![]() |
প্রচ্ছদ. মরজানে সতরপির 'পার্সেপোলিস' |
মালবিকা মিত্র
ইরানে একদল যখন বলছে মহিলাদের হিজাব পরতেই হবে, আমাদের দেশে অন্য একদল বলছে মহিলাদের হিজাব পরা চলবে না। খটকা লাগবে, প্রথম পক্ষ যদি মৌলবাদী গোষ্ঠী হয় তবে দ্বিতীয় পক্ষ কি গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক? বিষয়টা জট পাকানো।
ঘটনা হলো ইরানে হিজাব না পরার অপরাধ, মাহশা আমিনীর মৃত্যু, সেদেশে এক নারী জাগৃতির জন্ম দিয়েছে। মেয়েরা প্রকাশ্য রাজপথে হিজাব ত্যাগ করছেন ও চুল কেটে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এই প্রতিবাদ অবশ্যই কুর্ণিশ যোগ্য। নারীর অধিকারের প্রশ্ন। আমার পোশাক পরার ও ভিন্ন পোশাক পরার অধিকার, ভিন্ন রুচির অধিকার গণতান্ত্রিক অধিকার।
মৌলবাদী ফতোয়ার প্রতিবাদ করার অর্থ হিজাবের বিরোধীতা নয়। হিজাব পরতে বাধ্য করার বিরোধিতা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ কারো রুচির উপর খবরদারি করতে পারে না। সেই নিরিখে ইরানের নারী আন্দোলন সমর্থন যোগ্য। কিন্তু ভয়টা অন্যত্র।
একটা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা অধিকার যখন সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে মাথা তোলে, তখন সেটা খুব শালীন শিলীত সুনিয়ন্ত্রিত হবে এমনটা আশা করা কঠিন। স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আর পশ্চিমা বাতাস এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। তারা হিজাবের দাসত্বের বিরুদ্ধে দাঁড় করায় বিকিনির মুক্তি। আমার চোখে যা আর একটি মৌলবাদ।
কারণ আমি কখনো বিস্মৃত হতে পারিনা টেনিস তারকা বরিস বেকার, ইভান লেন্ডল এর পোশাকের সাথে স্টেফি গ্রাফের পোশাকের পার্থক্য। তার সকলেই টেনিস তারকা। উদ্দেশ্য মূলক ছিল সেই পার্থক্য। আরও পরে মনিকা সেলেসের যুগে বিজ্ঞাপনে সরাসরি নারী শরীর পণ্য হয়ে ধরা দিয়েছে। পশ্চিম বলে, তুমি স্টেফি মণিকা সেরেনা যেই হও না কেন, আসলে তুমি আমার চোখে নারী। ঠিক এখানেই আশঙ্কা জাগে। পশ্চিমা হাওয়া মাহশা আমিনের মৃত্যু কে হাইজ্যাক করবে না তো।
ইতিমধ্যেই উদারনৈতিক প্যারিসে হিজাবের ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। কর্নাটকে হিজাব পরিহিতা মুশকান "জয় শ্রী রামের" তাড়া খেয়েছে। হিজাব পরতে দেবো না ক্ষমতার এই আস্ফালন কোনো ভাবেই মানা যায় না। মূলগত ভাবে হিজাব বিতর্কের দুটি পক্ষই ভিন্ন রুচির অধিকার স্বীকার করে না। একজন নারী হিজাব পরবে বা পরবে না সেটা সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে।
ইরান আর কর্নাটকের নারী জাগৃতি যদি না একসূত্রে গাঁথা পড়ে তবে এই লড়াইয়ে র চূড়ান্ত সাফল্য আসবে না। গোড়ার প্রশ্নটা হলো ভিন্ন রুচির অধিকার। পোশাকের সীমা ছাড়িয়ে আরও আরও মানুষের অংশ গ্রহণ ঘটুক। দাবি উঠুক, আমি ভেজ নাকি নন ভেজ খাবো সিদ্ধান্ত আমার। আমি কাকে ভালোবাসবো লাভ জিহাদ আইন করে সেখানে হস্তক্ষেপ চলবে না। আমি হাই হ্যালো নমস্কার বলবো নাকি জয় শ্রীরাম বলবো আমি ঠিক করবো। শবযাত্রায় হরিবোল ধ্বনি দেবো, নাকি "চিরসখা হে ছেড়োনা" গাইবো নাকি রাম নাম সত্য হ্যায় বলবো সেটাও আমার সিদ্ধান্ত।
জনজীবনের এই বৃহত্তর পরিসরের প্রশ্নগুলো হিজাব বিতর্কের সাথে সম্পর্কিত। শুধু তো গো মাংসের প্রশ্ন নয়, মাছ মাংস ডিম সামগ্রিক ভাবে বর্জনের তালিকায় আসছে, কোথাও কোথাও এসেছে। মনে রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রী লুঙ্গি পাজামা দেখে জঙ্গি চেনেন, আর কৈলাশ বিজয় বর্গী চিড়ে খাওয়া দেখে বাংলাদেশী জঙ্গি চিনেছেন। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পোশাক খাদ্যাভ্যাস সামাজিক মেলামেশা সম্বোধন এই সব কিছু, এক কথায় আমার স্বাতন্ত্র্য, ভিন্ন রুচির অধিকার সংকটের সম্মুখীন। কর্ণাটকের পথে মুশকান তাড়া খাবার অনেক আগেই উত্তর প্রদেশে লাভ জিহাদিদের হাতে প্রাণ হারালো কতো রামি চন্ডিদাস।
অতএব মাহশা আমিনের মৃত্যু হিজাব খুলে চুল কেটে অন্তর্বাস পোড়ানোর আন্দোলনের অন্ধ গলিতে যেনো পথ না হারায়। এই আন্দোলন টেনে আনুক বৃহত্তর সামাজিক পরিসরের স্বাতন্ত্র্য ও ভিন্ন রুচির অধিকার কে। যে কোনো একমাত্রিক নির্দেশ ও ঘোষণা কে সজোরে বলুন-না।