দোঁহা

রাজা কংসনারায়ণ ও বাংলার দুর্গোৎসব



কৌশিক চক্রবর্ত্তী


আজ বলব এক দোর্দন্ডপ্রতাপ রাজার গল্প। বাংলার যে বারো ভুঁইয়ার হাঁকডাকে স্বয়ং শাহেনসা আকবর পর্যন্ত দাঁত ফোটাতে পারতেন না বঙ্গের আনাচেকানাচে, জাহাঙ্গীর তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাপতি মানসিংহকে পাঠিয়েছিলেন বঙ্গ দখলের জন্য, তাদের মধ্যেই একজন হলেন তিনি। রাজশাহী পরগনার তাহিরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ রায়। ধারে ও ভারে তখন তাঁর নামডাক সারা বাংলা জুড়ে। বাংলার মসনদে তখন পাঠান নবাব সুলেমান করনানী। এদিকে তাঁর সেনাপতি কালাপাহাড়ের অত্যাচারে অতিষ্ট সারা বাংলাবাসী। একে একে সে ধ্বংস করে চলেছে সমস্ত হিন্দু মন্দির। ধর্ম নষ্ট করছেন হিন্দু প্রজাদের। সব দেখেশুনে আর চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না কংসনারায়ণ। সোজা নালিশ জানালেন নবাবের দরবারে। কিন্তু হিন্দু রাজার আর্জিতে কর্ণপাত করছে কে? যথারীতি সুরাহা হল না কোনোমতেই। ছাড়বার পাত্র নয় রাজা কংসনারায়ণও। গোপন বৈঠকে বসলেন সিন্দুরীর জমিদার কালীদাস রায়, সাঁতোরের গদাধর সান্যাল, দিনাজপুরের গোপীকান্ত রায়ের সাথে। রুদ্ধদ্বার সেই বৈঠকে সেদিন ঠিক হল পাঠান উৎখাতের ব্লু প্রিন্ট। এরপর জমিদার কংসনারায়ণ নিজে উপস্থিত হলেন একেবারে আগ্রায়। সম্রাট আকবরের কাছে পেশ করলেন পাঠান শাসিত বাংলার দুরবস্থার কথা। একে একে তুলে আনলেন হিন্দু-মুসলিম অনৈক্যের পরিবেশ ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির ঘটনা থেকে করনানী-কালাপাহাড়ের সমস্ত উৎপীড়নের কথা। সেদিন বাদশাকে নিজের বাকচাতুরতা দিয়ে মুগ্ধ করলেন বাঙালী যুবক কংসনারায়ণ। বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ তুলে ধরে বাদশাকে পাঠান অত্যাচারের সমস্ত কাহিনী বর্ণনা করলেন তিনি। সুবক্তা ও ঝকঝকে বাঙালী যুবক কংসনারায়ণের প্রভাবে রীতিমতো আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন তামাম ভারত ভূখণ্ডের একছত্র অধিপতি জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবর। বাংলার করুণ অবস্থার কথা তাঁর চোখের সামনে ফুটে উঠলো। সেইদিনই রাজশাহীর এক সামান্য জমিদার কংসনারায়ণকে পাঠানমুক্ত এক নতুন বাংলার আশ্বাস দিয়ে বসলেন সম্রাট। বাংলার বিপন্ন মানুষ জানতেও পারল না যে তাদের স্বার্থে জমিদার কংসনারায়ণ কিভাবে এক এক করে সাজিয়ে চলেছেন দাবার ঘুঁটি। আগ্রাতেও রাজদরবারে নিজের বাকচাতুরতা দিয়ে সকলের নজর কেড়ে নিতে এতটুকু সময় লাগেনি কংসনারায়ণের। তিনি বাংলার স্বার্থে সেদিন পাঠান নবাবের সরাসরি বিরোধিতা করে শাহেনসাকে নালিশ জানাতে বিন্দুমাত্র ভাবেন নি। নিজের পরগনাটুকু নয়, তাঁর চোখে লেগেছিল এক স্বাধীন ও সম্প্রীতির বাংলার স্বপ্ন। অত্যাচারী কালাপাহাড়ের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছিল তাঁর অবাধ ছুটে চলা।

কালাপাহাড়। ওরফে কালাচাঁদ রায়। আসলে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হয়েও অবাধে নষ্ট করেছেন বাংলা ও উড়িষ্যার অসংখ্য দেবদেউল। এমনকি হানা দিতে ছাড়েননি পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে কোনার্কের সূর্যমন্দির পর্যন্ত। নবাব সুলেমান করনানীর জামাই এই কালাপাহাড়ের অত্যাচার কাহিনী যতই বলা যায়, ততই যেন কম পড়ে যায়। নবাবের কন্যাকে বিয়ের সূত্রে তার মুসলিম ধর্ম গ্রহণ। আর তারপরেই সরাসরি হিন্দুবিদ্বেষ প্রদর্শন। কোথা থেকে এলো তার হিন্দু সনাতন সমাজের প্রতি এত ক্ষোভ? সে আলোচনা তোলা থাক অন্য কোনো ধারাবাহিকে। এখন ফিরে আসি নবাব সুলেমান, কালাপাহাড় ও কংসনারায়ণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তখন সুলেমানের রাজধানী ছোট্ট সবুজ গ্রাম তন্দা। পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যায় মহানন্দা। একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ে প্রাসাদ তৈরি করে ঝকঝকে নগরে পরিণত করেছেন আফগান সুলতান সুলেমান। তারই দরবারে দেওয়ানের পদে আসীন রয়েছেন কংসনারায়ণ। তরুণ কংসনারায়ণের দক্ষ জরিপ বিদ্যা ও দেওয়ানির কাজ চারিদিকে প্রশংসিত। কিন্তু শুধুমাত্র নিজের চাকরি বাঁচানোর জন্য জমিদার কংসনারায়ণ আপোষ করবেন নিজের এস্টেটের সাথে, প্রজাদের সাথে, এমন মানুষ নন তিনি। কালাপাহাড় ও সুলেমানের বিরুদ্ধে বাদশা দরবারে নালিশ জানানোর আগে নির্দ্বিধায় জবাব দিলেন নবাবের চাকরিতে। নবাব সুলেমানও ঠিক আঁচ করতে পারেন নি এক সামান্য জমিদারের ক্ষমতার ব্যাপ্তিটা। যাই হোক, ছাড়বার পাত্র নন তাহিরপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার কংসনারায়ণও। আগ্রার দূর্গে পৌঁছে আকবর বাদশার আশ্বাস আদায় করে তবে ছাড়লেন তিনি। বাংলা তখন সম্পূর্ণ মুঘল শাসনাধীন ছিল না। পাঠান সুলতানের শাসনে বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক চেহারা তখন খুব অস্থির। বিচক্ষণ হিন্দু জমিদাররা সকলেই চিন্তা করছেন পাঠান রাজবংশ পতনের। তারমধ্যে বারো ভুঁইয়ার কথা আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়। বিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বিরের পাঠান বিরোধিতার কথাও এক্ষেত্রে স্মরণীয়। বাংলার জমিদারদের এই তীব্র বিরোধিতাই যে সুবে বাংলার আফগান পতন ও মুঘল সালতানাতে অন্তর্ভুক্তির কারণ তা সহজেই বলা যায়।

এভাবেই রাজা কংসনারায়ণও সরাসরি বিরোধ বাঁধিয়ে বসলেন সুলতানের সঙ্গে। পতন ঘটাতেই হবে কালাপাহাড়ের। বাংলায় ফেরাতেই হবে শান্তি। এদিকে অবস্থা বুঝে নিজের সৈন্যদের প্রস্তুত থাকতে বললেন আফগান নবাব। কিন্তু তখনই ঘটে গেল এক চরম বিপর্যয়। ১৫৭২ সালের ১১ই অক্টোবর দুই পুত্র বায়েজিদ খান ও দাউদ খানকে রেখে মৃত্যু হল সুলেমান করনানীর। তবে একটি দিনও ফাঁকা থাকেনি বাংলার নবাবের মসনদ। যদিও জীবদ্দশায় সুলেমান কখনও নিজস্ব মুদ্রা চালু করেন নি তাঁর সাম্রাজ্যে এবং সরাসরি সংঘাতেও যান নি মুঘল শাহেনসার সঙ্গে। কিন্তু কংসনারায়ণের মত আরও কিছু হিন্দু জমিদারের মিলিত ইচ্ছাশক্তি তাঁর মৃত্যুর পর বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি তাঁর সাম্রাজ্যকে। তাঁর পুত্র দাউদ খান করনানী মদনদে বসলে সরাসরি যুদ্ধ এসে হাজির হয় বাংলার দোরগোড়ায়। কংসনারায়ণও নিজের এস্টেটের সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন দাউদ খানের বিরুদ্ধে।
কালাপাহাড়ের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে আবার বঙ্গপ্রদেশকে মুঘল আয়ত্তে আনার এই সুযোগ হেলায় ছেড়ে দিতে চাইলেন না সম্রাট আকবরও। আব্বাজান হুমায়ুনকে তাড়িয়ে শেরশাহ যখন দিল্লী অধিকার নেয়, তখনই তাঁর আফগান সেনাপতি সুলেমান করনানী সুযোগ বুঝে বাংলা দখল করেন। তখন থেকেই তন্দায় রাজধানী সাজিয়ে বাংলা-বিহার দাপিয়ে শাসন করছেন তিনি। তাই বাংলা দখল নিতে গেলে যে কালাপাহাড়ের অত্যাচারে অতিষ্ট বাংলাবাসীর সামনে দাঁড়ানো আশু প্রয়োজন, সেই তাগিদ বুঝলেন শাহেনসা স্বয়ং। এদিকে একটার পর একটা দেবমন্দির ধ্বংস করছে কালাপাহাড় ওরফে কালাচাঁদ রায় ভাদুড়ী। বাঁ হাতে আঘাত করে ভেঙে ফেলছেন দেবমূর্তি। সেই আক্রোশ থেকে রক্ষা পান নি স্বয়ং পুরীর নীলমাধব জগন্নাথ, কামরূপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কামাখ্যা অথবা ভুবনেশ্বরের অসংখ্য দেবমন্দিরও। সব দেখেশুনে আর সহ্য হয় না বাংলার হিন্দু জমিদারবর্গের। ধর্মরক্ষা করে এস্টেট বাঁচিয়ে নির্বিঘ্নে জমিদারী করাই যেন দায় হয়ে উঠেছে। কংসনারায়ণ তাঁদের মধ্যেই অগ্রগণ্য। সকলে নেতৃস্থানীয় হতে পারেন না। কিন্তু কংসনারায়ণ পেরেছিলেন। তাঁর আর্জিতেই নড়েচড়ে বসল দিল্লীর মুঘল তখ্ত। এদিকে সুলেমানের মৃত্যুর পর বাংলার মসনদে তাঁর পুত্র দাউদ খান। তাঁর অত্যাচারও সুবিদিত। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে কালাপাহাড়ের মত জল্লাদ সিপাহসালার। হিন্দু সংস্কৃতি ও দেবালয় ধ্বংস করতে তার মত দক্ষ যেন ইতিহাসে বিরল। এরমধ্যেই মুঘল গভর্নর মুনিম খানকে শাহেনসা দায়িত্ব দেন দাউদকে শায়েস্তা করার। মুনিম খান রাজা টোডরমল ও রাজা মানসিংহকে সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দাউদ খানের উপর। নেপথ্যে হেসে ওঠেন কংসনারায়ণ সমেত অসংখ্য হিন্দু জমিদারবর্গ। কিন্তু কম যান না দাউদও। জামানিয়া, পাটনা ও আরও কয়েক জায়গায় তুমুল যুদ্ধের পরে রাজমহলে পর্যুদস্ত হন বাংলা বিহারের আফগান নবাব সুলেমান পুত্র দাউদ খান। কালাপাহাড়ের প্রতিরোধ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে মুঘল দক্ষ অশ্বারোহী বাহিনীর সামনে। দাউদ খানের পরাজয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন রাজশাহীর কংসনারায়ণ। বাংলা আবার ফিরে আসে মুঘল আধিপত্যের মধ্যে। বাংলার মানুষ তখন মনেপ্রাণে চেয়েছিল বাংলার সুবেদার হোক প্রজাহিতৈষী রাজা কংসনারায়ণই। সকলে একরকম ভেবেও রেখেছিলেন তাই। কারণ সম্রাট আকবরের সু'নজর সবসময়ই আদায় করে এসেছিলেন কংসনারায়ণ। কিন্তু ইতিহাস সেই ইচ্ছায় মান্যতা দিল না। দিল্লী থেকে অঢেল উপহার, 'রাজা' উপাধির সাথে কংসনারায়ণের জন্য এলো বাংলার দেওয়ানির ভার। কিন্তু সুবেদারীর দায়িত্ব এলো না তাঁর হাতে। শাহেনসাকে সেলাম জানিয়ে সব উপহার অতি বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়েও দিল কংসনারায়ণ। কিন্তু কখনোই চটালেন না বাদশাকে। রাজা টোডরমলের সঙ্গে থেকে সদ্য মুঘল অধিকারে আসা বাংলা প্রদেশের জরিপের কাজে মন দিলেন তিনি। আর বাংলা রক্ষা পেল কালাপাহাড়ের হাত থেকে। আজ যতটুকু প্রাচীন হিন্দুমন্দির ও স্থাপত্যগুলো অবশিষ্ট রয়ে গেছে, হয়ত তার উদ্যোগটুকু সেইযুগে মনের কোণে জন্ম নিয়েছিল রাজা কংসনারায়ণেরই।

রাজমহলের প্রান্তরে খান জাহান কুলীর নেতৃত্বে পাঠানদের শায়েস্তা করতে বাদশা আকবর প্রেরণ করলেন বিশাল মুঘল বাহিনী৷ বিপরীতেও প্রস্তুত দাউদ খান, কোতুল খাঁ (যাঁর নাম অনুসারে বাঁকুড়ার কোতুলপুর) ও কালাপাহাড়ের নেতৃত্বাধীন আফগান সৈন্য। কেউ কম যান না কোনোভাবে। এর আগেও বহুবার ইতিহাস দেখেছে পাঠান-মুঘল সংঘর্ষ। এবার লড়াইয়ের কেন্দ্র বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত ১৫৭৬ সালের ১২ই জুলাই বেশ কিছুদিনের যুদ্ধের পরে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হতে হল সুলেমানপুত্র আফগান নবাব দাউদ খানকে। সেই যুদ্ধেই তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে বাংলায় শেষ হল এক কলঙ্কিত রাজনৈতিক অধ্যায়।

কালাপাহাড়ের মৃত্যু ঘিরে প্রচুর মতান্তর আছে। কিন্তু দাউদ খানের মৃত্যুর পর যে পাঠান রাজবংশ বাংলা থেকে একেবারে উৎখাত হয়ে যায়, তার সাক্ষ্য ইতিহাস দেয়। কালাপাহাড়কেও আর পাওয়া যায় নি এরপর। এদিকে যুদ্ধে জিতে বাংলা বিহারের বিশাল এলাকা নিজের এলাকাভুক্ত করলেন বাদশা আকবর। যথারীতি ডাক পড়লো রাজা কংসনারায়ণের। টোডরমলের সঙ্গে বাংলার বিস্তীর্ণ জমি জরিপ ও দেওয়ানির কাজের সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হল তাঁর উপর। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে টোডরমলকে সহায়তা করে চলেছেন কংসনারায়ণ। সম্রাট আকবরও অগাধ ভরসা করেন কংসনারায়ণকে। সামান্য এক করদ জমিদার হয়েও রীতিমতো সমীহ আদায় করে নিয়েছেন তামাম হিন্দুস্থানের আলমপনা আকবরের থেকে। সাধে কি আর মুঘল বাদশা বাবর বাঙালী জমিদারদের দাপটে বিব্রত হয়ে রাগে বলে বসেছিলেন "এই বাঙালীদের আমি দেখে নেব"। যাই হোক, সব হচ্ছিল নির্বিঘ্নেই। কিন্তু হঠাৎ আগ্রার দরবার থেকে জরুরি তলব এলো রাজা টোডরমলের। বাংলা ছেড়ে তাঁকে ফিরে যেতে হবে আগ্রায়। কিন্তু তখনও নির্বিঘ্নে শেষ হয়নি বাংলার জমি মাপজোপ ও জরিপের কাজ। টোডরমলকে আশ্বাস দিলেন কংসনারায়ণ। শাহেনসার ডাকে নিশ্চিন্তে ফিরে যেতে বললেন তাঁকে এবং সমস্ত দেওয়ানির কাজ একাহাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার আশ্বাস দিলেন তিনি। বন্ধুরাজার আশ্বাস পেয়ে নিশ্চিন্তে আগ্রা ফিরে গেলেন টোডরমল। এদিকে কংসনারায়ণের উপর এসে পড়লো পাহাড়প্রমাণ কাজের চাপ। স্বয়ং শাহেনসার আদেশ। তাঁর প্রতিনিধিরূপেই সমস্ত বাংলা-বিহারের জমি জরিপের কাজে নেতৃত্ব দিলেন তিনি। নিজের এস্টেটের কাজ সামলানোর সাথে সাথে বাদশার কথামতো নতুন মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত বাংলার জমি ও সীমানা জরিপ সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র গুছিয়ে আগ্রায় পাঠিয়ে দিলেন কংসনারায়ণ।  জমিদারী সংক্রান্ত কাজের অভিজ্ঞতায় ভর করে আগ্রার সরকারী কাজে নিজের মুন্সীয়ানা দেখিয়ে বাদশার একেবারে কাছে চলে এলেন বাংলার তাহিরপুরের বাঙালী জমিদার কংসনারায়ণ।
সম্রাট আকবরকে বাংলার জমি জরিপ সংক্রান্ত সমস্ত নথি পৌঁছে দিয়ে রাজা কংসনারায়ণ নির্বিঘ্নে ফিরে গেলেন তাহিরপুর। এই সেই ঐতিহাসিক তাহিরপুর যাকে এখন লোকে তাহেরপুর বলে চেনে। বর্তমানে এটি রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার একটি পৌরসভা। তাহিরপুর বারনই নদীর তীরে একটি ছোট্ট বর্ধিঞ্চু শহর। রাজশাহী শহরের কাছে এই স্থানই ছিল রাজা কংসনারায়ণের রাজধানী। যাই হোক, এবার আসা যাক বাংলার প্রথম বর্ণাঢ্য দুর্গাপুজোর কথায়। এস্টেটে ফিরে গিয়ে জমিদারীতে মন দিলেন রাজা। বাংলার হিন্দু সমাজে নিজের নাম আর রাজত্ব অক্ষয় করে রাখবার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন যাগযজ্ঞ করবার জন্য। রাজার ইচ্ছেমতো ডাক পড়লো পরগণার সমস্ত পণ্ডিত পুরোহিতদের। উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন রাজশাহীর হিন্দু সমাজের মাথা রমেশ শাস্ত্রী মহাশয়ও। সকলের সামনে রাজা যা বলে বসলেন তা শুনে অবাক সারা বাংলার পণ্ডিত সমাজ। তিনি একেবারে রাজসূয় বা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চান। কিন্তু রমেশ শাস্ত্রী বললেন, বিশ্বজিৎ, রাজসূয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ - এই চার মহাযজ্ঞ কোনওভাবেই সম্ভব না। কারণ প্রথম দুটির অধিকার কেবল সার্বভৌম সম্রাটের। আর দ্বিতীয় দুটি কঠোরভাবে কলিতে নিষিদ্ধ। রাজা তো পড়লেন মহা দ্বন্ধে। সংকল্প ত্যাগ করবেন তেমন মানুষও তিনি নন। ধনবান রাজা টাকা খরচ করেও কোনোভাবে উপায় পেলেন না মহাযজ্ঞ করবার। শাস্ত্রনিষিদ্ধ। শেষপর্যন্ত পণ্ডিতরা বিধান দিলেন দুর্গোৎসবের। তাঁরা জানালেন মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসরণ করলে কলিতে একমাত্র দুর্গোৎসবই মহাযজ্ঞ। এবং এই যজ্ঞে সবরকম যজ্ঞের সমান ফল পাওয়া যায়। রমেশ শাস্ত্রীও সহমত হলেন এই শাস্ত্রীয় বিধানের সঙ্গে। যথারীতি শুরু হল তোড়জোড়। তখন তো আর আজকের মতো দুর্গাপুজো বহুল প্রচলিত ছিল না। আজকের মতো একচালার দুর্গাপ্রতিমা দেখেও নি বাংলাবাসী। মহাকবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর বাংলা রামায়ণে রামচন্দ্রের অকালবোধনের কথা বলেছিলেন ঠিকই। কিন্তু আটপৌরে বাঙালী সেই পুজোর কথা কেবলই বইতে পড়েছে। কখনো চোখে দেখে নি মাটির একচালি দুর্গামুর্তি। তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণের উদ্যোগে বাংলার বুকে প্রথম অনুষ্ঠিত হল দুর্গোৎসব। এই মহাযজ্ঞে সেযুগেও রাজা খরচ করলেন প্রায় আট লাখ টাকা। নিমন্ত্রিত হল এস্টেটের সমস্ত গণ্যমান্য মানুষজন। পড়শী জমিদারবর্গ। দুর্গাপুজোর প্রসাদ পেলেন সমস্ত প্রজারা। মার্কণ্ডেয় পুরাণের পুজোবিধি অনুসারে দেবীর আবাহন করলেন কংসনারায়ণ। তৈরি করা হল একচালচিত্রের প্রতিমা। দুপাশে দেবীর সম্পূর্ণ পরিবার। লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক ও গণেশ। প্রতিমার পিছনে আধখানা চাঁদের মতো চালচিত্র। আজও এই ধরনের চালিকে বাংলা চালি বলা হয়। আদি কলকাতায় কালীঘাটের পটশিল্পীরা চিত্রশিল্পে ফুটিয়ে তুলতেন বিভিন্ন রকমের চালচিত্র। দেবী দুর্গার মুখেও নতুনত্ব। টানা চোখ ও সোনার গয়নায় মোড়া শরীর। দেবীমূর্তির এই আদি ধারাকে বাংলা মুখ বলা হয় আজও। রাজা কংসনারায়ণের হাত ধরে বাংলার সামাজিক চিত্রে ঢুকে পড়লো বাঙালীর দুর্গাপুজো।

বাংলার দুর্গাপুজোর কথা বলতে গেলে সবার প্রথমেই যাঁর নাম উঠে আসে তিনিই তাহিরপুরের কংসনারায়ণ। এই বাংলায় একচালা মূর্তিতে প্রথম দুর্গামূর্তি বানিয়ে সাড়ম্বরে দুর্গোৎসব পালন করেন তিনিই। এদিকে বাঁকুড়াতে মল্লরাজবংশে দেবী মৃন্ময়ীর কথা আমরা জানি। দশম শতাব্দীতে ঊনিশতম মল্লরাজা জগৎমল্লের হাত ধরে তৎকালীন বন বিষ্ণুপুরে (বর্তমান বিষ্ণুপুর) প্রথম অনুষ্ঠিত হয় দেবী দুর্গার সাড়ম্বরে পুজো। কিন্তু সেই পুজো পদ্ধতি আজকের বাঙালীর দুর্গোৎসবের সাথে মেলে না। বরং রমেশ শাস্ত্রী প্রণীত কংসনারায়ণের দুর্গাপুজো পদ্ধতি ও প্রতিমার ধরণ আজও ভক্তিভরে পালন হয়ে আসছে বাংলার ঘরে ঘরে। কংসনারায়ণ রায় তাই দুর্গাপুজোর হাত ধরে আজকের বাঙালীর কাছে অতিমাত্রায় আপন। বাংলায় আজও যে দুটি ঘরানায় দুর্গাপ্রতিমা নির্মিত হয় তার অলিখিত কপিরাইট যায় বিষ্ণুপুর মল্লরাজাদের ও তাহিরপুরের কংসনারায়ণের দিকে। যদিও বাংলায় দুর্গামূর্তির ভিত্তিতে কংসনারায়ণ নবীন হলেও অনেক আগেই বেশ গোহারান হারিয়ে দিয়েছেন মল্লরাজাকে। আজ কংসনারায়ণ ঘরানার একচালির প্রতিমাই পূজিত হন বেশিরভাগ বাড়িতে। দুর্গার টানা টানা চোখ ও টিকলো নাক। উপরে লক্ষ্মী সরস্বতী এবং নীচে কার্তিক গণেশ। পিছনে অর্ধগোলাকৃতি চালচিত্র। প্রসঙ্গত বলে রাখি, বিষ্ণুপুরে মৃন্ময়ী দেবীর দুপাশে দেবীর পরিবার থাকলেও তা কংসনারায়ণের মূর্তির থেকে কিছুটা আলাদা (সঙ্গে ছবি দেওয়া হল)। এখানে কার্তিক গণেশ উপরে ও লক্ষ্মী সরস্বতী নীচে অবস্থান করেন। যাই হোক, এরপরেই বাংলায় বিভিন্ন ঘরে ঘরে শুরু হয় এই মৃন্ময়ী দেবী দুর্গার আবাহন। কলকাতায় দুর্গাপুজোর গোড়াপত্তন হয় এর বেশ কিছু পরে ১৬১০ সালে। বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের হাত ধরে দেবী দুর্গা পা রাখেন কলকাতায়। যদিও সেই কলকাতা আজকের মতো ঝাঁ চকচকে মহানগরী নয়। সে এক অজ পাড়াগাঁ। কিন্তু তামাম বঙ্গদেশে প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করে অমরত্ব পেলেন রাজা কংসনারায়ণ। বাংলার ঘরে ঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের বছর ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের পুজোর হাত ধরে শহর কলকাতাতেও রমরম করে শুরু হয়ে গেল দুর্গাপুজো। প্রায় তখনকার প্রতিটি বাঙালী ধনাঢ্য বাড়িতেই শুরু হল দুর্গোৎসব। এরপর ভাগীরথীর স্রোতে গড়িয়ে গেছে অনেক জল। বারোয়ারী পুজো, পাড়া, ক্লাবের পুজো, থিম পুজোর সাথে সাথে বাংলা কাটিয়ে ফেলেছে অনেকগুলো শরৎ। আজও তাহিরপুর চুপিচুপি সাক্ষী দেয় প্রতিটি বাঙালীর কানে কানে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন