![]() |
প্রচ্ছদ. মরজানে সতরপির 'পার্সেপোলিস' |
শুভদীপ সাহা
বছর তিনেক আগে, খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল ইরান। সাহার খোদায়েরি, এক আদ্যান্ত ফুটবলপ্রেমিকা এক মেয়ের সাধ হ’ল স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার। কিন্তু এই একুশ শতকে, সে দেশের একুশে আইনে লেখা আছে, স্টেডিয়ামে বসে মেয়েদের খেলা দেখা নিষিদ্ধ। কারণ কী বলুন তো? যদি খেলা দেখতে গিয়ে উত্তেজনায় সম্পূর্ণ ঢেকে রাখা শরীরের কিছু অংশ অনাবৃত হয়ে যায়, যদি ঘন চুল এলিয়ে পড়ে…ছেলেদের চিত্তে এবং বিশেষ বিশেষ স্থানে দোলা লাগবেই। কিন্তু, সে মেয়ের মনে হয়েছিল, এই একুশ শতকে এসে এসব আবার কী? তাই ২০১৯ সালের মার্চ মাসে, সে লুকিয়ে চ’লে গেল স্টেডিয়াম; পুরুষের ছদ্মবেশে। স্টেডিয়ামে ঢোকার ঠিক মুখটায় সে ‘ধরা’ পড়ে যায়, বিচার হয়, সে বিচার হয় রীতিমতো আদালতে…আধুনিক আইন মেনে। কয়েক বছর আগে হ’লে অবশ্য পাথর মেরেই কাজ সেরে ফেলা যেত, এখন নানা হ্যাপা। যেদিন সেই আদালতে রায় বেরোবে তাঁর দোষ-গুণের, সাহার খোদায়েরি গায়ে আগুন ঢেলে আত্মহত্যা করেন। আদালতের রায়ে কিস্যু যায় আসে না তাঁর, এই প্রহসনের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ রেখে যান। তাঁর সেই আগুন, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে দেরী হয়নি। বহুদিনের বন্ধ দরজা পুড়িয়ে দিয়েছিল সাহারের সেই আগুন; স্টেডিয়ামে মেয়েদের প্রবেশে বাধানিষেধ উঠে যায়।
২০২২ সাল; ১৩ই সেপ্টেম্বর।
গাড়ি ক’রে কুদিস্তান থেকে তেহরানের দিকে যাচ্ছিলেন মাহসা আমিনি (জিনা আমিনি)। ২২ বছরের এক ফুটফুটে তাজা মেয়ে। পথ আটকায় ‘নীতি পুলিশ’ (Guidance Patrol)-লোকজন ঠিকঠাক পোশাক পরেছে কী না, ঠিকঠাক খাবার খাচ্ছে কী না–মানে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত কাজে নাক গলানো যাদের কাজ। মাহসা যে হিজাব(headscarf) পরেছিলেন, তাদের মনে হয়েছিল তা ঠিকভাবে পরা হয়নি (improper way). হিজাবের কাপড় সরিয়ে কিছু চুল বেরিয়ে এসেছিল। এর পরের ঘটনা গতানুগতিক। নীতি পুলিশরা মাহসাকে গ্রেফতার করে, হেফাজতে নেয় এবং জানতে চায় কেন সে ‘ঠিকঠাক’ভাবে হিজাব পরেনি? তাদের জানতে চাওয়ার ধরনে মাহসা খুব ভয় পেয়ে যান, কোমায় চলে যান এবং তিনদিনের মাথায় হার্ট অ্যাটাকে (বা ব্রেন ডেথ-এ) তাঁর মৃত্যু হয়।
কিন্তু, শাকটা তো ঢাকলে মাছ দিয়ে, মাছটা ঢাকবে কীসে?
মাহসার মৃতদেহ হাতে পাওয়ার পর দেখা যায় সারা শরীর জুড়ে নির্মম অত্যাচারের চিহ্ন স্পষ্ট। চোখের তলায় বীভৎস মারের চিহ্ন ; ইন্টারনেটের দৌলতে যে ছবি আমাদের অজানা নয়। ‘খুব ভয় পেয়ে’ গেলে যে এরকম অবস্থা হয় না, তা বলে দেওয়ার জন্য পোস্টমর্টেমের প্রয়োজন হয় না।
কিন্তু প্রয়োজন হয় অন্য এক ধরণের পোস্টমর্টেমের। ভাবনার–চিন্তার। এ ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ক্রমাগত ঘটে চলা ঘটনা, যা আপাতভাবে কখনও কখনও মনে হয় শেষ হ’ল; এর ঠিক পর পরই আবার চাগাড় দিয়ে ওঠে।
নারীবিদ্বেষ বলে এ ঘটনাকে দেগে দেওয়া যাবে না মোটেই, আশ্চর্য করা ব্যাপার হ’ল সেই Guidance Patrol-এ নারীরাও আছেন, হিজাব পরেই আছেন, মেনে নিয়েছেন (!) এবং মেনে নিতে বাধ্য করছেন বা আরও স্পষ্টভাবে বললে সবাই মেনে চলছে কী না তার দেখভাল করছেন।
স্বাভাবিকভাবেই মাহসা-র এই ঘটনায় সমগ্র ইরান তো বটেই সারা পৃথিবীজুড়ে নানা জায়গায় বিক্ষোভ–প্রতিবাদ দানা বাঁধছে। অথচ এই ইরান কয়েকদশক আগে অবধি আধুনিক, প্রগতিশীল ছিল। অবশ্যই শুধু পোশাক নয়, ভাবনাচিন্তার দিক থেকে...অথচ বর্তমান সময়ের এই চূড়ান্ত বৈপরীত্য। এ বিষয়ে জানতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কয়েক দশক।
ইরানের রাজতন্ত্র অনেকটাই টিকে ছিল পশ্চিমি দুনিয়ার সমর্থনে। শাসক শাহ মহম্মদ রেজার লাগামছাড়া দুর্নীতি দেশের নানা প্রান্তে বিদ্রোহ জাগিয়ে তোলে। ১৯৭৯ সাল নাগাদ রাজনৈতিক দলগুলো মিলিতভাবে ক্ষমতায় আনে একদা নির্বাসিত খোমেনি’কে। এই খোমেনি কট্টরপন্থী মুসলমান। যিনি ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পরেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করবেন ‘স্যাটানিক ভার্সেস’কে, ফরমান জারি করবেন সলমন রুশদির বিরুদ্ধে। এই খোমেনির সময় থেকেই দেশের চালচলনে বদল এলো, একটা আদ্যান্ত স্বাভাবিক দেশ, কট্টরপন্থী মৌলবাদের আখড়া হয়ে দাঁড়াল। যার প্রধান কোপ পড়ল মেয়েদের ওপর; হিজাব পরা, শিক্ষাক্ষেত্রে রাশ টানা, সর্বদা নীতি পুলিশের চোখরাঙানি, বিনোদনের সমস্ত মাধ্যমে পরিত্যাজ্য...এবং আরও অনেককিছু।
যে হিজাবের মূল প্রচলন শুরু হয়েছিল মূলত প্রকৃতি-পরিবেশের তীব্র দাহ থেকে শরীরকে রক্ষা করার জন্য, বর্তমানে সেই হিজাবই দাহ তৈরি করছে। এবং এই হিজাব ‘বিতর্ক’ নানা মতামত তুলে আনছে।
একধরণের মত, যা মূলত কট্টরপন্থীদের, সেই মৌলবাদী ভাবনাকে ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও এর পরের যে মতগুলো উঠে আসছে, যুক্তি-প্রতিযুক্তি-কুযুক্তির মধ্যে দিয়ে, সেগুলো মোটামুটি এরকম... একধরণের মানুষ কিছুটা ‘পাশ’ কাটিয়ে যাওয়ার মত করেই বলছেন, এটা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। যাঁর হিজাব পরার ইচ্ছে হবে, তিনি পরবেন, যাঁর পরার ইচ্ছে হবে না, তিনি পরবেন না...দুজনেই সসম্মানে স্বাগত। বেশ কিছুদিন ধরে চলে আসা ‘My body My choice’–এর প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় এতে। সাময়িকভাবে মন কিছুটা সায়ও দেয়। এরপর তলিয়ে ভাবলে ভাবতে বাধ্য হই, এই ‘যার পরার ইচ্ছে হবে না’, সেই ইচ্ছেটা কতটা স্বাধীনভাবে বাঁচে? সে বাঁচায় অনেকটা অবদমন লুকিয়ে রাখা নেই কি? ফলে, হিজাব-বিহীন জীবনের স্বাদ যে পায়নি, তাঁর কাছে এই না-পরাটাও কতটা স্বাধীন সে প্রশ্ন উঠেই যায়। ইরানে সাত বছর বয়েস থেকে একটি মেয়ের হিজাব পরার কঠোর নির্দেশ, এবং নারীশিক্ষার ক্রম অধঃপতন প্রতিবাদের আওয়াজটাকে বন্ধ করে দেওয়ার সুর তুলে দেয়। ‘My body My choice’–এর ধুঁয়ো ধরে কেউ কেউ বলছেন, তাহলে বাপু সতীদাহ প্রথাকেও সেই গোত্রে ফেলা হোক। কেউ কেউ বলছেন, না না সেটা তো বাড়াবাড়ি, জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার...
আরও একটি ‘কথা’ উঠে আসছে এই হিজাব পরাকে কেন্দ্র করেই। কিছু মানুষ বলছেন, যদি হিজাব বন্ধ করা হয় তাহলে ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে পৈতে, শিখদের পাগড়ি ও কৃপাণ এবং ইত্যাদি, সেগুলোও বন্ধ করা হোক। অর্থাৎ কী কী উপায়ে এই পর্দাপ্রথা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার মূলসুরটি গেঁথে নেওয়া।
এবং, মূল যে বিষয়টি বারবার পিছনে চলে যাচ্ছে, তা হ’ল একজন মানুষের ইচ্ছার সম্মান জানানো। নিজের ইচ্ছাটাকে চিনে নেওয়ার, জেনে নেওয়ার এবং জানানোর সুযোগ করে দেওয়া।
মাহসার এই হত্যায় সারা ইরান জ্বলে উঠেছে। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছেন এই প্রতিবাদে। যে চুলের কারণে মাহসাকে মেরে ফেলা হ’ল, মেয়েরা সেই চুল উন্মুক্ত করে উড়িয়ে দিচ্ছেন খোলা হাওয়ায়...পথে ঘাটে হেঁটে বেড়াচ্ছেন তরুণীরা...কেটে ফেলছেন চুল। সেই চুল দিয়ে তৈরী পতাকা প্রতিবাদের নিশান হয়ে উঠছে। পুড়িয়ে দিচ্ছেন হিজাব।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি ‘মন্দনা’ অঞ্চলের কৃষক মেয়েরা গান বেঁধেছিলেন, কৃষিজমিতে তাঁদের কাজ না করতে দেওয়ার প্রতিবাদে, যে গানের মোটামুটি তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘সৌন্দর্যকে বিদায়’ (Goodbye beautiful)...এই গানই এখন হয়ে উঠেছে ইরানের রাস্তায় রাস্তায়, এই প্রতিবাদের জাতীয় সঙ্গীত। ইটালীয়ান ভাষায় ‘বেলা চাও’ (Bella Ciao)। (গানের কথা এক থাকলেও সুরটা তাঁরা বেছে নিয়েছেন সাম্প্রতিক এক ওয়েব সিরিজের থেকে)
কিন্তু এই এত কিছুর পরেও কতটা বদল আসবে সে প্রশ্ন ক্রমাগত কুরে কুরে খায়। কোভিডের আগে সাহার খোদায়েরির লড়াইয়ে যেভাবে সরকার কোণঠাসা হয়ে উঠেছিল, এই প্রতিবাদের ক্ষেত্রে উল্টো ফল দেখা যাচ্ছে। সরকার দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে এই প্রতিবাদ আটকানোর ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে গুলি চালানো হচ্ছে প্রতিবাদীদের ওপর। এই প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা এখনও পর্যন্ত প্রায় দেড়শোর কাছাকাছি (তিনদিন আগের পাওয়া শেষ খবর অনুসারে), জেলে পোরা হয়েছে প্রায় এক হাজার জনের ওপর মানুষকে এবং আশা করা যায় মাহসার মতোই ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করা হচ্ছে তাঁদের। এই মিছিলের মুখ হয়ে উঠেছিলেন, পোস্টার-গার্ল হয়ে উঠেছিলেন হাদিস নাজাফি–চুল কেটে এই প্রতিবাদকে মুখরিত করেছিলেন যিনি। তিনদিন আগে, পুলিশ তাঁকে হত্যা করে।
অর্থাৎ যতরকমভাবে, যতটা নৃশংসভাবে এই প্রতিবাদকে আটকে দেওয়া যায় সেই চেষ্টা চলছে...শুধু ইরানে নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে, নানান সময়ে। একইসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় এই কিছুদিন আগেই, ভারতবর্ষের একটি রাজ্যের এক কলেজে হিজাব পরে ক্লাস করতে চাওয়া একটি মেয়ের মুখ...তাঁকে হেনস্থা করা বজরংদল এবং তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা সেই একাকী লড়াকু মেয়ে।
উত্তর খুঁজতে গেলে প্রশ্নটা সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রশ্নটা হিজাব পরা বা না পরা নয়। একজন মানুষের ইচ্ছার সম্মান জানানো। নিজের ইচ্ছাটাকে চিনে নেওয়ার, জেনে নেওয়ার এবং জানানোর সুযোগ করে দেওয়া, সেটা কতটা কার্যকরী হয়েছে আমাদের পৃথিবীতে? নানারকমের মৌলবাদ, ধর্মীয়–সামাজিক–রাজনৈতিক মৌলবাদ ক্রমাগত দখল করছে আমাদের যাপনকে, নাক গলাচ্ছে আমাদের ব্যক্তিগত কাজে। রাশ টানা প্রয়োজন। প্রতিরোধ করা, এটাই এখন কাজ...