নার্গিস পারভিন
মাহশা আমিনীর মৃত্যু কোন হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। দীর্ঘ কয়েক দশক জুড়ে (১৯৭৯ পর থেকে) ইরানের সরকার ইরানের নারীর উপর একের পর এক যে বিধি নিষেধ আরোপ করে আসছিল মাহশা আমিনীর মৃত্যু যেন তার সর্বোত্তম পর্যায়। নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক হিজাব, বিবাহের বয়স ১৮ থেকে প্রথমে ১৩ পরে ৯-এ নামিয়ে এনে আইন প্রণয়ন করা, পুরুষের ক্ষেত্রে একের অধিক বিবাহের (পলিগামি) আইনি সম্মতি প্রদান, পুরুষের ক্ষেত্রে সহজ তালাক দেওয়ার প্রথাকে সম্মতি দেওয়া, অন্যদিকে নারীর ক্ষেত্রে তালাকের নিয়মকে জটিল করে আইনের বেড়াজালে নারীকে আটকে রাখা-এই সব কিছু নিয়ে ইরানের নারীর জন্য ঘরের কোন টুকুও কি সুরক্ষিত ছিল? ছিল না। মাহশা আমিনীর মৃত্যু তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। মাহশা আমিনীর মৃত্যু তাই আজ সব আগল খুলে দিয়েছে যেন। ইরানের মানুষের মুখে এখন একটাই স্লোগান 'হয় স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু'। তাই হয়তো মাহশা আমিনীর পরেও প্রতিবাদের আগুনে আহুতি দিয়েছে আরো অনেকগুলো প্রাণ! সেই সংখ্যাটা যে কত তার সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো কখনোই জানা যাবে না।
আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে আমার ১০ বছর আগের ইরানি বন্ধু খাদিজার কথা। ২০০৯-২০১১ সালে জাপানে থাকাকালীন সময়ে আলাপ হয়েছিল খাদিজার সঙ্গে। খাদিজা যেমন বুদ্ধিমতী পরিশ্রমী তেমনি সুন্দরী। ওকে দেখে মনে বাজতো সেই নজরুল গীতি "ইরানি বালিকা যেন মরু চারিণী" কিংবা "নাচে ইরানি মেয়ে পাহাড়পুরের যেন ঝরনা ধারা"। ইরানের মরুভূমির বুকের বাদামী চোখের, সোনালী চুলের, এই নারী যথাযথভাবেই নজরুল গীতির ঐই পংক্তির সঙ্গে মিলে যেত যেন। সত্যি বলতে ইরানী বালিকা বললে আমাদের মনে কখনোই হিজাব পরিহিতা কোন নারীর ছবি নিশ্চয়ই ভেসে ওঠে না। ভেসে ওঠে মাহশা কিংবা খাদিজার মতই কোন সুন্দরী ইরানি নারীর প্রতিচ্ছবি। যাইহোক খাদিজার সবথেকে বেশি যে জিনিসটিতে আমি আকৃষ্ট হতাম তা ছিল ওর ভাবনা চিন্তার উদারতা। ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতাম। কখনো পার্কে কখনো আমার ফ্ল্যাটে চলে আসত ও কখনো আমি ওর ফ্ল্যাটে চলে যেতাম। আমাদের সামনে প্লেটে থাকতো লাল তরমুজের বড় বড় টুকরো কিংবা উষ্ণ কফি। কখনো বা জাপানের সুপার মার্কেট থেকে কিনে আনা চিকেন কাটলেট। সেসব চিকেন হালাল নাকি হালাল নয় সেসবের খোঁজ কখনো নিতে দেখিনি খাদিজাকে। বলা যেতে পারে সেই দু'বছর খাদিজা তার নিজের জীবনটা নিজের শর্তে যাপন করছিল। নিজেই ছিল সে নিজের মর্জির মালিক। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করা খাদিজা তার খাওয়া, পরা, ওঠাবসা সবেতে উপভোগ করছিল তার জীবনের পূর্ণ স্বাধীনতা। সেখানে ছিল না কোনো সরকারের শাসন দণ্ড, ছিল না কোনো নীতিপুলিশের লালচোখ। দু'বছর পর খাদিজা যখন তার দেশে ফিরে গেল, আমাদের সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। ইরানে ফিরে খাদিজা আবার বোরখা কিংবা হিজাবের মধ্যে ঢুকে যাবে। সে কোন সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকবে না। ইউটিউব দেখবে না। অর্কূটে থাকবে না। করবে না ইমেলও। কারণ সবেতেই থাকবে সরকারী প্রহরা। কোথাও থাকবে না নিজস্ব স্বাধীনতা। সেই ভাবে আর যাইহোক মন খোলা যায়না। খাদিজা ভীষণভাবে চাইত পূর্ববর্তী ইরানকে ফেরত পেতে। যে ইরান মেয়েদের শিক্ষার পক্ষে ছিল, যে ইরানে নারী পুরুষের অধিকারে বৈষম্য ছিল না। যে ইরানে পলিগামি নিষিদ্ধ হয়েছিল। যে ইরানে নারী নিজের পছন্দ-অপছন্দকে মর্যাদা দিতে পারত। আমি কল্পনা করতে থাকি, আজ ইরানের নারীদের এই সম্মিলিত প্রতিবাদে নিশ্চয়ই খাদিজাও আছে। হয়ত ঝড় থেমে গেলে খাদিজাও প্রাণ ভরে মুক্তির স্বাদ নেবে!
আসলে প্রসঙ্গটা হিজাব কিংবা বোরখা পরিত্যাগ করা নয়। আন্দোলনটা আসলে নিজের পছন্দের অধিকার অর্জন করা। খাদিজাকে নিয়ন্ত্রণ করে তার সরকার, তার সমাজ। তার পছন্দ অপছন্দের কোন মূল্যই সে পায় না। আর তাই মাহশা কে মৃত্যুবরণ করতে হয়। দেশ-কাল-কাঁটাতারের গণ্ডি ছাড়িয়ে আমাদের চারপাশে আমরা অহরহ দেখতে পাই এমনই সব দৃশ্য। একই পরিবারের মানুষ হয়েও সাধারণত দেখা যায় বাড়ির পুরুষটি নিজের পছন্দ অনুযায়ী প্যান্ট, শার্ট, টি-শার্ট, ট্র্যাকপ্যান্ট, স্যান্ডো, বারমুডা যা খুশি পরে যেখানে খুশি বেরিয়ে যাচ্ছে। সেই বাড়ির মেয়ের ক্ষেত্রে আরোপ করা হয় হাজার বিধি নিষেধ। হয় তাকে শাড়ি পরতে হবে, ঘোমটা দিতে হবে, নয় তাকে বোরখা পরতে হবে। নিদেনপক্ষে ওড়না নিতে হবে। আর নারীর সেই পোশাক পরিচ্ছদ নির্ধারিত হবে সেই বিবাহিত নারীর শ্বশুর বাড়ির অন্যান্য সদস্য দ্বারা। হতে পারে তিনি শ্বশুর, শাশুড়ি, এমনকি দাদি শাশুড়ি বা দাদা শ্বশুর পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে এ বিষয়ে। শ্বশুরবাড়ি তথাকথিত উদার মনের হয় তাহলে সেই নারী বিবাহের পর জিন্স-স্কার্ট, টপ-টিশার্ট' স্লিভলেস পরার অনুমতি পায়। একটা বিষয় লক্ষ্য করা খুব প্রয়োজন যে এই বর্তমান সময়ে এসেও নারীর নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের কোন মূল্য নেই। তাকে কেবল মানিয়ে নিতে হবে। অথচ পুরুষের এমন সব হারকত আছে যা নারীর একেবারেই পছন্দ নয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারবে না নারী। একটা উদাহরণেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে, যেভাবে পুরুষরা, তিনি শ্বশুর, ভাসুর, দেওর, কিংবা অতিথি যেই হোকনা কেন স্নানের শেষে একবাড়ি লোকের সামনে একখানি ভিজে তোয়ালে কিংবা গামছা পরে যেভাবে ঘোরাফেরা করেন, আমার মনেহয় সেটি যেকোনো মহিলার কাছেই খারাপ লাগার বিষয়। সেটুকু ভব্যতাও পুরুষরা দেখান না বাড়ির মহিলাকে। এমন কোন সামাজিক নিয়ম তৈরি হবে না যেখানে পুরুষের এই হারকত্ বন্ধ হয়। উল্টে নারীকেই হিজাব কিংবা ঘোমটা পড়তে হবে। তার নিজের বাড়িতে তার চোখকে শাসনে রাখতে হবে। তার ভালো না লাগলে সে চোখ বন্ধ করে রাখবে।
নারীকে শিক্ষা নিতে হবে তার বাড়ি থেকে, তার সমাজ থেকে, তার পরিবার থেকে। অবশেষে সরকারও নারীকে শিখিয়ে দেবে নারী হিজাব পরবে না পরবে না! ঘোমটা দেবে, না দেবে না! ওড়না নেবে না নেবে না! এই সব কিছু নারীকে শিখতে হবে অন্যের কাছ থেকে! তার নিজস্ব পছন্দের কোনো মূল্যই দেবেনা সমাজ, পরিবার, সরকার কিংবা শাসন যন্ত্র। তাই আজ মাহশা আমিনী এই ২০২২ সে এসেও মৃত হয়ে যায়। তাই আজ ইরানের প্রতিটি নারীর চোখে মুখে খাদিজার আর্তনাদ শোনা যায়। তাই আজ মুসকান কে লাঞ্ছিত হতে হয়। তাই আজ নারী সব ভুলে, সব ভাবনা ছেড়ে, সব ভয়কে ত্যাগ করে মরিয়া। তাকে তার অধিকার বুঝে নিতে হবে। এই আন্দোলন তাই হয়ে উঠেছে ইচ্ছার অধিকার অর্জনের আন্দোলন। আচ্ছা, আমরা পারিনা সমাজকে সেই শিক্ষা দিতে যেখানে নারী-পুরুষ সকলেই শিক্ষার আলোকে আলোকিত হবে, স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠবে একটি সুষম সমাজ।
পুরুষের পাশাপাশি নারীও আত্মসম্মানের সঙ্গে জাহির করবে নিজস্ব পছন্দ।