দোঁহা

জীবনে দ্বন্দ্বের রহস্য



সুকান্ত সেনগুপ্ত

দিনের পর রাত, রাতের পর দিনের মতো জীবনও আলো-অন্ধকার ও জ্ঞান-অজ্ঞানের রহস্যে ভরা। জ্ঞানের আলো জ্বলে উঠলে মনের অন্ধকার দূর হয়।আলোর অনুপস্থিতি মানেই অন্ধকার।যেখানে অন্ধকার আছে সেই স্থানটি আলো দিয়ে ভরে দেওয়া সম্ভব। যদিও আলোর সাথে সাথে সেখানে অন্ধকারও থাকে কিন্তু আলোর জ্যোতির প্রভাবের কারণে অন্ধকার বিলীন হয়ে যায়। ঠিক যেমন মানুষের জীবন থেকে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়ে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়। কিন্তু যদি সেই ব্যক্তি নিজের ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রন করতে না পারে, অহংকার জন্মায় তাহলে সে পূনরায় অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে যায়।তার জীবনের আলো নিভে যায়।

পক্ষান্তরে, যে স্থান আলোকময় সেখানে কোনো সময় অন্ধকার ছিল। অন্ধকারেই আলোর খোঁজ পাওয়া যায়। আলোর খোঁজ করতে গেলে অন্ধকারের প্রয়োজন। আলো দিয়ে আলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্ধকারকে আনতে গেলে আলোকে সরিয়ে দিতেই হবে।

যে স্থান আজকে ভরা মনে হচ্ছে সেই স্থান কোনদিন খালি ছিল। খালি স্থানকেই একমাত্র ভরা সম্ভব। সাদা চক দিয়ে একটি শুভ্র রেখা টানতে হলে একটি ব্ল্যাকবোর্ডের প্রয়োজন। সাদা বোর্ডের উপর সাদা রেখা এবং ব্ল্যাকবোর্ডের উপর কালো রেখা চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।আজকে যেটি বৃক্ষ সেটি একসময় নিশ্চয়ই বীজ ছিল। বীজ ব্যতীত বৃক্ষ জন্মানো সম্ভব নয়। আবার আজকে যা বীজ তার জন্ম বৃক্ষ থেকেই এবং পরবর্তীকালে সেও বৃক্ষে পরিণত হবে।

এই জীবনের ক্রমচক্র নদীর মতো প্রবাহমান নয়, আসলে তা সরোবরের মতো বর্তুলাকার। ঘড়ির পেন্ডুলাম যেমন এক বিন্দু থেকে যত বিপরীত বিন্দুর দিকে যেতে থাকে ততোই সে পূনরায় পূর্বের বিন্দুতে ফেরার জন্য গতি সঞ্চয় করতে থাকে। সে কারণেই আমাদের জীবন বারবার বিপরীত বিন্দুতে এসে উপনীত হয়। জীবন সরল রেখার মতো হলে পূণরায় বিপরীত বিন্দু থেকে সেই বিন্দুতে আসা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তা বর্তুলাকার হওয়ার কারণেই আমাদের জীবন বারবার বিপরীত বিন্দু থেকে ঘুরে প্রারম্ভিক বিন্দুতে চলে আসে। সে কারণে পথই আমাদের যত্রস্থল, পথই গন্তব্য, পথই আমাদের জীবন; যেটা প্রারম্ভিক বিন্দু সেটাই সীমা। যার শুরু বা শেষ নেই।

 শারীরিক দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে মনের দূরত্ব কমে যায়। আবার মনের দূরত্ব কমে গেলে শারীরিক দূরত্ব বেড়ে যায়। বিরহ (প্রিয়জনের সাথে বিচ্ছেদ) যত বাড়ে প্রেমের রস ততোই গাড় চটচটে হয়। কেউ দূরত্বে থাকলে তবেই তো সে কতটা আপন তার অনুভব হয়। দূরত্ব বাড়ার অর্থ বিচ্ছিন্ন নয়। তার সাথে দূরত্ব বাড়বে কিন্তু সঙ্গে তার প্রতি টানও বাড়বে। ঠিক যেমন রবারকে টেনে যত লম্বা করা হয় তারমধ্যে ততো টান জন্মায়। অস্থির কে ধরে রাখার জন্যও স্থির এর প্রয়োজন। যেভাবে পদ্মপাতায় জল ছলছল করে। অক্ষদণ্ডকে কেন্দ্র করে চাকা ঘোরে, সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবী ঘোরে। মিথ্যাকে টিকে থাকার জন্যও সত্যের সাহারা চাই।

আবার যা আনন্দ তা দুঃখেরই নামান্তর।কারণ দুঃখে পড়লেই আনন্দের খোঁজ হয়। আর যা দুঃখ তা আনন্দের পূর্তি বা অপূর্তি ছাড়া কিছুই নয়। কারণ আনন্দ পূর্তি হওয়ার সাথে সাথেই দুঃখের খোঁজ শুরু হয়। যে ছোট, তাকে ছোট দেখানোর জন্য তার পাশে বড়কে রাখা প্রয়োজন।আবার বড়কে ছোট দেখানোর জন্য তার পাশে আরও বড়কে রাখা প্রয়োজন। কম আর বেশির পরিভাষা হলো যেটা পেয়ে গেছি বা জেনে গেছি তা কম আর যা পাইনি বা জানি না তা বেশি। তাই যে সব কিছুকে জেনে ফেলেছে সে পূনরায় নির্বোধ হয়ে পড়ে। অপরপক্ষে নির্বুদ্ধিতার(নিজেকে খালি করা) মাধ্যমেই কোনকিছুকে জানা সম্ভব। কুৎসিতকে কুৎসিত দেখানোর জন্য তার পাশে একটি সুন্দর কে রাখা প্রয়োজন। আবার কুৎসিত না থাকলে সুন্দরের কোন কদর নেই। যার জীবনে অশান্তির অনুভব নেই সে শান্তি কি তার অনুভব করতে পারবে না। যে জীবনে শান্তিতে আছে মনে করছে সে শুধু অশান্তিকে ভুলে থাকার চেষ্টায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। যে নিজেকে অশান্ত মনে করছে সে শুধু শান্তির খোঁজ করে চলেছে। যার মন ভয়ে পরিপূর্ণ সেই অন্যের কাছে নিজের সাহসিকতা প্রমাণ করার চেষ্টা করে। যাকে কেউ এড়িয়ে যাচ্ছে সে তার দৃষ্টির মধ্যেই আছে।

শত্রু এবং মিত্রের ক্ষেত্রে বলতে গেলে জগতে শত্রুতা বলে কিছু না থাকলে মিত্রতাও থাকার কথা নয়। একজন মিত্রই তার মিত্রের সব থেকে বড় শত্রু হতে পারে। অপরপক্ষে শত্রুর সাথে শত্রুতা ভিতর ভিতর মিত্রতারই আভাস দেয়।কারণ একজন শত্রু তার প্রতিপক্ষের যতটা খবর রাখে মিত্রও ততোটা রাখেনা, একে অপরকে প্রতিদ্বন্দিতায় নামায়।প্রতিপক্ষের মৃত্যুতে শত্রু নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে, তাই তারাই সাধারণত আগে ফুল মালা নিয়ে তার বাড়িতে শোক জ্ঞাপন করতে যায়। শত্রু মারা গেলে সে আর কার কাছে নিজেকে বড় প্রমাণ করবে! পুরুষ ব্যতীত নারী তার জীবনে পূর্ণতা পায় না, মা হতে পারে না। আবার নারী না থাকলে পুরুষ তার পুরুষত্ব প্রমান করতে পারবে না, পিতা হতে পারে না।পুরুষের জন্ম নিতে গেলেও নারীর গর্ভে স্থান নিতে হয়।

আস্তিক ব্যক্তি বিশ্বাস করে ঈশ্বর আছে(সে ঈশ্বরকে জানে না, ঈশ্বর সম্বন্ধে তার কোন অনুভূতি নেই। সে শুধু বিশ্বাস করে)। কিন্তু তার বিশ্বাস নাস্তিকতারই ইঙ্গিত দেয়। তার বিশ্বাস এটাই প্রমাণ করে যে ঈশ্বর সম্বন্ধে তার সম্যক ধারণা নেই। কারণ যা সত্যিই আছে তা বিশ্বাস করার প্রয়োজন হয় না। তাই ঈশ্বর সম্বন্ধে তার বিশ্বাস এটাই ইঙ্গিত দেয় যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোথাও না কোথাও তার সংশয় রয়েছে। অপরপক্ষে নাস্তিক ব্যক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। অর্থাৎ তার কথায় কোথাও না কোথাও ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে সংশয় আছে। কারণ যা নেই তাকে অস্বীকার করার কোন প্রশ্নই আসে না। আবার যাকে সে জানেই না তাকে সে অস্বীকার করবে কি করে! তাই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার মধ্যেও তার ঈশ্বরকে জানার জিজ্ঞাসু মনোভাব রয়েছে এটাই ইঙ্গিত দেয়।(এমন একটা রহস্যজনক ফুল যেটা আস্তিক ব্যক্তি বা নাস্তিক ব্যক্তি কেউই দেখেনি কিন্তু আস্তিক ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে সেই ফুলের সুগন্ধ আছে। কিন্তু নাস্তিক ব্যক্তি তা বিশ্বাস করে না। কারণ সে সেই সুগন্ধ পাইনি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই ফুলের সৌন্দর্য ও তার সুগন্ধ কেমন সে সম্বন্ধে একমাত্র সেই বলতে পারবে যে সেই ফুলকে দেখেছে ও তার সুগন্ধ অনুভব করেছে।) যে ব্যক্তি তার সর্বস্ব বিলিয়ে আনন্দ পায় সে আর্থিক দিক থেকে গরীব হলেও মনের ধনী হয়ে যায়। আবার যে ব্যক্তি শুধু সঞ্চয় করে, সে যতই সঞ্চয় করুক তার মন গরিবই থেকে যায়। যে অজ্ঞানী তার কাছে জগৎ মিথ্যা বাকি সবকিছু সত্য। জ্ঞান অর্জন করে সে জ্ঞানী হয়। আবার যে জ্ঞানী সে জ্ঞানী হওয়ার চরম পর্যায়ে তার সব শিক্ষাই ব্যর্থ মনে হয় এবং সে পুনরায় নিজেকে অজ্ঞানী মনে করে। কিন্তু জ্ঞানী হয়েও নিজের অজ্ঞানতা স্বীকার করার কারণে তার জ্ঞানের দরজা সর্বদা খোলা থাকে।(যেমন একটি গর্তকে মাটি দিয়ে সম্পূর্নরূপে ভরাট করা মাত্রই সেখানে পূনরায় তার থেকেও বড় শূন্য স্থানের সৃষ্টি হয়, যেটি তার উপরের অংশ মহাশূন্য। আর যেটিকে মহাশূন্য বা খালি স্থান মনে হচ্ছে সেটিও প্রকৃতপক্ষে শূন্যস্থান নয়। কারণ সেই শূন্যস্থানে বাতাস আছে। সেই বাতাসের গন্ধ, শব্দ, আলো আছে। গ্রহ, তারা, নক্ষত্র সবকিছুই আছে।) তখন তার কাছে জগৎ সত্য বাকি সবকিছুই মিথ্যা। সে কামনা-বাসনা, মায়া মোহ, জন্ম-মৃত্যু, অহংকার এ সবকিছুর থেকে মুক্ত।

অসুস্থ হওয়ার জন্য সুস্থ শরীরের প্রয়োজন। এই কারণে শিশুরা এবং যারা বেশি শরীর সম্বন্ধে সচেতন তাদের চট করে রোগে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। ঠিক যেমন একটি সাদা কাগজে যেকোনো রঙ একফোঁটা ছিটিয়ে দিলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বয়স যত বাড়ে ততো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রবল হয়ে ওঠে। তাও একপ্রকার সুস্থতা। কিন্তু সেই সুস্থতা হলো সেই রকম যা একটি সাদা কাগজে বিভিন্ন রং সারা জীবন ধরে ছিটিয়ে দিলে সেই কাগজে আর রং শনাক্ত করার জায়গা থাকে না। সেটি একটি নোংরা কাগজে পরিণত হয়। বার্ধক্য অবস্থা হল এই ধরনের নোংরা কাগজ যাতে রোগ নামক রঙের ছিটা পড়ে পড়ে তা ভরাট হয়, পুরো কাগজটির উপযোগিতা নষ্ট হয়, ফলে শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসে। যা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার রূপ নেয়। সুস্থ ব্যক্তি রোগে পড়লে যতটা না কষ্ট পায় অসুস্থ ব্যক্তি রোগে পড়লে তার থেকে কম কষ্ট পায় কারণ অসুস্থ ব্যক্তির শারীরিক দুর্বলতার সাথে লড়ার ক্ষমতা থাকে। অর্থাৎ অসুস্থ হওয়ার জন্য যেমন সুস্থ শরীরের প্রয়োজন ঠিক তেমনি অসুস্থতাকে জয় করলেই সুস্থ থাকা যায়।

সুতরাং জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই একটির অস্তিত্ব বিপরীতটি ব্যতীত সম্ভব নয়।আমাদের জীবন এরকমই বিরোধাভাস পূর্ণ রহস্যে ভরা। প্রতিক্ষেত্রেই দ্বন্দ্ব এসে উপস্থিত হয় এবং তা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে জীবনের কোনো কিছুই ফেলে দেওয়ার নায়। একটি ব্যতীত বিপরীতটির কোনো অস্তিত্বই নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন