দোঁহা

চশমা



শুভারুন চ্যাটার্জী

প্রতিদিনের মতোই পর্ণশ্রীর কাজীপাড়ার মোড়ে নেমে গোপাল দার দোকানে একটা লাল চা ও বড়ো গোল্ডফ্লেক ধরালো সৌমিত্র। কর্মজীবনের শুরু থেকে এই নিত্যদিনের অভ্যেসটার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তবে গত কয়েকদিন যাবৎ সৌমিত্রর মনটা বড্ড খারাপ। হাতেগুনে আর ৪৮ ঘন্টা হয়তো রয়েছে আর তার পরেই তাকে ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে তাদের পুরনো দ্বিতল বাড়িটা। সে যদিও একা নয় তার সাথে আছে তার স্ত্রী আশীর্বানী ও তার বিধবা মা। এই বাড়িটি নিয়ে নানা ধরনের স্মৃতি, বিস্মৃতি, খারাপ লাগা, ভালো লাগা, মান অভিমান, ওঠা পড়া সব কিছুই জড়িয়ে রয়েছে। আশীর্বানির সাথে ওর বিয়েটা আজ তিন বছর অতিক্রম করে গেছে; যদিও তার আগের থেকেই ওদের একে অন্যের সাথে আলাপ পরিচয় হয়ে গেছিলো। ওরা দুজনেই চেয়েছিলো বাড়িটাকে যদি বাঁচিয়ে এখানে টিকে থাকা যায় কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শরিকি ঝামেলা এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগলো যে তাদের পক্ষ্যে আর সম্ভব হলো না তাদের এই নস্টালজিয়া কে বাঁচিয়ে রাখা।

চা খাওয়া শেষ করে সিগারেটটা ধরিয়ে রাস্তার মোড়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে অনেক কিছু ভাবছিল সে। আশীর্বানির কলেজ থেকে ফেরার সময় হয়ে এসেছে, ভাবতে ভাবতে একবার রিং করলো আশীর্বানী কে। কলেজের ক্লাস নেওয়া শেষ করে কলিগদের সাথে একটা আলোচনায় ব্যস্ত সে। সৌমিত্র আর না দাঁড়িয়ে হাঁটা দিলো বাড়ির উদ্দ্যেশ্য। বাড়ীর গেট খুলে লম্বা দালানের অংশটা পেরিয়ে মোজাইক করা সিঁড়ি ধরে উপরের তলায় হাটতে শুরু করলো। হটাৎ কি যেনো একটা পায়ের মধ্যে এসে মাথা ঘোসছে, প্রথমটা কিছুটা হকচকিয়ে গেছিলো সে তারপর বুঝলো সেটা হলো চশমা। হ্যাঁ, ঠিক শুনলেন চশমা- গত দুবছরের মধ্যে বিশেষ করে এই অতিমারীর সময়টা জুড়ে তাদের পরিবারের আর একজন সদস্য হয়ে উঠেছে এই চশমা-একটা বিড়াল।

চশমার সাথে সৌমিত্র ও আশীর্বানী দুজনেরই এক ধরনের ঋদ্ধতা ও বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে-এক ধরণের আদান প্রদান যা আমাদের তথাকথিত সম্পর্কের যে ডিমেনশনগুলো এক্সিস্ট করে তার বাইরে হয়তো অবস্থান করে। যদিও এই চশমার সাথে বন্ধুত্ব সৌমিত্রর মা বা ওই বাড়ির অন্য শরিকরা খুব ভালো চোখে নেই নি। অনেকগুলো প্রশ্নর সম্মুখীন ওদের দুজনকেই হতে হয়েছে এবং মাঝে এক ধরনের ব্যবধান ও তৈরী হয়েছিল। কিন্তু ওই যে আগেই বললাম এই সম্পর্ক আমাদের সমাজের বা মানব সমাজের সম্পর্কের ডেফিনেশন এর বাইরেই কিছুটা অবস্থান করে আর তাই হয়তো এখনো সেটা আবার নতুন ভাবে ধরা দেয়।

সৌমিত্রর মনটা আরো খারাপ এই ভেবে যে তাদের এই অবস্থানের পরিবর্তনের ফলে চশমা তাদের মধ্যে থেকে হারিয়ে যাবে। কি ভাবেই বা তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। চশমার এখন একটা ঔরসজাত সন্তান ও রয়েছে-তার নাম গোগোলস। নামটা খুব শখ করে আশীর্বানী রেখেছিলো। মাকে ও শাশুড়ি মাকে খুব বোঝানোর চেষ্টা করেছে দুজনে যে যদি তাদের সাথে এই দুই প্রাণী সহাবস্থান করে কিন্তু তারা একদমই রাজি নয় তাতে।

আটচল্লিশ ঘন্টা অতিক্রম করে দিনক্ষণ এসে গেলো। শেষ মুহূর্তের গোছানো চলছে। একটা ম্যাটাডোরে আসবাবপত্র বাবদ অন্যান্য জিনিষ ওঠানো হচ্ছে। ঘরের পাশের লম্বা বারান্দাটাতে সকাল থেকেই একধরনের নিস্তব্ধতার আনাগোনা। আশীর্বানী একবার গিয়ে একবাটি দুধ দিয়ে আসে চশমাকে; ওর শাড়ির আঁচলের মধ্যে মুখ গুঁজে ঢুকে যায় সে। এবার মহাপ্রস্থানের পথে।

ম্যাটাডোরটাকে রওনা করে মা ও আশীর্বানী কে সঙ্গে নিয়ে সৌমিত্র দালান পেরিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখে, গাড়ির উদ্যেশ্যে রওনা দেয়। পাড়ার মোড়ে ক্যাবটা অপেক্ষায় রয়েছে। চেনা শুনা কয়েকটা মুখ হাত নাড়ায়, কথা বলে তাদের সাথে। সৌমিত্রর চোখ ভেজে, অল্প সময়ের জন্য জল আসে। গাড়িতে উঠে বসে তারা তিন জনে। পাড়ার পুরোনো বাবার মন্দিরের সামনে গাড়িটা একবার দাঁড়ায় আশীর্বানী ও মা গিয়ে নমস্কার সেরে আসে। গাড়িতে এসে উঠে বসে তারা গাড়ি স্টার্ট দেয়। কয়েক পা এগোনোর পরই গাড়ির সামনে দিয়ে একটা বিড়াল চলে যায়। ড্রাইভার গাড়ি টা দার করায়। মা একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

...সৌমিত্র পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে জ্বালায়। তারপর হট করে গাড়ি থেকে নেমে পরে, বলে এক মিনিট আসছি। একটা বস্তা বগল দাবা করে এসে গাড়িতে ওঠে। মা বলে ওঠে-
'কি রে ওটা কি আবার'?
সৌমিত্র বলে আমাদের  চশমা আর গোগোলসটাকে নিয়ে এলাম। আশীর্বানী একবারজোরে বলে ওঠে -
"'চরৈবেতি চরৈবেতি"। গাড়ী রওনা দেয়।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন