দোঁহা

ঘাসের রুটি

 


 অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

৩রা বৈশাখ। সাততলারও উপরে ফ্ল্যাট। চিকেনটা প্রায় রান্না হয়ে এসেছে। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। নিস্তব্ধতা। চিকেনের গন্ধ নাকে আসে প্রদীপের। আরেকটু কষলে পরেই রান্নাটা শেষ হয়ে যাবে। তারপর কড়াই থেকে নামিয়ে বাসনে ঢেলে রাখবে। ফ্রিজ থেকে বের করে আনবে বাডওয়াইজারের বোতল। রেডি-টু-ইট পরোটাগুলোকে সেঁকে নিতে হবে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেই কুইনস নেকলেস দেখা যায়। প্রজেক্টের ডেডলাইন শেষ হতে হতে এখনও হপ্তাদুই। লকডাউনের দাপটে সমস্তকিছুই যেন স্থির হয়ে রয়েছে। কাগজ পেনসিল নিয়ে বসতে ইচ্ছে করে না। তবুও প্রদীপ ছবি আঁকবে।

সৃষ্টি ব্যাপারটা ভারী সুন্দর, কমনীয়। প্রথম যখন ছবি আঁকতে শুরু করেছিল, প্রদীপের রাজহাঁস আঁকতে ভালো লাগত। জোরালো একেকটা স্ট্রোক। আর্ট ডিজাইনিংয়ে মাস্টার্স করার পর সোজা বাণিজ্যনগরীতে উড়ে আসা। এডিটিং টেবলের কাজ। ছুরি, কাঁচি, আঠার বোতল-ইত্যাদি সবকিছুই এখন অতীত। প্রদীপের মাধ্যমও এখন ডিজিটালে বদলিয়ে গিয়েছে। তবুও কাঠের ইজেল, নরম কাগজে মধ্যে মধ্যে সে এখনও রঙের গন্ধ পায়। সমস্ত শরীর জুড়ে সেই রঙের গন্ধকে অনুভব করে। সাততলা উপরকার বারান্দা থেকে তখন, সমস্ত শহরটাকে স্পর্শ করতে চেষ্টা করে, রাতবেরাতের আলো আঁধারি শহর।

...ওকে যে ভালো থাকতেই হবে। ডঃ কুলকার্নি ওকে তেমনটাই নির্দেশ দিয়েছেন। ড্রয়িং রুমে লাগানো সাইকোডেলিক এফেক্টের ঝলকানি আলোগুলোকে প্রদীপ খুলে ফেলেছে। ওর জীবনে এখন স্নিগ্ধতারই প্রয়োজন বেশী। শরীরের উত্তেজনাকে এখন ওর প্রশমিত করা উচিত...

বেল বাজল। একটু অবাক হলো প্রদীপ। এই সময়ে তো কারোর আসার নেই। কোভিড সময়ে বাইরের কারোরও এ্যাপার্টমেন্ট চত্বরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবুও যে দরজাটা খুলতেই হবে। প্রদীপের অস্বস্তি হচ্ছিল। ওর ঠিক নীচের তলাতেই ওয়াঘমারেদের ফ্ল্যাট। ভদ্রলোক দিন তিনেক হলো মারা গিয়েছেন। ডেল্টার কবলে পড়লে গুচ্ছ কোমর্বিডিটিকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই চলে না। পরিবারের বাকি দুজন সদস্যও কোভিডে শয্যাশায়ী। একজন হাসপাতালে। এ্যাপার্টমেন্টে এই নিয়ে মোট সাঁইত্রিশ জন। মৃত্যুর সংখ্যা তিন। প্রদীপের ভিতরে একটা চাপা আতঙ্ক কাজ করে। তাকে আতঙ্ক বলে স্বীকার করতেও ইচ্ছে করে না। অদ্ভুৎ এক মোচড়ানো অনুভূতি, ইংরেজিতে এ্যাভয়েড্যান্স। সবকিছু থেকেই একটা ভয়গ্রস্ত দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা। আবারও বেলটা বেজে উঠল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল প্রদীপ। মাংসটাকে সে একটু আগেই নামিয়ে টেবলের উপরে রেখে এসেছে।

দরোয়ান শ্রীবিলাস এক হাতে ফোন আর অন্য হাতে একটা খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। “উপরতলাকার ফ্ল্যাটে দিদিমণির খাবারের অর্ডার ছিল। উনি এখনও ফেরেননি। আপনাকে দিয়ে দিতে বলেছেন,” মাস্কের ওপার থেকে সে হাসল কিনা বোঝা গেল না। অবাক হলো প্রদীপ। কে এই মহিলা? তাকে তো সে চেনেই না। দেখেইনি কোনোদিন। হঠাৎ প্রদীপকেই বা তাঁর খাবার রাখতে হবে কেন? সে তীব্র আপত্তি জানালো। শ্রীবিলাস শুনলো না। বলল, “আপনি ফোনে কথা বলে নিন, উনি ফোন ধরে আছেন।” আপত্তি করতে গিয়েও থেমে গেল প্রদীপ। ফোনে কথা বললে বোধহয় খুব একটা অসুবিধে হবে না। মুখে মাস্কও রয়েছে তার। ফোন কানে দিতেই একটা মিষ্টি গলার স্বর ওপার থেকে ভেসে এল, “প্লিজ কিছু মনে করবেন না মিস্টার সেনগুপ্ত, আমি চিনি না আপনাকে। কিন্তু দেখুন আমি হাসপাতালে একটা ভীষণ জরুরি কাজে আটকে পড়েছি। পেশাগত ভাবে আমি ট্রেনি ইন্টার্ন এখানে, কাজের চাপ আপনি বুঝতেই পারছেন। একটু যদি আমার খাবারটা আপনি নিয়ে রাখেন। কথা দিচ্ছি আমি আধঘণ্টা-একঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছব। একটু যদি,” কি ভেবে জানি প্রদীপ রাজি হয়ে গেল। রাত হলেও এখনও হাতে কাজ রয়েছে তার। সে সম্মতি জানিয়ে ফোন কেটে দিল। হাত বাড়িয়ে শ্রীবিলাসের হাত থেকে সে প্যাকেটটা নিয়ে নিল। এখনও গরম রয়েছে। মাইক্রো-ওভেনে ঢুকিয়ে রাখাই ভালো। দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রদীপ ভিতরে এসে বসল। তার রুটি চিবতে ইচ্ছে হয়।

ঘাসের রুটি। সবজেটে রঙ। অল্প আটা মেশানো। ভারতবর্ষের খাবার। শাকসেদ্ধর সাথে। অমৃত বলে মনে হয়। দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটা সিরিজ আঁকবে সে। ‘এক দুজে কে লিয়ে’ নাট্যগোষ্ঠীর পরবর্তী প্রোডাকশন ‘পরিযায়ী কে মওত’, সেই থেকে মোটা টাকার বরাত আসবে। সেট ডিজাইন করে দিতে হবে। সঙ্গে ছবিও চাই। সৃষ্টির ভিতর দিয়েই প্রতিবাদের উদযাপন। প্রদীপের আবারও রাজহাঁস আঁকতে ইচ্ছে হয়। সাদা ক্যানভাসে, ঝকঝকে কালো রেখায়। জলের ওধারে, চাঁদের জ্যোৎস্নাতে, সমস্ত ছবিটুকুই আস্তে আস্তে নীল হয়ে ওঠে। জলরঙের কাজ। এসব কি ভাবছে সে? প্রদীপ মুখে চোখে জল দিয়ে আসে। রাজহাঁসটা যেন ওকে গিলে ফেলতে চেষ্টা করছে।

রাত বাড়ছে। বেল বেজে উঠল ফের। দরজা খুলতেই প্রদীপ যাকে চোখের সামনে দেখল, সেই মেয়েটিকে অনায়াসেই সুশ্রী বলা চলে। এর আগেও লিফটে দুচারবার মেয়েটিকে সে দেখেওছে। কথা বলেনি কখনও। বেশ বুঝল মেয়েটি হাসপাতাল থেকে ফিরে একেবারে ফ্রেশ হয়েই নীচে নেমেছে। মাথার চুল অল্প ভেজা, পরনে ঘরের পোশাক। স্নিগ্ধতা। ডঃ কুলকার্নির উপদেশগুলোকে মনে পড়ল প্রদীপের। সে তাড়াতাড়ি দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, “ওহ আপনি, হ্যাঁ ভিতরে আসুন কাইন্ডলি। আমি খাবারগুলো এনে দিচ্ছি।” মেয়েটি ভিতরে ঢুকে এল, “আবারও যদি কিছু মনে না করেন, আমার আরেকটা অনুরোধ ছিল,” মেয়েটি বিব্রত মুখে প্রদীপের দিকে তাকায়। “হ্যাঁ নিশ্চয়ই, বলুন না,” প্রদীপ বলে ফেলে, “আপনার নামটা যদিও জানা নেই আমার।” মেয়েটি হাসে, “আমার নাম সুনিধি। সুনিধি মিত্র।” ‘আচ্ছা,” হাতজোড় করে নমস্কার করে প্রদীপ, “কিন্তু আপনার অনুরোধটা?” “আমার ঘরের মেন ফিউজটা উড়ে গেল হঠাৎ। এত রাত্তিরে স্পেয়ার্সও নেই। দরোয়ানকে ফোন করলাম, সেও বলল কাল সকালের আগে কিছুই করা যাবে না। ডিনারটা যদি এখানেই,” “ওহ সিওর,” প্রদীপ এতেও আপত্তি করার কোনও কারণ দেখে না, “আমারও ডিনার বাকি। বলেন তো একসঙ্গেই খাওয়া যেতে পারে।” “সেকি! আপনি কি আমার আসার কথা ভেবে না খেয়ে বসেছিলেন নাকি?” মেয়েটির গলায় আবারও চাপা হাসির ছোঁয়াচ। প্রদীপ কিছু বলে না। কেবল হালকা ভাবে সেও হেসে তাকায়। ক্যানভাসের উপরে রাজহাঁসের আউটলাইন। পিছনের আকাশে রঙ দেওয়া হয়নি এখনও। সাদা কাগজের উপর সামান্য কালির আঁচড়। প্রদীপ খাবার সাজাতে হবে বলে কিচেনে গিয়ে ঢুকল।

“আপনি বুঝি ছবি আঁকেন?” দুহাতে দুটো প্লেট নিয়ে প্রদীপ ঘরে ঢুকছিল। মেয়েটি জিজ্ঞেস করে হঠাৎ। “ওই আর কি,” প্লেটদুটোকে নামিয়ে রাখতে রাখতে প্রদীপ জবাব দেয়, “হাতে করে আজকাল আর আঁকা হয় না তেমন। কিন্তু পেশাগত ভাবে আমি একজন আর্ট ডিজাইনার। কাজেই মাধ্যম যাই হোক না কেন, ছবি বা সৃষ্টিতে আমাকে থাকতেই হয়।” “খুব সুন্দর করে বললেন তো,” সুনিধি বলে ওঠে, “আচ্ছা, যদি আপত্তি না থাকে আমিও হাত লাগাই প্লিজ? আপনি একা একা টেবল সাজাবেন এটা ভালো লাগছে না।”

এমন ভাবে দুজন মানুষের মধ্যে আলাপ জমে ওঠে। অথবা এমন আলাপ হয়তো বাস্তব জীবনে কাল্পনিক।

প্রদীপ আর সুনিধি খেতে বসেছে। টেবলের উপরে সাজানো প্লেট। প্রদীপ রিমোট ঘুরিয়ে টিভিটা চালিয়ে দেয়। “একটা কথা জিজ্ঞেস করব?” প্রদীপ সুনিধিকে জিজ্ঞেস করে। “হ্যাঁ বলুন না,” সুনিধি নিজের প্লেটে খাবার সার্ভ করছিল। “আমি যদি একটু ড্রিঙ্কস নিই সাথে, আপনি কি মাইন্ড করবেন? বা, অন্যভাবে বলতে গেলে আমি কি আপনাকেও কোনও ড্রিঙ্কস অফার করতে পারি?” সুনিধি মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ে, “আমি এ্যালকোহল নিই না মিস্টার সেনগুপ্ত। তবে আপনি নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। এঞ্জয় ইওরসেলফ!” কাচের গেলাসে সোনালী বুদবুদ। ঝলমল করে ওঠে।

টিভিতে খবর পড়ছে। পায়ে হেঁটে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের খবর। একশো জনেরও উপর শ্রমিক এই মহানিষ্ক্রমণের পথে প্রাণ হারিয়েছে। রেলট্র্যাকের উপরে ঘুমোতে গিয়ে ট্রেনের চাকার তলায় পিষে গিয়েছে একাধিক মানুষ। রেললাইনের উপরে রুটি ছড়িয়ে রয়েছে। প্রদীপ হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে। নিজের প্লেটে সে খাবার নেয়নি। সুনিধি চমকিয়ে উঠে হাত থেকে চামচ ফেলে দেয়।

-“মিস্টার সেনগুপ্ত,” অনেক দূর থেকে যেন একটা শব্দ ভেসে আসছে, “আপনার কি অসুবিধে হচ্ছে মিস্টার সেনগুপ্ত?” সুনিধির গলা এটা। প্রদীপ চিনতে পারে, “আপনার পালসটা একবার দেখতে দিন তো আমায়,” সুনিধির হাতের ভিতরে প্রদীপের হাত। পালসরিডিং নেওয়া হচ্ছে। সময় চলে যাচ্ছে। ‘পরিযায়ী কে মওত’। প্রদীপ যেন আকাশ থেকে আকাশে ভেসে বেড়ায়। সুনিধি ওর চোখেমুখে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে।

-“সরি, এক্সট্রিমলি সরি,” নড়েচড়ে বসতে চেষ্টা করে প্রদীপ, “আপনাকে এভাবে! আমি ঠিক আছি,” সে উঠে বসে।
-“ঠিক নেই আপনি। পালস অস্বাভাবিক গতিতে চলে গিয়েছিল। আপনার কি মেন্টাল স্ট্রেসের কোনও ইতিহাস আছে?”

প্রদীপ তাকিয়ে দেখল টিভিটা বন্ধ হয়ে গেছে। সুনিধি ওর সামনে বসে আছে। টেবলের উপরে না খাওয়া খাবার। প্রদীপের প্লেটে খাবার পড়েনি।

-“আপনি তো কিছুই খাচ্ছিলেন না, খিদে পায়নি আপনার?” সুনিধি আবারও জিজ্ঞেস করে।
-“আমার খিদে পায় না। আমার আজকাল আর খেতে ইচ্ছে করে না,” প্রদীপ শূন্য দৃষ্টিতে জবাব দেয়, “রোজ রাত্তিরে আমি রান্না করি। রোজ সকালে ওই ওপাশের ফুটপাথের উপর যে লোকগুলো বসে থাকে। তাদেরকে দিয়ে আসি। আজ ওরা নেই। ওরা চলে গেছে...” প্রদীপ কথাটা শেষ করতে পারে না। ঘরের আলোটা কেমন দপদপিয়ে ওঠে। ওরই মনের ভুল।

সাততলাকার উপরের বারান্দায় হাওয়া দিচ্ছে। কুইনস নেকলেস বা মেরিন ড্রাইভের উপর থেকে শোঁ শোঁ করে ছুটে আসছে আরব সাগরের বাতাস। সুনিধি মিত্র, প্রদীপ সেনগুপ্ত। পাশাপাশি দুজন দাঁড়িয়ে। মেয়েদের প্রতি প্রদীপ যে আকৃষ্ট ছিল না কখনও, তেমনটা নয়। কিন্তু কখনও ভালোবাসা না পাওয়ার কারণে বোধহয়, ওর ভিতরে কেমন যেন এক আড়ষ্টতা তৈরী হয়েছে। আলাদা করে আর সে কোনও আকর্ষণ বোধ করে না। সবটাই যেন নিয়মমাফিক, রোবট পৃথিবীর উন্মেষ। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে থাকতেই সে ভালোবাসে। সুনিধি মিত্র আত্মহত্যাপ্রবণ। এটা সে জানে। প্রদীপ জানে না। দুজন জটিল মনস্তত্ত্বের মানুষ, দুজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। ভিতরের সাউন্ড সিস্টেমে হালকা ভল্যুমে চাইকোভস্কির রেকর্ড বেজে চলেছে। পাশাপাশি মিলন, পাশাপাশি বৈপরীত্য। বিবিধের বিস্তৃতি এখন এই দেশে বেআব্রু হয়ে ফেটে পড়তে শুরু করেছে। ওকে বিবিধ বলে না। বৈপরীত্য বলে না। ওকে বলে বৈষম্য। প্রদীপ হিসহিস করে ওঠে। সুনিধি ওর হাতের উপরে হাত রাখে।

“আমিও যে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম,” সে বলে ওঠে হঠাৎ। প্রদীপ গা করে না।

“আজকের রিপোর্টটা আসার পর, আমিও চেয়েছিলাম নিজেকে শেষ করে দিতে।” সুনিধির মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি দুজনের কথোপকথন।

“আপনি কি চেনেন আমাকে, মিস্টার সেনগুপ্ত? আমার নাম সুনিধি। সুনিধি মিত্র। বয়স আঠাশ। পেডিয়াট্রিকস মেডিসিনে পিজি ডিপ্লোমা হোল্ডার। এখানকার হাসপাতালে ট্রেনি ইন্টার্ন, দুই বছরের চুক্তিতে। আপনি পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা ভাবছেন? আমি যে আমার ব্যক্তিগত সত্ত্বাটুকুকে ছেড়েই এখনও অবধি বেরুতে পারলাম না। আপনি কি আমায় স্বার্থপর বলবেন?”

“আমরা প্রত্যেকে নিজেদের গণ্ডিবদ্ধ জীবনে আবদ্ধ। কেউ কেউ বা আবার বাইরেটাকেই বড় করে দেখি। কেউ কেউ বা অন্তরেই থাকতে চাই। আমাকে ভালোবাসত পিজিডি ক্লাসের সহপাঠী উপেন্দ্র মিশ্র। কানপুরের বাসিন্দা। এখন মুম্বাইয়েরই অন্য একটি হাসপাতালে কাজ করছে। আমাদের ভালোবাসা অনেকদূর অবধি গড়ায়। শুরু থেকে সে বলে এসেছিল আমি ব্রাক্ষ্ণণ নই বলে তার পরিবারকে এই বিয়েতে রাজি করাতে নাকি সমস্যা হতে পারে। কিন্তু আমার জন্য সে জান কবুল করে লড়ে যাবে। সমাজ, পরিবার সবকিছুর বিরুদ্ধেই। এখন যখন মাতৃত্বের সুখ আমার দরজাতে এসে কড়া নাড়তে শুরু করেছে..." সুনিধি থেমে যায়, “আমি চেয়েছিলাম আজ একদম অচেনা অজানা একজন পুরুষের সঙ্গে আমার জীবনের শেষ রাতটুকু কাটাতে। মনে হয়েছিল আমার চেয়ে বড় দুঃখী কেউ নেই। হতে পারে না। কিন্তু যখন আপনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন, আপনার পালস দেখছিলাম, মনে হল জীবনকে শেষ করে দেওয়ার চাইতে জীবন ফিরিয়ে আনতে পারাটাই তো বড়ো সাফল্য আমাদের। আমার ভিতরকার যে প্রাণ, তার উপরে তো আমার অধিকার নেই। আমি, অতিরিক্ত অনুকম্পাকে ঘৃণা করতে শিখেছি। কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন বোধ হয় একটা ভারসাম্য প্রয়োজন। আমরা...” সুনিধি চুপ করে গেল।

অজস্র তারের জীবন। অজস্র তারের অনুরণন। প্রদীপের বুকের ভিতরটা কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। ড্রয়ার খুলে সে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ আর ওষুধের ভায়ালটাকে বের করে আনে। ছুঁড়ে ফেলে দেয় কুইনস নেকলেসের আকাশে। অন্ধকারে সেটা মিলিয়ে যায়। মৃত্যু, মৃত্যু এবং আরও মৃত্যুর খবর। দুটি জীবনের গল্প তখন ঝংকারের মতোই বেজে ওঠে হঠাৎ। চাইকোভস্কির রাজহাঁসের মতো...

উপসংহারঃ

অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ভেজা হাইওয়ের উপর দিয়ে একটা মিছিল হেঁটে চলেছে। তাদের হাতে কোনও পতাকা নেই। তাদের মুখে কোনও শ্লোগান নেই। তাদের মধ্যে একেকজনের পিঠে বাচ্চাদের পোঁটলা করে ঝোলানো রয়েছে। বৃষ্টিতে তাদের সমস্ত শরীর ভিজে গিয়েছে। তবুও তারা হাঁটছে। আরেকটু হেঁটে গেলেই মাথা গোঁজবার মতো একটা আশ্রয় পাওয়া যাবে। যদি না আরও আগেই কেউ বা সেটাকে দখল না করে নিয়ে থাকে।

মাটি ফুটিফাটা হয়ে গিয়েছে। গত বছরের অজন্মার দাপট এবারেও কমতে পারেনি। শুকনো ফাটলের ভিতর দিয়ে ধরিত্রী হাঁ করে রয়েছে। অনন্ত, অনন্ত নেমে গিয়েছে সেই ফাটলের মুখ। চওড়া অন্ধকার। গোরুগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। হাড় বেরিয়ে জিরজিরে হয়ে পড়েছে। পোড়া রেশনের আটার দানা মিশেছে ঘাসের রুটিতে। আধসেদ্ধ শাকের ঘ্রাণ।

দলিত ছাত্রকে পিটিয়ে খুন, দাঙ্গার ঘটনা মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে। কাঁদানে গ্যাস ও গুলিচালনার ঘটনা।

প্রদীপ এখনও ছবি আঁকছে। এখনও সে চাইকোভস্কির রাজহাঁস হয়ে উঠতে চায়। কেবল এখানে রাজকুমারী ওদেতের মৃত্যু নেই। রাজকুমার সিগফ্রেডও এই ছবিতে আত্মহত্যা করে না। সাদা ক্যানভাসে মূর্ত হয়ে ওঠে রাজহংসের প্রতীক। জ্যোৎস্নার জলে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রাত। প্রদীপ এর নাম দিয়েছে, ‘দ্য আদার সোয়ান’। এই ছবিতে দানবাকৃতি রাজহাঁসের পাশ দিয়েই সার বেঁধে জলে নেমে আসে পরিযায়ী শ্রমিকেরা, দলিতেরা, অজন্মায় বেহোঁশ হয়ে যাওয়া কৃষকেরা, জ্যোৎস্নাতে ধুয়ে যেতে যেতে তারা নেমে আসে। একপাশে শিল্প, আর অন্যপাশে চিরস্থায়ী সংগ্রাম। উদযাপন।

বৈশাখ পেরিয়ে আবারও বৈশাখ আসে। শেষ অবধি সেই জ্যোৎস্নাতেই সবকিছু মিশে যেতে থাকে বোধহয়। ফিলহারমনিক অর্কেষ্ট্রাতেও যেন বা সুর বেজে ওঠে। সুনিধি মিত্রও তার মাতৃত্বকে উপভোগ করে। একা একাই। সে আর প্রদীপ, দুজনে এখনও একই এ্যাপার্টমেন্টের প্রতিবেশী।

মধ্যে মধ্যে তাদেরও কথাবার্তা হয়...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন