দোঁহা

যেকোনো নারী আন্দোলন রেনেসাঁ পথ সুগম করে

প্রচ্ছদ. মরজানে সতরপির 'পার্সেপোলিস'

শাম্ব

মাশা আমিন(২২)–এর মৃত্যু ইরানের কঠোর হিজাব আইন এবং নীতি পুলিশির বিরুদ্ধে মুক্ত চিন্তার যে প্রতিরোধ বপনে সক্ষম হয়েছে তা আসলে বিশ্ব নারী মুক্তি আন্দোলনের যে ধারাবাহিক ইতিহাস তার সময় কেন্দ্রীক পুর্নবপন বলেই মনে হয়।

চিরাচরিত স্থবিরতাকে টালমাটাল করে সামাজিক ভূ-কম্পনের প্রয়োজনে যে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পথ তৈরি হয়, বলা বাহুল্য তা সর্বদা একটি রেনেসাঁকেই চিহ্নিত করে। কিন্তু সেই পথ ঠিক কতোদূর গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে তা সততই প্রশ্নের।

কারণ দমন-পীড়ন নীতি প্রয়োগে যেকোনো মুক্তচিন্তাকে পুনরায় স্থবির করে দেওয়ার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার অভিজ্ঞতাও ইতিহাসে কম নেই।

১৯০৫ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ইরানে যে সাংবিধানিক বিপ্লব বাস্তবায়িত করা হয়েছিল সেখানে লিঙ্গ বৈষম্যের স্পষ্টতাকে নির্দিষ্ট করা এবং তা দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করার যে উদগ্র প্রয়াস তার বিপরীত মেরুতেই গড়ে উঠেছিল 'সোসাইটি অফ উইমেন্স ফ্রিডম'-এর মতোন সংগঠন গুলি।

১৯১০ সালের পরে মহিলা দ্বারা পরিচালিত প্রথম জার্নাল প্রকাশিত হয় ইরানের মাটিতে। কিন্তু ১৯৩৩ সালের পরে রেজা শাহ পাহলভীর সরকার দ্বারা ইরানের সর্বশেষ মহিলা সমিতিকে ভেঙে দেওয়া হয়।

পাহলভীর শাসনকালে কাজার রাজবংশের আমলের ইরানিয় নারীদের যে বিচ্ছিন্নতা এবং অধিকার হীনতার ইতিহাস তার কিছুটা অবস্থাগত পরিবর্তন হয়েছিলো ইউরোপীয় ভাবধারায়। কিন্তু পাশ্চাত্যপন্থী দেশ থেকে ইসলাসমীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পরে নারীদের সমস্ত স্বাধীনতা পুনরায় প্রত্যাখ্যান করা হয়।

প্রধানত এক-তান্ত্রিক ধর্মীয় রাজনীতিকে পাথেয় করে গড়ে ওঠা যেকোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থার অভ্যন্তরে যে মৌলবাদী চিন্তাধারা থাকে তা চিরস্থায়ী করে তোলার প্রধান উপায় নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।

এর প্রধান তিনটি কারণ চিহ্নিত করা যায়,

প্রথমতঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে 'গড় নারীদের সামাজিক অবস্থান আজও অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং অপেক্ষাকৃত দূর্বল' এই ধারণাকেই ধারাবাহিক ভাবে সামাজে লালন করা হয়েছে। ফলে যেকোনো মৌলবাদ'ই তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের প্রধান অবলম্বন হিসেবে নারীদেরই চিহ্নিত করে।

দ্বিতীয়তঃ এই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যৌনতার ধারণা এখনও স্পষ্ট নয় বা বলা ভালো যৌনতা সম্পর্কে সামাজের একটা বড়ো অংশের মনস্তাত্বিক শিক্ষা একেবারেই নেই। নারী দেহ অধিকার বা 'শিকার' একপ্রকার পুরুষ ক্ষমতায়নের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং যৌনতার ধারণা হিসেবে এই একতান্ত্রিক মতামতকেই সামাজে মান্যতা দেওয়া হয় বেশি।

তৃতীয়তঃ কোনো দেশের নারীরা শিক্ষিত ও মুক্তচিন্তার অধিকারী এবং আত্মনির্ভর হলে তারা ভবিষ্যত প্রজন্মকেও অপেক্ষাকৃত বেশি প্রভাবিত করতে পারে।
যার ফলে সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্থবিরতার বিরুদ্ধে বিপরীত মতের প্রতিষ্ঠা হবে, যা রাষ্ট্র ক্ষমতার কাছে অত্যন্ত বিপজ্জনক।
প্রসঙ্গত নেপোলিয়ন বোনাপার্টের একটি মন্তব্য লক্ষনীয়,

     “You give me an educated mother, I will give you an educated race”

   এই শিক্ষিত জাতীর প্রতিষ্ঠাই যেকোনো মৌলবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে অস্বস্তির বিষয়। সেটা ইরানের শরিয়তী আইন কিংবা মনুসংহিতা অনুযায়ী বর্তমান ভারতের সমজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, যাইহোক—
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালের 'গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ'–এর রিপোর্টে ১৪৪ টি দেশের মধ্যে ১৪০ তম স্থানে রয়েছে ইরান। অন্ধত্ব থেকে মুক্তির আন্দোলনের আগুনে সর্বত্রে যে আলো লাগে সেখান থেকেই রেনেসাঁর সূচনা হয়। একটি পরিপূর্ণ সফল নারী মুক্তি আন্দোলনেই এই নবজাগরণের পথ প্রসস্থ করতে পারে।

মোহতারমা ইসকান্দারির মতো ইরানিয় নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ—এঁর হাত ধরে 'জমিয়াত-ই-নেসভান বাতিনখায়ের'—এর মতোন গড়ে ওঠা পত্রিকা ও সংগঠন গুলি নারী শিক্ষা, পর্দা অপসারন, নারীর অধিকার অর্জনের যে আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন তার মধ্যেই হয়তো নিহিত ছিলো আজকের জ্বালানি সমূহ।

১৮২৯ সালের সতীদাহ প্রথা বিলোপ আইনের মধ্যে দিয়ে বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের যে ঢেউ উঠেছিলো তার ছোঁয়া লেগেছিলো প্রায় সর্বক্ষেত্রেই।
কিছু ব্যাক্তিমত একে রেনেসাঁ বলে চিহ্নিত করতে চাইলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে এই ঢেউ কেবল সামাজের একটি শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গেলো। ফলে নারীদের অবস্থাগত পরিবর্তন হলেও সামাজিক ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য কর্কট রোগের মতো দানা বেঁধে রইলো গোপনে।
ফরাসী লেখক ও দার্শনিক সিমান দ্যা বোভেয়ারির কথায়,

“সব ধরণের শোষণই যুদ্ধাবস্তার সৃষ্টি করে”

ইরানের বর্তমান নারী আন্দোলন সেই যুদ্ধাবস্তারই দিকনির্দেশ করছে, যা থেকে একটি প্রকৃতি রেনেসাঁর জন্ম হতে পারে।যার ঢেউ লাগবে বিশ্বব্যাপী সমাজের সর্বস্তরে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন