অনিল আছে কোথাও। পাড়ায় সবাই দোর দিয়েছে। কেউ নেই।
মায়ার হয়েছে জ্বালা। একঠেঙে মানুষটা কোথায় পড়ে মরবে, এখনো এলো না, বাইরে ঘুটঘুটে।
-"বলি এত রাত করে যে ফিরলে পড়ে মরলে তোমার ভাইকে কী জবাব দেব।"
টিকটিক করে ডেকে ওঠে টিকটিকিটা।
বুঁচি পুরোনো পড়া করে। ইস্কুল বন্ধ।
জ্যাঠার কাছে পড়ে অল্প বিস্তর।
রাত বাড়ে। বাইরে বিরাট কালো ছায়ার মতো রাত। ঝোপে ব্যাঙ ডাকছে। ওধারে পগাড় থেকে একটা গন্ধ। কিছু মরেছে বোধহয়। বাতাসে বোঁটকা গন্ধ।
দুজনে মুখোমুখি খায় চুপচাপ।
বলি বলি করে বলেই ফেলে মায়া,
-''লকডাডাউন কারে বলে দাবাবু, আজ বৈকালে মনসার মা এসেছিল। বলে গেল এখন সরকার লকডাডাউন করেচে সব বন্ধ। তোর মরদ আসবেনি আর একন"
-অনেকটা সময় ধরে ডাঁটা চিবোয় মাথা নীচু করে সুনীল। নিজেকে গুছিয়ে নেয়।গলা ঝাড়ে। একটু কাশে। পেঁচা ডাকে কর্কশ।
-হুম। একটু চিন্তা হচ্ছে মায়াবউ।লকডাডাউন মানে কেউ পথে বরোবেনা।কল কারখানা, দোকান সব বন্ধ।
-মানুষটা?
-সব ফিরছে।
-ওহ্। মায়া খুশি হয়ে যায়। ফিরছে তার মানুষটা।
সুনীল আর কিছু বলে না।
রাত বাড়ে। তোলা জলে বাসন ধুয়ে, আলো নিবিয়ে দেয়।
মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে খোঁড়া মানুষটা। মশার ধূপ জ্বালে।
বুঁচির পাশে তক্তপোশে শুয়ে পড়ে। পেটে হাত বোলায়। অন্ধকারে পেটটা উন্মুক্ত, উঁচু হয়ে উঠেছে। নড়ছে। ওই তো এধার ওধার। এই এক স্বর্গীয় আনন্দ।
ফিরছে বুঁচির বাপ তবে চিন্তা নেই আর।
ঘুমিয়ে পড়ে মায়া।
সুনীলের ঘুম আসে না। বিপদের গন্ধ। কিছু যেন হবে। পৃথিবীটা, তার ক্ষুদ্র পৃথিবীতে আবার কী যেন হবে। আশংকায় ঘুম আসে না।
দিনের পর দিন এধার ওধার থেকে লোক মরে শহরে। তাদের মফস্বলের বাজারেও নাকি।
খবরে বলে না অনিলের কথা। ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্...বিরামহীন সুনীল
সারাদিন বিডিও অফিস, পঞ্চায়েত অফিসে বসে থাকে।
কত রকম খবর ওড়ে গরম হাওয়ার সাথে, কত শুকনো পাতা ঝরে।
কত লোক নাকি গাড়ির নীচে চাপা পড়েছে।
বুকটা ধরাক করে ওঠে। না, ওরা বেহারের। ফের চাপা পড়ে কয়জনা ট্রেনের তলায়। কজন বাঙালিও।
মায়ার আজকাল আলস লাগে। শুতে ইচ্ছে করে। আটমাস হয়ে ঘুম পায়, ক্ষিদে লাগে খুব। ঘরে খাবার বাড়ন্ত। বিনি পয়সার মোটা চাল আর মটর ডাল, সঙ্গে উঠোনের লঙ্কা আর ঝিঙে। তাই খায় গোগ্রাসে।
কী যেন হয়েছে ভাসুরটার। কথা কয় না।চুপ করে বসে থাকে আকাশ পানে চেয়ে।
খুব ঝড় ওঠে সেদিন রাতে। ঘরে চুপ করে বসে দুটি প্রাণী। উঠোনে মর্ মর্ করে গাছটা উল্টে পড়ল। ঘর সাদা হয়ে কাছেই বাজ পড়ল।
একঠেঙে সুনীলকেই জড়িয়ে ধরে মায়াবউ, বুকের মধ্যে ধরফর।
আর তারপরেই পেট চাড়িয়ে ওঠে তীব্র বেদনা। দালানের ওপর ছাওয়া চালটা উড়ে গেছে ততক্ষণে।
সুনীলের একটা ঠ্যাং সচল হয়। মায়া গোঙায়। আঝোর বৃষ্টি বাইরে, নিকষ অন্ধকার। সুনীল বাইরে আসে।
-হা ভগবান, একি করলে দয়াময়,
-"একা যেওনি পড়ে যাবে ঘর থেকে" তবু ক্ষীণ কন্ঠ মায়ার।
রাত হলে সকাল তো হবেই। উঠোনে পড়ে আছে পেয়ারা গাছটা, সারি সারি মরা কাক,শালিখ,চড়ুই,
ভাঙা বাসা।
সে রাতে সুনীলের সঙ্গে এসেছিল মালা আর আরতি। যমে মানুষে টানাটানি, মায়াবউ একবার ককিয়ে ওঠে। তারপর সব চুপ। রাতভর বাইরে বসে কাঁদে সুনীল।
ব্লক অফিসে ডেকেছিল বারো দিন আগে।পরিযায়ী শ্রমিক যারা মারা গেছে ট্রেনের তলায় তাদের ছবি। একের পর এক ছবি।আর তারপর তের নম্বর ছবিটায় অদ্ভুত থেঁতলে যাওয়া শরীরে লাইনে নিথর অনিল। অনিল ঘড়াই। ঠিকাদারের সঙ্গে কাজে যাওয়া অনিল মিস্ত্রির নতুন উপাধি পরিযায়ী শ্রমিক।
সই সাবুদ। ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য মায়া ঘড়াই এর নাম লিখেছিল। কিন্তু তার হারানো পা টার মতো কথা হারিয়ে গেছিল। পাথরের মতো।
সুনীল আজও বলতে পারেনি।
ভোরবেলা জন্মেছে হারান।
ওই নামেই ডাকে। এখন হামা দেয় সে দাওয়া আলো করে।
মায়া সিঁদুর পরে। লাল টিপ। হারানের বাপ কাজ করে আনবে অনেক টাকা। ঘর পাকা হয়েছে তার পাঠানো টাকায়। সুনীল বলেছে। সেও তো কথা রেখেছে।
কেবল দুপুর বেলা পুকুর ঘাটে ফর্সা গাছের ডালে একটা কুবোপাখি টেড়িয়ে টেড়িয়ে দেখে, কী বলতে চায় যেন।
সারি সারি তালগাছ ছায়া ফেলে কালো জলে। হাওয়া দেয়। ঢেউ খেলে জলে।
মায়াবউ উদাস হয়ে যায়। বুকের আঁচল খসে যায়। মানুষটা সেই যে গেল আর তো এলোনি?