দোঁহা

বহুস্বর অথবা একটি রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের গল্প



সাগরিকা শূর

আলোচনার শুরুতেই মাননীয় পাঠকের প্র‍তি একটি সহৃদয় স্বীকারোক্তি, লেখক কোনো চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ, সমালোচক বা তাত্ত্বিক নয়, নেহাতই সাধারণ দর্শক, 'অনেক'এর মধ্যে এক এবং এই আলোচনাটিও কোনো ফিল্ম রিভিউ বা তাত্ত্বিক ভাষ্যপাঠ নয়; এ আলোচনাকে বরং এক আগ্রহী দর্শকের চলচ্চিত্রটিকে নেড়েঘেঁটে দেখবার একটি পাঠ হিসেবে গ্রহণ করাই শ্রেয়, তাতে পাঠকেরও সুবিধা, লেখকের তো বটেই।

চলচ্চিত্রের শুরু উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি পাবে যেখানে শুধুমাত্র উত্তর-পূর্ব ভারতীয় হওয়ার কারণে সুঁড়িখানায় আসা একাধিক আগন্তুককে হেনস্থার শিকার হতে হয় এমনকি হতে হয় গ্রেপ্তারও, যার মধ্যে অন্যতম এই চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আইডো, যে পেশায় একজন উঠতি বক্সার। এই হেনস্থার দৃশ্যটি থেকেই চলচ্চিত্রটিকে জাম্পকাট করে পরিচালক নিয়ে যান দিল্লির একটি বক্সিং সিলেকশন ম্যাচের দৃশ্যে যেখানে আইডোকে ম্যাচ খেলবার অনুমতি দেওয়া হয় না আবারও উত্তর উত্তর পূর্ব ভারতীয় হওয়ার কারণে এবং দিল্লির সিলেকশন বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী আইডো এবং তার কোচকে একাধিকবার তাদের জাতিগত অবস্থান স্মরণ করিয়ে দেন, এমনকি "চাইনিজ" ইত্যাদির মত বিভাজনমূলক কথাবার্তা বলতেও দ্বিধাবোধ করেন না - যদিও পরক্ষণেই "জোক, জোক" বলে তা ধামাচাপা দেওয়ার অক্ষম চেষ্টা করেন। কিন্তু এই আপাত ঠাট্টা ও উপহাস একটি গুরুতর পরিস্থিতির জন্ম দেয় যখন আইডোকে অন্যায্যভাবে বাদ দেওয়ার কারণে আইডো ও তার কোচ হরিয়ানার প্রতিনিধি গোপাকে নকআউট লেভেলেই হারিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।

 


পুরো চলচ্চিত্রটি উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের জাতিগত সমস্যাকেই নির্দেশ করে এবং আইডো ছাড়াও টাইগার সাঙ্গা, আইডোর বাবা, জনসন গ্রুপ আমন ওরফে যশুয়া এবং অবশ্যই উত্তর ভারত বা দিল্লি এক একটি চরিত্র হয়ে প্রতিভাত হয় যাদের প্রত্যেকেরই একটি নিজস্ব স্বর রয়েছে। একদিকে গত ৬০ বছর ধরে বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত টাইগার সাঙ্গাকে দিল্লির সঙ্গে সমঝোতাতে আসতে দেখা যায়; একটি পিস একোর্ড বা শান্তি চুক্তিতে সই করবার জন্য তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন এই রফার বিনিময়ে যে তিনি জনসন গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণে আনবেন এবং পরিবর্তে ভারতীয় পতাকা ও সংবিধানের ছাতার তলায় টাইগার সাঙ্গাই প্রশাসকের ভূমিকা পালন করবেন। অন্যদিকে আইডো তার জাতিগত সত্ত্বাকে ছাপিয়ে নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করবার জন্য দিল্লিতে গোপাকে হারাবার প্রস্তুতি নেয়। যদিও তার বাবা বারবারই তাকে একথা বোঝাবার চেষ্টা করে যে তারা ভারতীয় নয়, স্বাধীনতা ইস্তক জোর করে তাদের ভারতীয় বানাবার চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ চলচ্চিত্রের শুরুতেই বিভেদরেখাগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রতিটি মূল চরিত্র এক একটি বিভাজনের গল্প তুলে ধরে এবং চলচ্চিত্রের শেষ অব্দি গল্পগুলি সমান্তরালভাবে চলতে থাকে।

তবে জটিলতা ক্রমশ বাড়ে যখন কেন্দ্রের কাছে এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে 'জনসন গ্রুপ' নামে বিচ্ছিন্নতাবাদী দলটির অস্তিত্ব তাদেরই মস্তিষ্কপ্রসূত, টাইগার সাঙ্গাকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য যা একটি চাল হিসেবে কাজে লেগেছে এতগুলি বছর, কিন্তু বর্তমানে এই নাম ও অস্তিত্বকে কাজে লাগিয়ে অন্য কেউ বা কারা এই দলটি চালাচ্ছে এবং আদপেই বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিচ্ছে। এই সত্যটি অনুধাবনের পরই 'জনসন গ্রুপ'কে কেন্দ্র করে আমন (পুলিশের আন্ডারকভার এজেন্ট, যে একটি ক্যাফের মালিকের ছদ্মবেশে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে নিজেকে পরিচিত করে) ও তার ঊর্ধ্বতনের আদর্শগত ও কৌশলগত বিরোধ স্পষ্ট হয়; একদিকে আমন চায় টাইগার সাঙ্গা পরিচালিত অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের মতো জনসনদের সঙ্গেও কেন্দ্রের উচিত একটি আলোচনায় বসা, কারণ ভারতীয় সংবিধান সকলকেই তার নিজস্ব সমস্যা পেশ করবার অধিকার দেয়, অন্যদিকে আবরার ভাট তথা কেন্দ্রীয়মন্ত্রক শুধুই যে কোনোভাবে শান্তি চুক্তি সাক্ষরে আগ্রহী, জনসনদের সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। ছবিটির শেষ অব্দি আমন ও তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এই সংঘাত উত্তরোত্তর বেড়েছে, আবরারের নির্দেশে আমনের ফোন পর্যন্ত ট্যাপ করা শুরু হয়; একদিকে দিল্লি চায় যেনতেন-প্রকারেণ জনসনদের খতম করতে, অথচ আমনের উদ্দেশ্য প্রকৃত জনসনের ডেরা অব্দি পৌঁছে তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের হাতে তুলে দেওয়া। এই আদর্শগত টানাপোড়েনে যদিও শেষ অব্দি জয় হয় আমনেরই, জনসনকে হাজির করতে না পারলেও জনসনের অন্যতম অনুচর ওয়াঙ্গনোকে সে জীবন্ত গ্রেপ্তার করতে পারে, অন্যদিকে দিল্লির তরফে তাদেরই সাজানো জনসনকে হত্যা করে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী দলটিকে নিশ্চিহ্ন করার একটি অক্ষম প্রয়াস চোখে পড়ে।

 


কিন্তু ছবিটি শুধুই এই রাজনৈতিক দড়ি-টানাটানি, আগ্রাসনের নির্লজ্জ প্রচেষ্টার কথাই বলে না, বরং তার মাঝে সাধারণ মানুষ কীভাবে প্রতিমুহূর্তে ক্ষমতার বলিপ্রদত্ত হয় সেটিই এই ছবির অন্যতম উপজীব্য। প্রসঙ্গত, নিকো নামক বছর চোদ্দোর ছেলেটির উল্লেখ করতেই হয়, যে আদতেই 'ক্ষেতি' করতে চায়, কিন্তু জীবন যাকে বারবার সামিল করে নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ে। এভাবেই পাকেচক্রে সে একটি 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' দলের অংশ হয়ে পড়ে, বন্ধু তথা দাদা লিমোর হত্যা যাকে বাধ্য করে বিনা প্রশিক্ষণেই স্টেইনগান কাঁধে তুলে নিয়ে বিপ্লবের প্রথম সারিতে এসে লড়াই করতে, অথবা মায়ের বারণ সত্ত্বেও, পুলিশি অত্যাচারের পরও সে এই দ্রোহের বাইরে যেতে পারে না, বরং শেষ অব্দি ময়দানেই মৃত্যুবরণ করে। একটি সাধারণ কিশোর কীভাবে ধীরে ধীরে আরও এক 'জনসন' হয়ে উঠতে থাকে, এ ছবি যেন তারই গল্প।

যদিও ছবিটি শেষ হয় পপুলার বলিউডি কায়দায়, প্রায় একটি পূর্ণবৃত্তের মতো, যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী সমস্ত গোষ্ঠীর স্পর্ধাকে থামিয়ে দেওয়া গেছে, ওয়াঙ্গনো আত্মসমর্পণ করেছেন, আমনও তার কাজ সম্পূর্ণ করেছে। তবে এই সবকিছুকে ছাপিয়ে আমনের সংলাপকে উদ্ধৃত করেই বলতে হয়, বাকি সবাই যখন তাদের ব্যক্তিগত যুদ্ধে হেরে গেছে, একজনই শুধু জিতে যায়, তার নাম আইডো। হরিয়ানার গোপাকে চ্যালেঞ্জ ম্যাচে হারিয়ে আইডো শেষ অব্দি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবার সুযোগ পায়, যদিও ফাইনাল ম্যাচে জার্মানীকে হারিয়ে ভারতের হয়ে সোনা জয়ের পরও নিজেকে কতটা ভারতীয় মনে করা উচিত আইডোর এই দ্বিধা ছবিটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

 


চরিত্রচিত্রণ নিয়ে কথা বলতে গেলে একথা বলতেই হয় যে এই ছবিটির প্রায় প্রতিটি চরিত্রই 'টাইপ' বা শ্রেণী চরিত্র। আইডো উত্তর-পূর্ব ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের প্রতি উত্তর ভারতের বঞ্চনা, জাতিবিদ্বেষ ও হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি লড়াইয়ের নাম, অন্যদিকে জনসন গ্রুপ, ওয়াঙ্গনো ও তার অনুচরেরা স্বাধিকারের প্রতিনিধি, আবরার ও দিল্লির কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন ও রাষ্ট্রীয় হিংসার প্রতিভূ, অন্যদিকে আমন দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের মতো বিবেকের একটি স্বর। তবে এই প্রধান চরিত্রগুলির পাশাপাশি পরিচালক অনুভব সিনহা যে তুলনামূলক অপ্রধান চরিত্রগুলির প্রতিও সমান যত্নশীল তা সমস্ত ছবিতেই সুস্পষ্ট। পূর্বে আলোচিত নিকো চরিত্রটি দর্শকের মনে একটি অভিঘাত সৃষ্টি করতে বাধ্য, অন্যদিকে নিকোর মায়ের চরিত্রটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে যেমন একদিকে কোনোভাবেই চায় না তার ভাইপো লিমোর মতো নিকোও বিপ্লবীদের দলে ভিড়ে নিজের জীবন বিপন্ন করুক, সেজন্যই সে চাষবাস, নিজের গ্রাম ছেড়ে আমনের ক্যাফেতে কাজ করে, কারণ তার মনে হয় যে নিকোর কিছু হলে আমন তাকে রক্ষা করবে, অথচ সে তার ছেড়ে আসা সত্ত্বাকে ভুলতেও পারে না, ক্যাফেতে ঝাঁট দিতে দিতে সে চাষীদের গান গায়, নিকোর মৃত্যুর পর আমনকে দেখতে পেয়ে সে উগড়ে দেয় তার পুঞ্জিত ক্ষোভ, যন্ত্রণা। এবং এখানেই ছবিটি আর একের থাকে না, হয়ে ওঠে অনেকের, বহুস্বরের। মিখাইল বাখতিন(১৮৯৫-১৯৭৫)এর উপন্যাস সম্পর্কে বলা 'হেটারোগ্লসিয়া'র তত্ত্বটিকেই যেন এই ছবিটির প্রতিটি দৃশ্যই স্মরণ করিয়ে দেয় -

"There is no such thing as a "general language," a language that is spoken by a general voice, that may be divorced from a specific saying, which is charged with particular overtones."
- The Dialogic Imagination: Four Essays


স্বাধীনতা অর্জন ইস্তক জাতিগত সমস্যায় ভারতরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হয়েছে বারবার, একথা বলাই বাহুল্য। একাধিক সীমান্ত সমস্যার পাশাপাশি, সীমান্তের আভ্যন্তরীণ সমস্যাতেও ভারত জর্জরিত, কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্যা যাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সাংবিধানিক সার্বভৌমত্বের আড়ালে যে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে গেছে, তা হল নিজদেশে পরবাসী হওয়ার অনুভূতি। সেন্টার বা কেন্দ্র কীভাবে মার্জিনালাইজড বা প্রান্তিকীকরণ করে, 'অপর' করে দেয়, একথাই এই ছবিতে উঠে এসেছে একাধিকবার। আমনের প্রশ্নের উত্তরে ওয়াঙ্গনো তার স্বভাবসিদ্ধ বিচক্ষণ, শান্ত ভঙ্গিতে মানচিত্র নির্দেশ করে দেখিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের গলা বা 'চিকেন্স নেক'ই বাকি ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হওয়ায় কীভাবে দিনের পর দিন তাদের সম্বৎসরের পরিশ্রমে ফলানো ফল, শাকসব্জি আটকে থাকে এবং নষ্ট হয়। মাত্র ৭ সাত বছর বয়স থেকে স্কুল যাওয়ার পথে প্রতি ২০ মিটারে ভারতীয় সেনাদের তাদের দিকে প্রায় সন্ত্রাসবাদীর প্রতি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখার অনুভূতি কীভাবে নিজেদের প্রতি মুহূর্তে ভারতীয় হিসেবে ভাবার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় - এসবই উঠে এসেছে ছবিটিতে যা বারবার জাতিগত বৈষম্যের প্রতি সহমর্মিতার অভাব ও আগ্রাসনের রাজনীতিকেই নির্দেশ করে।

অভিনয়ের দিক দিয়ে প্রায় সকলেই নিজের সেরাটি দেবার চেষ্টা করেছেন। আমন তথা পুলিশের আন্ডারকভার এজেন্টের ভূমিকায় আয়ুষ্মান খুরানা যথাযথ নির্বাচন, আইডোর ভূমিকায় অ্যান্ড্রিয়া, আবরার ভাটের ভূমিকায় মনোজ পাহওয়া, আঞ্জইয়া বেলামকোন্ডার ভূমিকায় জে ডি চক্রবর্তী প্রত্যেকেই নিজস্ব পরিসরে সপ্রতিভ।

তবে এ ছবির সবচেয়ে শক্তিশালী উপকরণ বোধহয় এ ছবির সংলাপ যা মনোযোগী দর্শকের গভীরে অভিঘাতের জন্ম দেবেই। ছবির শুরুতেই দিল্লির নির্বাচকের উক্তি - "ডাইরেক্ট ফ্লাইট আ গেয়ি তুমহারে দিল্লি তক, দিমাক খারাব হো গ্যয়া হ্যায়" যে শ্লেষ বহন করে তা যেন প্রতিমুহূর্তে উত্তর-পূর্ব ভারতের অধিবাসীদের নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণের চ্যালেঞ্জেরই পরিচায়ক। অন্যদিকে ওয়াঙ্গনো যখন ভারতের মানচিত্রের দিকে নির্দেশ করে বলেন ভারতের আমজনতা মানচিত্রের ওপর থেকে রাজ্যের নামগুলি সরিয়ে নিলে নিজের রাজ্যকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারবে না, তখন আমনের মতো এ ছবির দর্শককেও স্তব্ধবাক হয়ে যেতে হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে বিরক্ত আমন যখন তার অগ্রজ আইপিএস বেলামকোন্ডাকে প্রশ্ন করে তারা আসলে 'শান্তি' নিয়ে ভাবিত নাকি 'শান্তি চুক্তি' এবং তার উত্তরে বেলামকোন্ডার অবলীলাক্রমে বলা 'শান্তি চুক্তি' রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে। এই কথোপকথনের রেশ ধরে বলা কথাগুলিই হয়তো এ ছবিটির সারকথা -

বেলামকোন্ডা : "পিস ইজ আ ডার্টি বিজনেস, অফিসার। মোস্টলি পিস কো কন্ট্রোল সে কনফিউজ করতে হ্যায় লোগ। সব কন্ট্রোল মে হোতা হ্যায় তো লাগতা হ্যায় পিস হ্যায়।"
আমন : "অর যব সব পিসফুল হো যাতা হ্যায় তো, আউট অফ কন্ট্রোল হো যাতা হ্যায়?"
বেলামকোন্ডা : "ইফ ইউ নোটিস, পিস কভি অ্যাচিভড নেহি হোতা, ভায়োলেন্স অ্যাচিভড হোতা হয়, পিস কে লিয়ে। সরি, কন্ট্রোলকে লিয়ে।"

'অনেক' ছবিটির আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ছবির মধ্যে, বিশেষত চরিত্রদের মাধ্যমে তুলে ধরা একাধিক ডাইকোটমি, বৈপরীত্য বা দ্বন্দ্ব। আমন থেকে শুরু করে আইডো প্রত্যেকেই এই দ্বন্দ্বের শিকার। আইডো প্রাথমিকভাবে বুঝতে পারে না তার বাবার পরামর্শ মতো নিজেকে ভারতীয় হিসেবে চিহ্নিত না করা উচিত নাকি ভারতকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেবার জন্য নিজেকে যোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে প্রমাণ করা উচিত। আমন বুঝতে পারে না আদৌ মানুষ শান্তি চায় কিনা, নাকি ওয়াঙ্গনোর কথা মতো শান্তিরক্ষার থেকে যুদ্ধই বেশি সহজ। ওয়াঙ্গনো বা টাইগার সাঙ্গাকেও কখনও নিজস্ব দ্বন্দ্বে দীর্ণ হতে দেখা যায়, এমনকি নিকোর মা এম্মাও বুঝতে পারে না তার গ্রামে ফিরে চাষবাসে মন দেওয়া উচিত নাকি নিকোর জীবন বাঁচাতে, নিজের জীবন বাঁচাতে ক্যাফেতে কাজ করে শহুরে নিরাপদ যাপনই বেছে নেওয়া উচিত। শুধুমাত্র নিকোর মধ্যে এ জাতীয় কোনো দ্বন্দ্ব বা বৈপরীত্য চোখে পড়ে না, আমনের তাকে আসাম গিয়ে টাকা রোজগার করে গাড়ি-বাড়ি করার পরামর্শে তাই তার অপাপবিদ্ধ কিশোরমন খুব সাধারণ অথচ তীব্র একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, যার উত্তর আমনের কাছেও নেই, হয়তো দর্শকের কাছেও না -
"তুমকো ক্ষেতি নেহি করনি, মুঝে গাড়ি নেহি খরিদনি। গলত হ্যায়?"

বহুস্বরের কথা বলবার একটি সৎ প্র‍য়াস দেখালেও 'চিকেন্স নেক', হিন্দি আগ্রাসন, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা বা 'শান্তি চুক্তি'জনিত সমস্যা ছাড়া উত্তর-পূর্ব ভারতের মৌলিক ও মূলগত সমস্যাগুলিকে, বিশেষত, আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থানজনিত সমস্যাগুলিকে এই ছবি যথেষ্টভাবে তুলে ধরতে কিঞ্চিৎ হলেও ব্যর্থ। সেদিক থেকে পরিচালকের আর একটু গভীর অনুধাবনের প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়। এছাড়াও ছবির শেষে বলিউডি ঢঙে একটি পূর্ণবৃত্তের আকারে ছবিটিকে শেষ করাও প্রচলিত মেলোড্রামার প্র‍তি পক্ষপাতিত্বকেই নির্দেশ করে যা হয়তো ছবিটির সিরিয়াসনেসকে সামান্য লঘু করেছে। তবে এ সমস্ত সমালোচনা পেরিয়েও একথা বলতেই হয় যে এই বিষয়ের ছবি বা ছবির প্রচেষ্টা ভারতীয় বায়োস্কোপে বিরল, সেদিক থেকে ছবিটি অবশ্যই একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ এবং সংখ্যায় কম হলেও জাতিগত সমস্যা ও ইনক্লুশান নিয়ে এই ছবি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উস্কে দিয়ে যায়। কোনটাকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদ' বলে দেগে দেওয়া যায় আর কোনটা অস্তিত্বরক্ষার লড়াই, কোনটা সার্বভৌমত্ব আর কোনটা রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন, কোনটা বিপ্লব আর কোনটা প্রাদেশিকতা এসবের মূলে গিয়ে দর্শকের চেতনাতে ছবিটি আঘাত হানে; ছবি শেষ হওয়ার পরও মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে এক প্রশ্ন "which side are you on", এবং এখানেই ছবিটির সার্থকতা।

পরিশেষে, 'আজাদী কা অমৃত মহোৎসব'এর মহিমায়, 'ঘর ঘর তিরঙ্গা'র আড়ালে, 'সারে জাঁহা সে আচ্ছা'র আবেগে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো যেন হারিয়ে না যায়। আমনের কথার সুর টেনেই বলতে হয়, "পাঁচ সাল মে স্রেফ একবার উনকি আওয়াজ শুনি যাতি হ্যায়। উনকি হার আওয়াজ শুননি পরেগি। উনকি হার তকলিফ কো মেহসুস করনা হোগা", তবেই 'বিবিধের মাঝে' 'মিলন মহান' খুঁজে পাওয়া সম্ভব।


চলচ্চিত্র. অনেক (হিন্দি, ২০২২)
পরিচালক. অনুভব সিনহা
সিনেমাটোগ্রাফি. ইভান মুলিগান
সম্পাদনা. যশ রামচন্দ্রানী
সংগীত. অনুরাগ সাইকিয়া
অভিনয়ে. আয়ুষ্মান খুরানা, আন্দ্রেয়া কেভিচুসা, কুমুদ মিশ্র, মনোজ পাওয়া, জেডি চক্রবর্তী প্রমুখ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন