![]() |
প্রচ্ছদ. মরজানে সতরপির 'পার্সেপোলিস' |
রোহিণী ধর্মপাল
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে একটা ভাবনা বোধহয় সব বাঙালির মনেই কাজ করে। এমন কোনও মানসিক অবস্থা বা আবেগ নেই, যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গান বা কবিতা লিখে যাননি। মনের যে কোনও অবস্থা নিয়েই দেখি ঠিক একখানি অন্তত গান খুঁজে পেয়ে যাই। যখন ইরানের হিজাব পোড়াচ্ছে মেয়ে ছেলে নির্বিশেষে আর একসঙ্গে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে, যা দেখে শুনে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মনের এত যুগের চেপে রাখা রাগ ঘৃণা ক্ষোভকে উগরে দিচ্ছে ওরা; তখনই মনে হল, এই মিথ্যা আবরণের বোঝাকে পুড়িয়ে ফেলে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাওয়ার সৌন্দর্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কোনও গান বা কবিতা লেখেন নি? সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান, এই কথা যিনি বিশ্বাস করেন, চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির, এই কথা যাঁর মনে খোদাই করা, তাঁর কাছে কি পাব না, এই জীর্ণ ঘৃণ্যকে ছুঁড়ে ফেলার কথা? আছে। আছে। এমন একটি গান, যা সমস্ত হিজাব পরা, বোরখা পরা, এখনও ঘোমটা টেনে রাখা মেয়েদের অন্তরের গান হওয়া উচিত।
মুক্ত হও হে সুন্দরী!
ছিন্ন করো রঙিন কুয়াশা।
অবনত দৃষ্টির আবেশ,
এই অবরুদ্ধ ভাষা,
এই অবগুণ্ঠিত প্রকাশ।
সযত্ন লজ্জার ছায়া
তোমারে বেষ্টন করি জড়ায়েছে অস্পষ্টের মায়া
শতপাকে,
মোহ দিয়ে সৌন্দর্যেরে করেছে আবিল;
অপ্রকাশে হয়েছ অশুচি।
তাই তোমারে নিখিল
রেখেছে সরায়ে কোণে।
ব্যক্ত করিবার দীনতায়
নিজেরে হারালে তুমি,
প্রদোষের জ্যোতিঃক্ষীণতায়
দেখিতে পেলে না আজও আপনারে উদার আলোকে-
বিশ্বেরে দেখ নি, ভীরু, কোনোদিন বাধাহীন চোখে
উচ্চশির করি।
সংকোচে কাটাও দিন,
আত্ম-অপমানে চিত্ত দীপ্তিহীন, তাই পুণ্যহীন।
বিকশিত স্থলপদ্ম পবিত্র সে, মুক্ত তার হাসি,
পূজায় পেয়েছে স্থান আপনারে সম্পূর্ণ বিকাশি।
ছায়াছন্ন যে লজ্জায় প্রকাশের দীপ্তি ফেলে মুছি,
সত্তার ঘোষণাবাণী স্তব্ধ করে,
জেনো সে অশুচি।
ঊর্ধ্বশাখা বনস্পতি যে ছায়ারে দিয়েছে আশ্রয়
তার সাথে আলোর মিত্রতা,
সমুন্নত সে বিনয়।
মাটিতে লুটিয়ে গুল্ম সর্ব অঙ্গ ছায়াপুঞ্জ করি,
তলে গুপ্ত গহ্বরেতে কীটের নিবাস।
হে সুন্দরী,
মুক্ত করো অসম্মান, তব অপ্রকাশ-আবরণ।
এখনও, এই একবিংশ শতকেও, আমাদের দেশের মেয়েরাও ঘোমটা দিয়ে থাকে। গ্রামে-গঞ্জে তো বটেই, তথাকথিত আধুনিক মেয়েরাও বিয়ের দিন ঘোমটা দিয়ে সাজে। লজ্জাবস্ত্র দিয়ে মাথা ঢাকে। সিঁদুর পরে গর্ববোধ করে। গোত্রান্তর করে কন্যাদান হয়। মেয়ের পদবী পাল্টায়। এক এক করে সব বদলাতে থাকে। একটু একটু করে মেয়েটির সমস্ত অস্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য দেখা-অদেখায় মেশা বিরাট এক ঘোমটার আড়ালে চাপা পড়ে যায়। এমনকী, একটা সময় মেয়েটিও ভুলে যায়, যে তার ঘোমটা বিয়ের সাজের দিনে যা সামান্য একটু মাথা ঢেকে ছিল, শুধুমাত্র সাজের জন্য-তা আস্তে আস্তে বাড়তে বাড়তে তার পুরো শরীর, পুরো মনকেই আবৃত করে ফেলেছে। হিজাব বোরখা আর ঘোমটার আড়ালে মেয়েরা মরে বেঁচে থাকে। কারণ, তাদের সেই বোধটুকুও থাকে না, যে তারা আসলে মৃত।
সমাজের চোখরাঙানির ভয়, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লড়াই করবার সাহসের অভাব যাদের, যারা নতমস্তকে এই সব বিধান মেনে চলে সেইসব মেয়েদের নিয়ে তো কথা হবেই। হতেই থাকবে। হওয়া দরকারও। কিন্তু মাত্র বাইরের আবরণে আচরণে যারা আবরণের মোড়কে নিজে ঢেকে রাখে, সেই সব মূঢ়তাকে ছিন্ন করা আরও শক্ত। প্রতি মুহূর্তেই সেই লড়াই আমি লড়ছি। সঙ্গে আছেন সমমনস্ক চেনা অচেনা অনেক মানুষ। যে কোনও জায়গা, যে কোনও সুযোগ পেলেই বোঝাচ্ছি কন্যাদানে যেমন একটি মেয়েকে বস্তুরূপে ভাবা হয়, মেয়েটির গোত্র পাল্টে দেওয়া হয়, এগুলি কী ভীষণ অন্যায় আর অর্থহীন! বাইরে থেকে গোত্র পাল্টালে কি জিন আর এযাবৎকালের অভ্যাস মুহূর্তেই পাল্টে যাবে? আমার কন্যা আপনাদের হয়ে যাবে? আর সিঁদুর? সেও তো এক আশ্চর্য ঘোমটা! যা বরাবরের মতো একটি মেয়ের সামনে তর্জনী তুলে শাসাতে থাকে-মনে রেখো, তুমি আমার সম্পত্তি। আমি থাকলেও, আমি না থাকলেও। আমি আছি, সেই সৌভাগ্যে তুমি সিঁদুর পরবে। আমি না থাকলে তোমার দুর্ভাগ্যে তা মুছে দেবে। কিন্তু থাকবে আমার হয়েই। সেই সিঁদুরের লাল রেখা, যা আসলে রক্তচক্ষুর মতো মেয়েটিকে বেঁধে রাখে, বলি দিতে নিয়ে যাওয়া লালছোপ মারা ভেড়ার মতো, তা মেয়েরা পরম আনন্দে ধারণ করে। আবার লজ্জাবস্ত্র দিয়ে মাথা ঢেকে। মাথাটি নিচু করে। চোখ নামিয়ে। অবনতা লজ্জিতা বিনীতা এমন মেয়েকেই তো সমাজ চায়। শুধু আমাদের সমাজ না। সব সমাজই। আমাদের ধর্মই না। সব ধর্মই। বাইরে আধুনিক মেয়েরা বলে, সিঁদুর একটা সাজ। ইচ্ছে হলে পরব। কেউ বা বলে, উৎসবের দিন পরি আমি, আমার নিজেকে কেমন দেবী দেবী মনে হয়। সাজ? যে সাজ কেবল বিবাহিত মেয়েদের জন্য, স্বামী বেঁচে থাকা মেয়েদের জন্যই, তা সাজ??? সাজ হলে তো ছোট থেকে বৃদ্ধ, বিয়ে হয়েছে বা হয় নি, স্বামী বেঁচে বা মৃত; সবাই সেই সাজের অধিকার পেত? আর দেবী ভাব? তার জন্য এই রক্তচিহ্ন ধারণ করতে হবে?
আর বিয়ের সাজের ঘোমটা? বেনারসিটা মাথায় আধখানা তুলে বা ছোট্ট ছোট্ট চুমকি বসানো সুন্দর একটা ওড়না দিয়ে? যে ঘোমটা ছিল এককালে আধখানা মুখ পর্যন্ত ঢাকা, কোথাও কোথাও হয়ত এখনও তা আছে, তা কমতে কমতে মাথার মাঝখান পর্যন্ত এসছে; কিন্তু পুরো সরবে কবে?
রামায়ণে সীতার, মহাভারতে দ্রৌপদীর ঘোমটা ছিল? তাঁদের মাথায় থাকত সিঁদুরের লাল? সাবিত্রীর মনে জোর ছিল। নিজের প্রতি বিশ্বাস ছিল। তাই তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পেরেছিলেন। কুন্তী অহল্যা দ্রৌপদী তারা মন্দোদরী, প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চ কন্যা, যাঁদের সতীও বলা হয়, প্রত্যেকে (মন্দোদরী ব্যতীত) একাধিক পুরুষের সঙ্গ করেছেন। রাবণের মৃত্যুর পর মন্দোদরীও একা থাকেন নি।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ চিরকালই মেয়েদের অবগুণ্ঠিত রাখতে চেয়েছে। তাই মেয়েদের বলা হয়েছে ভীরুতা দীনতা লজ্জা সেবা মেনে চলা মেয়েদের গুণ। প্রশ্ন করা, আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভশীল মেয়েদের সমাজ ভয় পায়। এখনও কি সময় আসে নি ভেতর আর বাইরের আবরণ সরানোর? এখনও কি সময় আসে নি নিজেদের অধিকারের কথা নিজেরা বলার? পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকাটাও হিজাব আর ঘোমটারই আরেক রূপ। নিজের মনের সমস্ত সঙ্কীর্ণতা দৈন্য অকারণ সঙ্কোচের আবরণ সরিয়ে "মুক্ত করো অসম্মান, তব অপ্রকাশ-আবরণ"।