দোঁহা

একটি বামপন্থী আন্দোলন

 

প্রচ্ছদ. মরজানে সতরপির 'পার্সেপোলিস'

সব্যসাচী মজুমদার

অবশেষে প্রাচ্যের কিছু সংখ্যক মানুষ, নিজেদের মানুষ সত্তার অধিকার আদায়ের জন্য, এখানে 'আদায়' শব্দটি বোধহয় যথাযথ নয়, প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার হলেন।

বস্তত লিঙ্গ এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্য একটি স্বতঃসিদ্ধ রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল, এতো অস্বীকার করার উপায় ছিল না, কিন্তু উপায় যেটা ছিল, সেপিয়েন্স প্রজাতির এক সিংহভাগ মানুষ তাই করলো; নিজের প্রবহমান ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে, নারী শ্রেণিকে অবদমিত করল আর এই কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত হলো কেবল মানুষের জান্তব বৃত্তির জন্য, এ কথা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে, মানুষ প্রজাতিতে পুরুষের অবদমন আদ্যন্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে। এই পৃথিবীর বেশিরভাগ পশু সমাজই মাতৃতান্ত্রিক ও উভতান্ত্রিক। হয়তোবা সেখানেও এক উল্টো রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলতেই পারে। প্রাণি বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। কিন্তু এই নারী অবদমনের ক্ষেত্রে মানুষের রাজনৈতিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক চেতনাকে দায়ি করলে, সিদ্ধান্তটি আপনার কাছে সম্ভবত অযৌক্তিক হবে না।

 ফলে ইরানকে নিয়ে লিখতে গিয়ে স্যাফো থেকে বিলকিস বানু পর্যন্ত বিস্তৃত তথ্য ভাণ্ডারের উপস্থাপন করাটাও অতিরেক বলেই বোধ হচ্ছে। তার চাইতে বরং একটা দিক মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।১৯৭৬ সালে লন্ডন রিভিউ অফ বুকস-এ জন গেরাসির সঙ্গে একটি কথপোকথনে সিমন দ্য বোভোয়া বলছেন,

"পুরুষের চোখে নারীর মুক্তি যে হুমকির প্রতীক, সেটাই তাদের নিরাপত্তা ঘুচিয়েছে, ফলে এর থেকে যে-ক্রোধের জন্ম হয়েছে সেটাই এখন এমন ব্যবহার করছে যেন যে সব মেয়ে বাড়িতে বসে থাকে তারাই 'ভালো' আর বাদবাকিরা সহজ চাঁদমারি। তারপর যখন দেখা যায় যে মেয়েরা মোটেই সহজলভ্য নয়, ছেলেরা তখন ব্যক্তিগত ভাবে চরম মোকাবিলার সামনে পড়ে যায়।"(মেয়েদের হার মেয়েদের জিত: সংকলন ও ভাষান্তর: সন্দীপন ভট্টাচার্য:মনফকিরা)

সিমন বলেছেন বলেই তাকে অখণ্ডনীয় বলে না করলেও এইটুকু অংশ পড়তে পড়তে আপনার কিন্তু এটা মেনে নিতেই হচ্ছে, মাশা আমিনির ঘটনাটি যেন একেবারে সংজ্ঞানুযায়ি ঘটেছে। অর্থাৎ ১৯৭৬ এ বসে, সিমন যা বলছেন এই বিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্হিতিতেও সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। তাহলে, পূর্ব উল্লেখিত নারী অবদমনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংযোগটা আর রইল কোথায়? কারণ '৭৬-র পর গ্লাসনস্ত ঘটেছে, মানচিত্রহীনভাবে, দেশের বিভেদ অতিক্রম করে শ্রমিকের উত্থানের আদর্শকে আক্রমণ করেছে বাণিজ্যের বিশ্বায়ন কিংবা গ্লোবাল কিংডম। এখন কয়েকটি পরিবার মিলে গোটা পৃথিবীর সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। নিচ্ছেও। এই পরিস্থিতিতে, উদারীকরণেও, নারীর একই পরিস্থিতি হলে, অর্থনৈতিক বিবর্তনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আর রইল কোথায়!

 একই কথপোকথনে সিমন কিন্তু আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রেখেছেন,
একজন নারীবাদী সংজ্ঞার্থেই বামপন্থী, তা সে নিজেকে বামপন্থী বলল কি বলল না তাতে কিছু যায়-আসে না। পরিপূর্ণ সাম্যের জন্য যে কোনও পুরুষের মতোই সমান গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা পাওয়ার জন্য সে লড়ে। ফলে লিঙ্গসাম্যের জন্য তার বিদ্রোহে শ্রেণিসাম্যের দাবিই মূর্ত। ...এ ভাবে, লিঙ্গসংগ্রাম শ্রেণিসংগ্রামকে মূর্ত করে, কিন্তু শ্রেণি-সংগ্রাম লিঙ্গগত সংগ্রামকে মূর্ত করে না।

নারীবাদীরাই প্রকৃতপক্ষে বামপন্হী। প্রকৃতপক্ষে, প্রথাগত ভাবে যাকে এখন আমরা রাজনৈতিক বামপন্থী বলি, নারীর অবস্থান আসলে তারও বাঁ দিকে।"(ঐ)

 এখানেই এসে ঠেকে যেতে হয়।আবিশ্বব্যাপী বিভিন্নভাবে বামপন্হী আন্দোলন চলছেই। মার্ক্সও সেই আন্দোলনগুলির অন্যতম একটির দার্শনিক। কিন্তু সিমন-এর কথা মেনে নিলে এ কথাও মানতে হয়, বামপন্থী আন্দোলন তার স্বরূপ এখনও ধারণ করতে পারেনি। প্রতিটা অর্থনৈতিক স্ফিয়ারেই তার সাপেক্ষে একটা করে বামপন্হা থাকে বটে, কিন্তু সমস্ত বামপন্হাই, নারীকে আবশ্যিক অবদমিত করে তারপর গড়ে উঠেছে-এ হেন সরলীকরণে বিশ্বাস না করলেও এ দেশে সবচেয়ে বেশি বামপন্থী আন্দোলন গড়ে যে দুটো অংশে অর্থাৎ বাংলা আর দক্ষিণে তো তার ফল অধরাই। তাই কৃষকের মুক্তি হয়তো ঘটেছে, নারীমুক্তি যে ঘটেনি সে তো শাখা-সিঁদুর পরে তালিবান বিরোধীতাতেই প্রমাণিত। এমনকি রাজনৈতিক বামপন্থীরাও ধর্মকে অতিক্রম করতে পারেনি, তার নমুনা ইতিউতি প্রভুত। সবটাই হয়েছে, 'নারীকে আর নদীকে' বশ্যতায় রেখে তবেই।

ইরানের মেয়েরা শরীর খুলে, চুলের পতাকা উড়িয়ে একটা বামপন্থী আন্দোলনের সূত্রপাত করলেন। মাশাকে একটা সূচক মনে করছি। যেভাবে হিজাবকে নস্যাৎ করে তথাকথিত নারীত্বের সংজ্ঞাকে অতিক্রম করছেন তাঁরা-একটা ঢেউ। একটা মারাত্মক ঢেউ।সেপিয়েন্স সভ্যতার গঠন কাঠামোয় মেয়েরা একটি অনিবার্য, ভয়ংকর অস্ত্র।তার নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হলে সম্পদের নিয়ন্ত্রণও কিন্তু ঢিলে হতে পারে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪৯.৫৮ শতাংশ মানুষ, যাঁদের ওপর মানুষের পরিচিত বংশগতি ও জন্ম প্রক্রিয়া অনেকাংশে নির্ভর, তাঁরা  চলিত পরিকাঠামোকে অস্বীকার করতে শুরু করলে কিন্তু ফল ঘটবে সুদূরপ্রসারী।এমনকি শাসক তাদের হত্যা করে থামাতে চাইলেও বিপদ। প্রয়োজনীয় জন্মহার বদলে মানুষ প্রজাতির আত্মবিনাশেরও কারণ ঘটতে পারে।

বিভিন্নভাবে বামপন্হী আন্দোলনের এরকম সর্বতঃপ্রসারী ও সুদূরব্যাপ্ত ফলাফলের কথাই তো আমরা স্বপ্নে দেখেছি,তাই না! জীবনানন্দ অবশ্য অনেক আগেই নির্দেশ করে গিয়েছিলেন,

"অনির্বচনীয় হুন্ডি একজন দু-জনের হাতে।
পৃথিবীর এইসব উঁচু লোকেদের দাবি এসে
 সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।"(উনিশশো ছেচল্লিশ সাতচল্লিশ)

ইরানের মেয়েরা ধীরে ধীরে সংগঠিত হয়ে উঠছেন। রাস্তাই তাঁদের সংগঠিত করে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে প্রাচ্য একত্রিত হবে।তার যাবতীয় রাজনৈতিক ব্যাকলগ ঝেড়ে ফেলে ভারতের মেয়েরাও, রাজনৈতিক ভাবে বামপন্থী মেয়েরাও যদি সেই ঢেউকে ধারণ করতে পারেন, তবে পদ্মা-সিন্ধুও বুক মেলে আছে কেঁপে ওঠা বুঝে নিতে।

মেয়েদের মানচিত্র নেই বলেই এটা সম্ভব হতে পারে। নতুন রাজনীতির স্বপ্ন দেখাচ্ছে ঐ চুলের পতাকা, আদিম প্রত্ন-প্রতিমার নিঃসংকোচ দাপটখানি। এই প্রতিবেদকের চোখে একটা সর্বনাশা উড়াল যেন, ঘন-গভীর উড়তে উড়তে কেবল মনে করিয়ে যাচ্ছে, মাশা আমিনি হিজাব পরেনি বলে তাকে থেঁতলে... থেঁতলে...থেঁতলে...থেঁতলে...থেঁতলে... মেরেছে 'উঁচু মানুষেরা'...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন