দোঁহা

অশিক্ষার অস্ত্র বড় জ্যান্ত



                   [সুপ্রভাত। এই মুহূর্তের খবর অনুযায়ী রুশদিকে ভেন্টিলেশন থেকে বের করা হয়েছে, সকলের প্রার্থনায় তিনি কথাও বলছেন, এমনকি হালকা রসিকতাও করেছেন বলে জানা যাচ্ছে। সব শুভ হোক। দ্রুত সেরে উঠুন, রুশদি। 'দোঁহা'র তরফে এইটুকুই প্রার্থনা]


সব্যসাচী মজুমদার

১.
সেপিয়েন্স সভ্যতার বাল্য কালে যে সব ধর্ম মানে পলিটিক্যাল এজেন্ডা তৈরি হয়েছিল, শিল্পবিপ্লবের পর তাদের অস্তিত্বকে নিদারুণ মূল্যায়ন করেছিলেন আমাদের ভূখণ্ডের প্রাচীনতম মানুষেরা। একদম ঢাকাই কুট্টি স্টাইলে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ধর্মের অস্তিত্ব।

মনে করুন না, খ্রিষ্টান ধর্মান্তরকালীন ভারতের কথা। মিশনারিরা জঙ্গল দখল করার জন্য অস্ত্র বিজয়ের পর উপনিবেশের স্বাভাবিক স্বভাব হিসেবে ধর্ম বিজয় শুরু করল। টুডু, টিগগা, মাহাতো-রাও দল বেঁধে মাইকেল, সাইমন হতে শুরু করল বিনা বাক্যব্যয়ে। কোনও অসুবিধে নেই। দুই একটা চিৎকার হয়েছিল। হয়ই‌। কিন্তু আসল মজাটা লুকিয়ে ছিল সেখানে না।

এই জঙ্গলের মানুষগুলো বছরের ঠিক ততদিনই খ্রিষ্টান থাকতেন, খাবার দাবার ঠিকঠাক পাওয়া যেত না; তারপর ফসল উঠলে যে যার মতো মাতাল। অত্যন্ত আধুনিক এবং মজার একটা সমাধান বের করেছিলেন মানুষগুলো। সমবেত মনস্তত্ত্ব দিয়ে। তাঁদের আধুনিক ও প্রগতিশীল মনন, এই কাজটা করিয়ে নিয়েছিল। যতদিন নিজের নির্ভরতা নেই, ধর্মকে ব্যবহার করে খেয়ে টেয়ে একটু গান বাজনা করে নাও। তারপর সোনালী হাতছানি পেলেই বর্জ্যের মতো পরিত্যাগ করো ধর্ম মানে অপ্রাসঙ্গিকতাকে। শঠে শাঠ্যং আর কী!

যে কাজটা কয়েক শো বছর ধরে জঙ্গলের মানুষগুলো করে চলেছেন, আমাদের স্বতঃউদ্বাস্তু নাগরিক সভ্যতা সেখানে পৌঁছানোর সাহসই দেখাতে পারল না আজও। ধর্মকে অস্বীকার‌ করার সাহস দেখাতে পারল না রাজনীতি। তাই সলমন রুশদি বা গৌরি লংকেশ আক্রান্ত হলে আশ্চর্য হই না। বেদনা হয়।

 


২.
দেখুন, একটা সময়ের মধ্যে অনেকগুলো সময় থাকে। একসঙ্গে সমান্তরালভাবেই তারা জায়মান। যেমন, এই দুই হাজার বাইশেই বসে কেউ লিখছেন আঠেরোশো নব্বইয়ের মতো করে, কেউ উনিশ শো তিরিশ বা সত্তরের খাপেই বসিয়ে নিচ্ছেন তাঁর চিন্তা। আবার কেউ ভাবছেন নতুন ভাষার কথা এবং আপনারা সকলেই কিন্তু প্রতিবেশী।

রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রেও একই। ধর্ম তো তৈরি করা হল মূলতঃ কৃষিজীবী কৌমগুলিকে একত্রিত করে একটা স্হায়ী ও একমুখী ও নিরাপদ বসত গড়ে তুলতে। কেবল কৃষিজীবী কেন, যে কোনও পেশাজীবী কৌমই মূলতঃ পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ধর্ম তৈরি করল। এবং প্রবল বেগে মনস্তাত্ত্বিক ও অব্যবহিত পরে অস্ত্র উপনিবেশ গড়ে তুলতে মনোযোগী হল। অর্থাৎ একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। এবার ঘটনাটা হল শিল্প বিপ্লবের পর ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি বিবর্তিত হয়েছে। বলা ভালো, আরও বিস্তৃত হয়েছে। রাজনীতির উদ্দ্যেশ্যও বদলেছে। ধরণ‌ এবং পরিকাঠামোও। এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন আপনি ধর্মকে স্বীকার করে নিচ্ছেন, যে কোনও ধর্মকে, আপনি আসলে মধ্যযুগীয় সময় পর্ব থেকে বেরুতে পারেননি। আপনার যৌথ অবচেতন ঐ একজন ছুরি বাজের জন্ম দিয়েছে। যার শরীরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার রক্ত লেগে আছে।


৩.
তাহলে দায়ি কে?

'স্যাটানিক ভার্সেস' বা 'মিডনাইট চিলড্রেন' কার কার পাকা ধানে মই দিয়েছে, সেটা তো স্পষ্ট। যার ধানটি পাকা ও মই সহ্য করতে পারে না, তারই জ্বলছে ও জ্বলবে। আমার ও আপনার নেই বলেই তাই রাগ হচ্ছে। অশিক্ষার অস্ত্র সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। তাই তার বিরুদ্ধে মানুষের সবচাইতে নির্বোধ অভিব্যক্তি রাগ দেখান ছাড়া আর কীই-বা করার!

যা হোক, কী লিখেছেন আর কী লেখা উচিত ছিল, এ নিয়ে যে আদিমতম তর্কটি চলে, তাকে এখানে আবার টেনে আনাটা অপ্রাসঙ্গিক মনে করেই বলছি, আমাদের দেশেও তো এ হেন নমুনা কম নয়, তাহলে দায়ি কে?

আর কেউই নয়, ধর্মকে তথাকথিত প্রচলিত হাজার হাজার বছর ধরে অপ্রাসঙ্গিক ধর্মগুলোকে স্বীকার করে নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষেরা। বিস্মিত আতঙ্কে লক্ষ্য করি সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা তরুণেরাও ধর্মকে স্বীকার করে নিয়ে তবে সলমনের পক্ষে বা বিপক্ষে সওয়াল করছেন।

মৃত নক্ষত্রের টান কী ভয়াবহ!

৪.
এখন ধর্মহীন মানুষ বাঁচতে পারেন কিনা, এ তর্ক বহুকাল আগে আবুল ফজল বা সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক দিন তার সমাধান করে গেছেন। আরও অনেকেই, অনেকেই। আসল কথা হলো ঐ আদিম অর্জিত স্বভাবেই মানুষ সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ব্যতিত বাঁচতে পারে না। অবিরল নির্মাণ ও সংরক্ষণের কাজটি একই সঙ্গে করতে হয় তাকে। নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে গেলে তাকে এটা করতেই হয়। আর এই প্রক্রিয়াটাই হলো রাজনীতি। অত্যন্ত স্বার্থপর ও স্বতোৎসারিত একটি স্বভাব। মানুষ রাজনীতি ছাড়া বাঁচতে পারে না। একটি নির্দিষ্ট বা কিছু কিছু স্বার্থ মিললে তবেই কিছু জন মিলে একটা যৌথ খামার তৈরি করে।

রাজনীতি চলুক। পৃথিবীতে পাঁচশ কোটির বেশি মানুষ। অন্ততঃ পঞ্চাশ হাজার রকম রাজনীতির অস্তিত্ব থাকবেই। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ যদি মধ্য যুগের চিন্তাকে বহন করে চলেন, তবে যাঁরা 'স্বাধীনতা' শব্দটির মূল অর্থের কাছাকাছি নিজের জীবনকে নিয়ে যেতে চান, অন্ততঃ সেই রাজনীতি করেন, তাঁদের বড় মুশকিল। অশিক্ষার অস্ত্র বড় জ্যান্ত ও অনিরেপক্ষ।

 


৫.
কোপানো চলছেই। মানচিত্র নিরপেক্ষভাবে চলছে। ধর্ম ব্যাতিরেকেই চলছে। এই উপমহাদেশের খবরের পোর্টালগুলোর কমেন্ট সেকশন খুললেই আপনি চমকে উঠবেন। বারুদের স্তূপের ওপর এই উপমহাদেশ। নিউক্লিয়ার বোমের চেয়েও মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে তাকে সযত্নে লালন চলছে। যে কেউ, যে কোনও দিন তাকে ব্যবহার করলেই ফল ঘটবে মারাত্মক। চিনেরও কিন্তু এত শক্তি নেই। এরকম আত্মভুক, আত্মনাশী ক্ষমতা।

যা হোক, প্রসঙ্গে ফিরি, রাজনীতি চলুক। যোগ্যতমের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠাও। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বটা গুহাবাসীদের মতো কেন? দেখুন পৃথিবীতে মানুষ অনেক এগিয়ে গেছে। পুঁজিবাদ এখন অসুখ আর ওষুধ দুইই আপনাকে বিক্রি করছে এবং দুটোই আপনি কিনতে বাধ্য। আম্বানি বা ঐ স্তরের মানুষ কখনই চাইবে না আপনি দাঙ্গায় মরুন বা বোম ফেটে মরুন। এরা আপনাকে পণ্য কিনিয়ে মারবে। কিনতে কিনতে কিনতে আপনার জিভ বেরিয়ে গেলেও ছাড় নেই। কোলড্রিংক খাইয়ে আবার কেনাবে। এবার আপনার লড়াইটা শিক্ষার। কার পণ্য কতটা কিনবেন। কতটা কিনবেন না। এটা মেধার লড়াই। এবার আপনি কোথায় পড়ে থাকতে চাইছেন আপনার ব্যাপার। আপনি লড়াইটা সরাসরি লড়বেন না, অস্তিত্ব রক্ষার প্রাথমিক স্তরেই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন।

তবে মধ্যযুগকে প্রাধান্য দিলে একদিন কল্লা যাওয়ার আশংকা আছে। এই বাংলা ভাষার দেশেও।

 ৬.

প্রশ্নাতীতভাবে সলমন রুশদির ওপর আক্রমণের বিরোধীতা করি। পৃথিবীর যে কোনও বাক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপকে ঘৃণা করি এবং আজও তথাকথিত অপ্রাসঙ্গিক ধর্ম কেন্দ্রিক আলোচনাতে সময় নষ্ট করছেন পৃথিবীর অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মেধারা-এটাই হতাশার। ওদিকে এই ধনতন্ত্র নিজেকে অবিরত বিজ্ঞান ব্যবহারে বিবর্তিত করছে। নিজেই ঈশ্বর হয়ে উঠেছে প্রায়। আক্ষরিক অর্থেই। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

৭.
আমাদের আজীবনের স্যাটানিক ভার্সেস সলমন রুশদি জিন্দাবাদ...



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন