ফাল্গুনী ঘোষ
১
মাঠ ঘাট সতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে খর জৈষ্ঠ্যে। মেঘের দিকে তাকালে বৃষ্টির আশা ক্ষীণ। রুগ্না শিলতোর্সা বুকে পাথর নিয়ে রোদ পোহায় এখন। চাঁদিশাল গ্রাম থেকে আট দশ কিমি দূরে সোহাগী শিলতোর্সার সারাবছরের ঘরবসত। বর্ষা ছাড়া অপুষ্টিতে ভোগা অনাথিনী বুঝিবা। নদীতে এসময় গরু-ছাগল চরে। সমতলের ছাইরঙা জমাট বাঁধা মাটি চতুষ্পদী আক্রমণে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে, আসলে ঝুরঝুরে দোয়াঁশ প্রকৃতির বলে।
বড় বড় দুটি হাওরের সখ্য চাঁদিশাল গ্রাম ঘিরে। বাপ ঠাকুদ্দার আমলের শোনা কথা, এসব হাওরের (বিলের) গভীর টলটলে পান্নাসবুজ জলে চাঁদনী রাতে চাঁদ নেমে এসে নিজের রূপ দেখত-সেই থেকে গ্রামের নাম চাঁদিশাল।
চাঁপা রাজবংশী বিলের লাগোয়া পায়ে চলা সরু পথে হাঁটতে হাঁটতে মুহূর্ত কয়েক থমকে দাঁড়ায়। এসব আদিকালের চলে আসা কথা তাকে একটু দুলিয়ে দিয়ে যায়। বিলের দিকে দু'পা এগিয়ে মুখ ঝুঁকিয়ে হাসে। চাঁদ তো দূর, গ্রামের সাড়াজাগানো শ্যামলা সুন্দরীর মুখচ্ছবি তুলে ধরার ক্ষমতা নেই আজ হাওরের। পাঁকে লিপ্ত তার বুক। সেখানেই বড় বড় আগাছার ঘর-সংসার চারিয়েছে।
রঙ চাপা চাঁপার প্রধান অস্ত্র বড় বড় কালো ঘন পল্লবে ছাওয়া চোখের গভীর-গভীরতর ভাষা। গাছকোমর জড়ানো শাড়ি আর আঁটোসাটো ব্লাউজে সে হেঁটে গেলে কাকপক্ষীর চোখ হেসে ওঠে। পুরুষ তো তুচ্ছ মানুষ-তাদের তাই চোখ ফেরানো দায়। হিংসুকে অবশ্য বলে, 'চাঁপা পুরুষ উস্কানি মেয়্যা! ঢেমনি!' যদিও এ যাবৎ চাঁপার নামে কোন কলঙ্ক রটে নি। একমাত্র স্বামী উদাসকে নিয়ে তার পরিপাটি ঘর-সংসার।
দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক পরিবর্তনসূত্রে এককালের চাঁদিশাল গ্রামের প্রতাপশালী বসুনীয়া জোতদার পরিবারের ভুবন বসুনিয়া আজ শুধুই এই অঞ্চলের 'পানিছিটা বাবা'। জোতদারের প্রতাপ প্রতিপত্তি সময়ের সাথে কালের গর্ভে বিলীন। থাকার মধ্যে আছে গ্রামের উত্তর প্রান্তে তিন মহলা বাড়ি আর সেই বাড়িতে দু'চারটে কাজের লোক। জোয়ান ছেলে কিষান শহরের পড়াশোনা শেষ করে নিকটবর্তী ঘুঘুমারিতে তাঁতের ব্যবসা ফাঁদার কারণে রাত করে ঘরে ফেরে আবার কাক চিল টের না পাওয়া ভন্যি দুপুরে গ্রামের রাস্তা বেয়ে মফস্বলের পাকা রাস্তায় পাড়ি দেয়।
জোতদারি দাপট নাই থাক সমাজ জীবনের প্রচলিত অংশ হিসেবে জোতদার ও আধিয়ার (প্রজা)র সম্পর্ক এখন মধুর। প্রজার ছেলে-মেয়ের বিয়ে, অন্নপ্রাশন, পুজো-পার্বণের সময় জোতদারের স্ত্রী 'গিথার্নী' জল ছিটিয়ে আশীর্বাদ করলে শুভ কাজে মহরত হয়। তখন থেকে তিনি সেই পরিবারের 'পানিছিটা' মাও (মা) বলে গ্রামসমাজে বিশেষ সম্মানীয়া হয়ে ওঠেন। এটাই রেওয়াজ। সেই সূত্রে ভুবন বসুনীয়া প্রজাদের আশীর্বাদী দিয়ে চাঁদিশাল গ্রামের 'পানিছিটা' বাবা।
তিন মহলা বাড়ির উপরের উত্তরের জানালায় দাঁড়িয়ে ভুবন মাঠে মাঠে ধানের বিবর্ণ পাণ্ডুর রূপ দেখে, যা জোতদারের চোখের বিষন্নতা ছাপিয়ে দিয়েছে। এত ঘর মানুষ। তাদের দিন চলবে কিভাবে! কবে বৃষ্টি নামবে! কবে রোপিত হবে বীজ!
চাঁপার উপর দায়িত্ব পড়েছে হুদুম দ্যাও-এর মাগন-এর জল সংগ্রহের। সে চলেছে তাই ভুবন বসুনীয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে। 'পানিছিটা' মাও প্রথম জল দেবে। এরপরে গ্রামের সব ঘরের জল একত্রিত করে হুদুম দ্যাও-এর পল্লব-সিঁদুর-চন্দন চর্চিত মঙ্গল ঘট রোপিত হবে রুখা মাটির মধ্যে আঠিয়া কলার গাছের গোড়ায়। শীলতোর্সা নদীর চড়ার পারেই সে শুখা মাঠ। বুড়ি কর্ত্রী ঘোষণা দিয়েছে সেখানেই সামনের জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমার রাত্রে হুদুম দ্যাওকে তুষ্ট করার আয়োজন।
চাঁপা শীলতোর্সার পাড়ের চড়া বেয়ে উত্তরদিকে একটু ঘুরপথে যায়, ভুবন বসুনীয়ার বাড়ি। উদ্দেশ্য শুখা মাঠটাকে একবার ছুঁয়ে দেখা। বিবর্ণ শস্যের গায়ে হাত বোলায় সে। নরম হাতের মুঠি শক্ত করে মনে মনে বলে-পানি হবে! বীজ পোঁতা হবে মাটির গভভে! ফসল ফলবে! মানুষ খেয়ে পড়ে বাঁচবে! এমন নাচব, গাইব...তোমার শরীর জেগে উঠবে হুদুম দ্যাও! মেঠো পথের আঁকাবাঁকা ছন্দে চাঁপার শরীরের আঁকেবাঁকে রোদ খেলা করে।
ভুবন জোতদার সম্মোহিতের মতো দ্যাখে, গায়ে রোদ মেখে চাঁপার চলন্ত ছন্দ। বড় প্রাণোচ্ছ্বল এই চাঁপা। বড়ই লক্ষ্মীমন্ত। মনে মনে ভাবে সে। গেলবার তাদের ধানের গোলায় যখন আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করার জন্য ছুটে এসেছিলো। তখন চাঁপা রাজবংশী ঝাঁপিয়ে পড়ে, নিজের বুক দিয়ে সেসব সামলেছে-গোটা গ্রাম তার সাক্ষী।
"কই গোওওও পানিছিটা মাও! মুই দেরী হই যাছু। পানিত দিবেন?...কই গোওওও..."
শব্দহীন বাড়ি তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে সহসাই, যে হিল্লোল ভুবনের জোয়ান ব্যাটা কিষাণ'কে ঘর থেকে টেনে বারান্দায় আনে। লম্বা, পাথর খোদাই কিষাণ। চওড়া ছাতির কিষাণ। লাস্যময়ী চাঁপা। বুকে আগুন চেপে রাখা চাঁপা। তাদের চারচক্ষুর কাছাকাছি এই প্রথম মিলন।
২
উদাস রাজবংশী এই চাঁদিশাল গ্রামের সম্পন্ন আধিয়ার। জোত, জমি, ফসল তার হাতে সাড়া দেয়। কাদা-মাটির গড়ন পিটনে কেমন ফসল হবে-উদাসে'র সে কথা যেন বেদবাক্য। উদাস, জোত-জমির ব্যাপারে যত টনটনে ঠিক ততটাই উদাসীন ছিল, নিজের ব্যক্তি জীবনে। মাটি-ফসলের নেশায় পাগল উদাসে'র একটু বয়সেই বিবাহিত জীবন শুরু হয়। ভুবন বসুনীয়ার বাড়িতে ধানের গোলায় আগুন লাগার দিনে প্রথম সে দেখে চাঁপাকে। তারপর তাকে ঘরে আনতে দেরী করেনি উদাস। চাঁপার গরীব গুরবো মা নিশ্চিন্তে দু চোখ বুজেছিল, বাপ মরা মেয়েকে উদাসের হাতে সঁপে।
কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারল না উদাস। চাঁপার সব ভাষা এখনও সে পড়ে উঠতে পারেনি। প্রথম প্রথম যখন বাঁধভাঙা বন্যা নামত চাঁপার জমিতে, অসহায় খড় কুটোর মত ভেসে যেত উদাস। পারত না তাকে সামলাতে। আস্তে আস্তে অবশ্য নিজেই সামলে গেছে চাঁপা। এখন প্রায়শঃ গ্রীষ্মের শীলতোর্সার মতো শুকনো, খরখরে সে কালো মেয়ে। মাঝে মাঝে আফসোসে জিভ চুকচুক করে উদাস আনমনেই। দুকূল ছাপিয়ে বন্যা নামার আশায় গভীর আশ্লেষে বউকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে-
"কবে তোর মাটি ভিজত রে! বীজ পোতন মন লাগু...ও চাঁপারানি..."
কাল জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমা। হুদুম দ্যাও-এর পুজো। আজ জানলা বেয়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি দিচ্ছে উদাসের বিছানায়। ঘরের অন্ধকার জ্যোৎস্নার সাথে লুকোচুরি খেলছে যেন! আধা আলো-অন্ধকারে চাঁপা আরো মোহময়ী হয়ে ওঠে। তার চাঁপা চাঁদনি রাতে খোলা মাঠে মাতাল হয়ে দুলবে! গা শিরশির করে ওঠে উদাসের! বুকের সাথে লেপ্টে থাকা বউ এর মুখটা ধরে ফিসফিসিয়ে বলে সে-
"তু কাল লাচবি! গাইবি! এই দেহাত আঁকাবাঁকা দুলব! কেমন করে হুদুম জাগ্যে! মাটি ভিজে, বীজ পোঁতা হয়...মুই দেখন লাগে।"
হাঁপিয়ে ওঠে সে-
"...চাঁপা...ও চাঁপা..."
ডাকতে থাকে আশ্লেষে। আরো গভীরতায়...
"মরণ! " খিলখিল হেসে গড়িয়ে পড়ে চাঁপা। উদাসের বউ।
রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষেরা জানে হুদুম দ্যাও-এর পুজোয় অনেক বাধা নিষেধ। বিশেষত পুরুষদের এই পুজোর নিয়ম কানুন শোনাও বারণ, দেখে ফেললে ঘোর অমঙ্গল। তাই কেউ জানে না এই পুজোয় ঠিক কি হয়! তবু কানাঘুষো খবর যা, এযাবৎকাল ছড়িয়ে এসেছে মানুষে, উদাসও সেইটুকুই জানে। বুড়িকর্ত্রী পুজোর সংকল্প নিয়ে উপবাস করে পুরোহিত হন। রাত গভীর হলে সব মেয়েরা মিলে বস্ত্রত্যাগ করে নাচ, গান শরীরী বিভঙ্গে তুষ্ট করে হুদুম দ্যাওকে। পুজোর পর শান্তি, সম্বৃদ্ধি, ভালো ফসলের আশায় মাগনের জল ছিটিয়ে বেড়ায় গোটা গ্রামে ব্রতীরা।
৩
মাঠের এক কোণে নদীর পাড় ঘেঁষে বালি খুঁড়ে কলাগাছ পোঁতা হয়েছে। গাছের গোড়ায় নিকানো জায়গায় সাজানো ধূপ-দীপ-নৈবদ্য-ফল-শস্য-খাবার। মাটির হাঁড়িতে রাখা মাগনের জল। পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে আদিম রিপুর সাধনার সূচনা। আকাশে ম্যাঘ দাও হুদুম। পানি আসুক। মাটি ভিজুক। বীজ পোঁতা হোক। আমার সন্তানেরা দুধে ভাতে থাকুক। হুদুমের কাছে আকুল প্রার্থনা-
"আয়রে হুদুম দ্যাও, আয়রে হুদুম দ্যাও
ওকি হুদুম গা ধুইবার জল দাও
কালা ম্যাঘ উঠিল-ওকি ও, ম্যাঘের ভাই
এক ঝাক দেও বর্ষণ গা ধুইয়া যাই..."
বস্ত্রহীন মহিলার জটলা হুদুমকে ঘিরে নাচতে থাকে। চাঁপা শুকিয়ে যাওয়া ফসলের গায়ে হাত বোলায়। নরম হাতের মুঠি শক্ত হয়ে আসে তার। নিটোল নিতম্ব উপচে কালো চুলের ঢল নামে চাঁপার-
"হুদুম দেউ হুদুম দেউ, এক ছিলকা পানি দেও
আয়রে হাড়িয়া ম্যাঘ আয় পর্বত ধারা
তোক ম্যাঘক বান্ধি থুইম ক্যাশের আগাল দিয়া।"
মাটিতে জল ঢেলে ঢেলে প্যাচপ্যেচে কাদায় যৌথ নাচ-গানের ঢেউ আছড়ে পড়ে হুদুমের গায়ে। তেষ্টায় শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট চাটে চাঁপা। ছুটে যায় শুকনো খরখরে নদীর বুকে। কান পাতে সেখানে। চাঁদের আলোয় চিকচিক করে ওঠে নদী গর্ভ। বুকের ভিজে সুবাসে নেশায় টলতে থাকে সে। ঠোঁট লালায় মাখামাখি হয়ে যায়। মাটির আনুভূমিকে বিছিয়ে দেয় নিজেকে। খামচে ধরে পাথুরে শরীর। এইতো মাটি ভিজে উঠছে। আরো ভিজিয়ে দাও। পিষে দাও! মাড়িয়ে দাও খরখরে শুকনো মাটি। বৃষ্টি আনো! আজ বন্যায় যেন ভেসে যায় সবকিছু।
অতঃপর অবধারিত বৃষ্টি নামে। ঘন কালো মেঘ ঢেকে ফেলে চাঁপাকে। তার শরীরে বিদ্যুৎ চমকায়। ভিজে যাওয়া কাদা কাদা মাটিতে চাঁপা অবশ আরামে ডুবে যায়। বর্ষণের প্রবল টানে খরখরে মাটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। এবার মাটির গর্ভে নেমে আসবে উদ্দাম কর্ষণ। বীজ পোঁতা হবে।
অন্যদিকে পূর্ণিমার চাঁদনিতে একজোড়া দৈনন্দিন চোখ আকুল আশ্রয় চায় মেঘের। সে শোঁকে ভিজে মাটির গন্ধ। সে খুব চায় শুকনো নদীতে বান ডাকুক। মাটি ভিজুক। ঐ তো তার নিজের খেত।
মাস চারেক পর...
সন্ধে প্রদীপ জ্বেলে শ্বশুরের চা নিয়ে আসে চাঁপা। ভুবন মনে মনে বলে, 'বৌমা বড় লক্ষ্মীমন্ত। তার বংশের বীজ বহন করছে।'
মাস চারেক আগে জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমার পরের দিন সকালে শীলতোর্সার চড়ায় উদাসের লাশ পাওয়া যায়। লোকে বলে বাবা হুদুম দ্যাও-এর কোপ।