দীপান্বিতা গাঙ্গুলী
সাল ১৯৫৮, মেঘনার চরে শ্যুটিং চলছে। তিমিরবরণ এবং নৌমন তাসিরের সুরে ভোরের আভাস ছড়িয়ে পড়ছে স্থির জলে...
"ভোর হুয়ে, ঘর আও মাঝি/ ভোর হুয়ে, ঘর আও.."।
খুব ধীর লয়ের গানটির মধ্যে এক অতীন্দ্রিয় বেদনার আকুতি আছে, শোনামাত্রই নদীর চরের কুয়াশায় মন হারিয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎই পুলিশ এসে এক কবি কে গ্রেফতার করলো, শ্যুটিং আপাতত বন্ধ। কবি মানুষটি যিনি কাউকে রেয়াত করতেন না, নিজের মতে চলতে ভালোবাসতেন। এই বিখ্যাত উর্দু কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজ অনেক যত্ন নিয়ে একটি বাংলা উপন্যাস পড়েছিলেন এবং যখন চিত্রনাট্য লেখার সময় আসে, তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পদ্মা নদীর মাঝি" কে এক অপূর্ব রূপ দান করেন। উপন্যাসটি এমনভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে যে দর্শক কিছু সময়ের জন্য সেই অতি দরিদ্র মানুষ গুলোর হার না মানা জীবনসংগ্রামের অংশীদার হয়ে যান। কালজয়ী কবির জন্মগ্রহণের ১১০ বছর পূর্ণ হয়ে গেল নিঃশব্দে, ১৯১১ সালে পাকিস্তানে ভূমিষ্ঠ হওয়া মানুষটি একাধারে কবি, আর্মি অফিসার, জার্নালিস্ট, শিক্ষক, ট্রেড ইউনিয়নিস্ট এবং ব্রডকাস্টার ছিলেন। সাতটি ভাষায় পারদর্শী কবিকে ১৯৬২ সালে লেনিন শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও প্রচুর পুরস্কারে তাঁর ঝুলি ভরা। ১৯৮৪ সালে ৭৩ বছর বয়সে লাহোরে দেহত্যাগ করেন, রেখে যান তাঁর গজল গুলি, বেশিরভাগই melancholic, এর বাংলা প্রতিশব্দ ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে একটু মুশকিল। কিছু ভীষণ প্রিয় পংক্তি আছে, বারবার শুনি...
কথা হচ্ছিল মেঘনা চরে শ্যুটিং-এর। IPTA-এর তৎকালীন সদস্য তৃপ্তি মিত্রের হস্তক্ষেপে কবি বাইরে এলেন, শ্যুটিং শুরু হল। পরিচালক এ জে করদার (A.J. Kardar) প্রথম জীবনে নাবিক ছিলেন। জল এবং জলের ধারের জীবন সম্পর্কে তাঁর স্বচ্ছ ধারণা। কিন্তু কোথাও একটা সুর কাটছে, কবি যে চিত্রনাট্য লিখেছেন, তিনি যা দেখাতে চাইছেন ঠিক তেমনটি ক্যামেরায় ফুটে উঠছে না। তিনি তলব করলেন বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান ওয়াল্টার লেসলি
(Walter Lassaly) কে।
Hindustan times লিখছে... "Walter lassaly, a German-born british cameraman caught the fantastic rural scenes with a kind of unforgettable magic. He used the Arriflex camera with superb dexterity to capture a set of rank amateur actors as they went about their mundane lives on the banks of Meghna. The style was true realism".
বস্তুত এটি পাকিস্তানে তৈরী প্রথম Neo- realistic সিনেমা এবং ৩২ তম আকাদেমী এওয়ার্ড বা অস্কারের বিদেশী ভাষাচিত্র বা foreign language কোটায় পাকিস্তানের প্রথম অন্তর্ভুক্তি। যদিও অস্কার পাওয়া হয়নি সিনেমাটির কিন্তু মস্কো Moscow এবং বস্টন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পায় দুটি সোনার মেডেল।
বাঙালি লেখকের উপন্যাস থেকে উর্দু কবির চিত্রনাট্যে সজ্জিত, পাকিস্তানি এবং বাঙালি অভিনেতা/অভিনেত্রী সম্বলিত, বাঙালি এবং পাকিস্তানি সুরকারের সুরে সেজে, পাকিস্তানে শ্যুটিং হওয়া এই কালজয়ী সিনেমা টি "The day shall dawn" বা "জাগো হুয়া সাবেরা" (Jaago hua savera) প্রথম মুক্তি পায় বাংলাদেশে, ১৯৫৯ সালে।
দেশভাগের পর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় অংশ লাহোর থেকে বম্বে চলে আসে, এখানে বলিউডের জয়যাত্রা শুরু তো হয়, কিন্তু এর যে সামান্য অংশটি লাহোরেই থেকে গেল, তার কি হল? সে না পেল ভাল গল্প, না ভালো অভিনেতা, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, প্রোডিউসার। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বম্বেতে বছরে যেখানে গড়ে ১৩০ টি সিনেমা তৈরি হতো, সেখানে পাকিস্তানে ২০ টিরও কম। কাজেই এই ফিল্মকে প্রথমেই পাকিস্তানে রিলিজ করানোর কথা ভাবা হয়নি।
দেশ বিদেশে তুমুল প্রশংসা পাবার পর সিনেমাটা একদিন গায়েব হয়ে গেল, আর তার প্রিন্ট খুঁজে পাওয়া যায় না। অবহেলায় অযত্নে এরকম একটা রত্ন শেষ হয়ে গেল।
কিন্তু নদীর চরের মানুষ গুলোর মতোই হার না-মানা জেদ ধরলেন নৌমন তাসিরের সুপুত্র আঞ্জুম তাসির। তিনি অনেক অনুসন্ধানে ফ্রান্স, লন্ডন এবং করাচি থেকে এর অরিজিনাল প্রিন্ট সংগ্রহ করে লন্ডনে restore করালেন এবং "Festival des three continents"- এ অংশগ্রহণ করেছিলেন।
২০১৬ সালে Cannes Film Festival-এ পুনরায় এটি দেখানো হয়, ফৈয়জ সাহেবের কন্যা, এখন লাহোরে থাকেন, বিখ্যাত লেখিকা সালিমা হাশমি এ প্রসঙ্গে বলেন বলেন..."My father was in jail, as part of the anti-communist crackdown by Pakistan's general Ayub khan when 'jaago hua savera' premiered in London."
বিখ্যাত ফিল্ম হিস্টোরিয়ান (Film historian) Marie seaton-এর বক্তব্য..."From east Pakistan has come a history making film, a most moving human document" এর কিছু অংশের শ্যুটিং চিটাগং-এর পাহাড়ে হয়, বাংলাদেশে এর রিলিজের ঠিক আগের দিন পাকিস্তানি জেনারেল আয়ূব খান প্রোডিউসারকে বলেন রিলিজ আটকে দিতে,কারণ চিত্রনাট্যকারের রাজনৈতিক ধ্যানধারণা তাঁর বিপরীত। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নির্দিষ্ট দিনেই রিলিজ করা হয়।
ক্যামেরাম্যান ওয়াল্টার লেসলি (Walter lassaly) বহু বছর পরে আরও একবার পাকিস্তানে এসেছিলেন "Blood of Hussain" সিনেমাটির শ্যুটিং করতে, স্মৃতি রোমন্থন করেছিলেন এই অপূর্ব সিনেমাটির। সত্যিই মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, উপন্যাস, সিনেমা দুটোই। হতদরিদ্র মানুষ গুলোর ছোট ছোট স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, চাহিদা, শোষণ, বঞ্চনা, আশা সব মিলিয়ে এক জীবনদর্শনের উপাখ্যান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অবশ্যই নদী, কখনো রক্ষক, কখনো ভক্ষক নদীরা আজন্মকাল ধরে নিজের বুকে বহন করেছে যে সভ্যতা তারই চলমান দৃশ্যপটে আঁকা কিছু স্থিরচিত্রের সমাহার।
'মাঝিচরিত' অত্যন্ত সুলিখিত, তথ্যসমৃদ্ধ একটি নিবন্ধ। সবচেয়ে বড় কথা পড়তে এত ভাললাগে! আর শেষ হওয়ার পরও মনে হয় বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল!
উত্তরমুছুন