দোঁহা

এসো বারেবারে



দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

মানুষ আমাকে একাকীত্বের ঘুণপোকার হাত থেকে মুক্তি দেয়। তাই ভিড়ের মধ্যে চলে যাই মাঝে মাঝে। রথের মেলায় অফিস ফেরতা রোজ ঢুকি। মানুষ দেখেই কিছুটা সময় কাটে আমার। বাড়ি ফিরতে হয় মায়ের জন্য। দীর্ঘ আট মাস পক্ষাঘাতে পঙ্গু মা শয্যাশায়ী। রেনীমাসি মায়ের  কাজে সর্বদা সতর্ক। অফিস থেকে ফিরে চায়ের কাপ হাতে মায়ের সঙ্গে কিছু কথা। সারাদিনের অফিসের গল্প বলা অথবা তিতলির দুষ্টুমির গল্প শোনা মার কাছে। তিতলির কথা বললে মায়ের চোখে মুখে একটা আলাদা ঔজ্জ্বল্য। বুঝি কারণটা। একটা নাতি নাতনির মুখ দেখে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা মায়ের। কিন্তু মায়ের এই অবস্থায় বিয়ে মানে জোর করে সমস্যা ডেকে আনা। আজকাল যা শুনছে সব!

তিতলি পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। স্কুল থেকে ফিরে রোজ মায়ের কাছে আসে। ওর দিদুনের সাথে আড্ডা দিতে নাকি ভালো লাগে! আজ সকালে অফিস বেরনোর সময় ওর স্কুল যাওয়ার ভ্যানে উঠতে উঠতে বলেছে জিলিপি পাঁপড় খাওয়ার কথা। ওর জন্য আর বাড়ির জন্য আজ জিলিপি পাঁপড় নিয়ে যাবো। তৃতীয় চায়ের কাপ শেষ করে উঠে চললাম জিলিপির দোকানে। দোকানের সামনে কয়েকজন ক্রেতা দাঁড়িয়ে। ভিড় সেরকম নেই। মেলায় এবার লোকজন খুব কম। চায়ের দোকানদার বলছিল, অন্যবারের তুলনায় এবারে কেনাবেচা ভালো নয়। লাভ হচ্ছে না বললেই হয়। বুঝলাম কাজ হারিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে। হাতে পয়সা না থাকলে মেলার আনন্দ তো কাঁঠালের আমসত্ত্ব!

 জিলিপির দোকানের বাঁদিকে ছোট্ট দুটো ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে। ছেঁড়া জামাকাপড়।দেখেই বোঝা যায় দারিদ্র্যের সখ্যতায় ওদের বেড়ে ওঠা। দোকানি মাঝে মাঝেই ওদের তাড়াচ্ছে। ওরা তাড়া খেয়ে একটু এগিয়ে আবার ফিরে আসছে। একমনে জিলিপির দিকে তাকিয়ে। বুঝলাম সব। কৌতুহলী হয়ে দোকানিকে জিজ্ঞাসা করতেই বেশ রেগে গেল সে। বিকেল থেকেই নাকি ঐ দুজনে ওরকম করছে। ওদের পয়সা নেই। অথচ জিলিপি চাইছে খাবে বলে। দোকানি খুব উত্তেজিত হয়ে একটা খারাপ কথা বলে উঠলো।

রাগ হলো খুব। চিৎকার করে দোকানিকে বলে উঠলাম, "ওরা জিলিপি খেতে চেয়েছে। চুরি তো করে নি। তাহলে এভাবে গালাগালি করছেন কেন ওদের? ওদের গালাগাল দেওয়ার আগে আপনার বাড়ির বাচ্চাটার মুখটা মনে করে দেখুন।" দোকানি বেশ বিরক্ত হলো আমার ওপর। উৎসাহী দু-একজন এখন তৎপর। তাদের মুখে নীতি কথার ঝড় এখন। হাসি পেল খুব। কবে যে শিরদাঁড়াটা সোজা হবে এদের!

বাচ্ছা দুটোকে কাছে ডাকলাম। ওরা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলো। দোকানিকে দু জায়গায় এক কেজি করে জিলিপি ও চারটে করে পাঁপড় ভাজা দিতে বললাম। দোকানিকে টাকা পয়সা মিটিয়ে বাচ্ছা দুটোর হাতে জিলিপি ও পাঁপড়  তুলে দিলাম। ছোট ছোট হাতে তখন সব পেয়েছির আনন্দ। ওদের চোখে মুখে খুশির বন্যা। জিলিপি নিয়েই দুজনে দে ছুট। মনটা আনন্দে ভরে গেল। মায়ের কথাটা মনে পড়লো। মা বলেন "মানুষের জন্য বাঁচিস। সেখানেই জীবনের সার্থকতা।" ঝাপসা চোখে হঠাৎ দেখি বাচ্ছা দুটো ফিরে এসে সামনে দাঁড়িয়ে। ছেলেটি  জিঞ্জাসা করে উঠলো "তুমি কি ঈশ্বর? "চমকে গেলাম। ছেলেটি বোনের হাত ধরে বলে উঠলো "মা বলে যখন কিছু মন থেকে চাইবি তখন ঈশ্বর আসেন সাহায্য করতে। বোন জিলিপি খাবার বায়না করছিল। পয়সা নেই আমাদের।দ্যাখো তুমি ঠিক কিনে দিলে।" উত্তরের অপেক্ষা না করে চিৎকার করতে করতে আবার ছুট লাগালো "মাকে গিয়ে বলবো, আজ ঈশ্বর দেখেছি!" একরাশ কান্না বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জলভরা চোখে ভাই বোনের ভিড়ের মধ্যে ছুটে চলা আমার অন্য এক ভাইবোনের কাশফুলের মধ্যে দিয়ে রেলগাড়ি দেখতে ছুটে চলার দৃশ্যটা চোখের সামনে মেলে ধরলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন