দোঁহা

ক্ষমতার নিষেধাজ্ঞা এবং নারী, অতঃপর...

 

প্রচ্ছদ. মরজানে সতরপির 'পার্সেপোলিস'

সারমিন রহমান

‘পুড়বে নারী/উড়বে ছাই/তবেই নারীর গুণ গায়’—
পুরুষতন্ত্রের কাঠামোয় ঋদ্ধ এই প্রচলিত বাক্য বা প্রবাদখানি ইদানীন্তন কালে প্রযুক্তির প্রজন্মের বা ‘নেট-নাগরিক’দের কাছে হাস্যকর, ক্লিশে বা সেকেলে মনে হলেও, আদতে বহু যুগ ধরে এই প্রত্ন পরিকাঠামোকেই কি অন্তরে লালন করে আসছি না সযত্নে? যাঁরা সে কাঠামোকে অস্বীকার করেছেন, করছেন বা সেই অচলায়তনকে ভাঙবার সাহস রেখেছেন, রাখছেন, তাঁদের জন্য বর্ষিত হতে দেখেছি এবং দেখছি নির্বোধ ক্ষমতার আস্ফালন। লিঙ্গভিত্তিক আলোচনা-পর্যালোচনায় এখন আমরা প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ হই, স্নাত হই। কিন্তু ভাবনার শুদ্ধি হয় কি? হয়েছে কি? হচ্ছে কি?

বছর বাইশের ইরানী তরুণী মাহশা আমিনি হিজাব ও নিকাব না পরার অপরাধে সেখানকার পুলিশি অত্যাচারে মারা যান। (দ্রষ্টব্য—আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ ও ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২, পৃষ্ঠা সংখ্যা যথাক্রমে ১০, ১০) তারপর ওই একটা মৃত্যু অজস্র প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তারও ফলস্বরূপ আরও কিছু প্রাণ হত হয়েছে। এই ন্যক্কারজনক সংবাদ এবং তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ হিজাব পুড়িয়ে ইরানসহ পৃথিবীর নানান দেশে প্রতিবাদের আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। ইদানীং প্রযুক্তির দৌলতে তা ইরানের ভূগোল ছাড়িয়ে সবখানে আলোড়ন তুলেছে। এ তো হালের খবর। প্রাচীন উদাহরণের খুব যে অভাব তা নয়, বরং তা এতোই সংখ্যাতীত যে এই দীর্ঘ নারী লাঞ্ছনার ইতিহাস আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে ‘নারী’ এমন একটি বিশেষ শ্রেণি, একটা বিষয়, একটা বস্তু, যাকে প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনেও অনায়াসে লাঞ্ছনা করা যায়।
 
আদতে রাজনীতির অন্যতম দুটি মূল স্তম্ভ—ধর্ম এবং লিঙ্গ। ধর্মের প্ররোচনায় রাজনীতির যে মুনাফা আসে, নারী নামক বিশেষ বস্তুটির ক্ষেত্রেও তার প্রয়োগের প্রভাব অনেক বেশি। তাই সাম্প্রদায়িক ধর্মের নামেও সর্বাধিক বেশি লাঞ্ছিত, ধর্ষিত, খুন হয় এই বিশেষ জীবটি— ‘নারী’। একটা উদাহরণ অন্তত দেওয়া যাক। দেশভাগের সময় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলো। রাজনীতি ব্যবহার করলো ধর্মকে। মাথায় গেঁথে দেওয়া হলো সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বীজ। সবই হলো। হিন্দু-মুসলমানের চিরাচরিত সহাবস্থানে চিরস্থায়ী তিক্ততা এলো, মানুষ ভিটেহারা হলো, কাঁটাতারে স্বাধীনতা এলো। মৃত্যু উপত্যকার নির্মাণ হলো। আর কী হলো? ভুগলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। ক্ষুধা-তৃষ্ণায়, নির্বিচারে হত্যা আর রক্তের ক্লান্তিতে। কিন্তু এসবের মধ্যে নারী মরল আরও একটা কারণে— লজ্জায়। বুভুক্ষু পুরুষের ক্ষুধায়, অবমাননায় নারীর মৃত্যু হলো এভাবেও— “The political partition of India caused one of the great human convulsions of history. Never before or since have so many people exchanged their homes and countries so quickly...As always there was widespread sexual savagery: about 75,000 women are thought to have been abducted and raped by men of religions different from their own (and indeed sometimes by men of their own religion.” (The Other Side of Silence by Urvashi Butalia)
 
‘নারীর কোন দেশ নেই’...
আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা শুক্রবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২— পৃ. সংখ্যা ৫ এ বারো বছরের এক নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে তিন অভিযুক্ত গ্রেফতারের সংবাদ প্রকাশিত হয়। (খুব স্বল্প পরিসরে। স্থানের উল্লেখ পাই বসিরহাট, শিয়ালদহ)
আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা শুক্রবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২—পৃ. সংখ্যা ১০ এ অন্তঃসত্ত্বাকে গণধর্ষণের খবর পাই উত্তরপ্রেদেশের বরেলীতে। ওই একই পৃষ্ঠায় উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদেই আরও এক গণধর্ষণের চিত্র উঠে আসে।  
আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা শুক্রবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২— পৃ. সংখ্যা ৭ এ ‘পাড়া থেকে তুলে ‘গণধর্ষণ’ কিশোরীকে’ (স্থানের উল্লেখ পাই বসিরহাট) ইত্যাদি।
যে গুটিকয়েক ঘটনার উল্লেখ করা হলো তার ভূগোল ভারতবর্ষ, আরও একটু স্পেশিফিক করে দিলে পশ্চিমবঙ্গ। উনিশ শতকে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে যারা (নারীরা)  সচেতন হয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে এসেছেন, বিশ শতকে যখন বদলে যাচ্ছে লিঙ্গ পরিচয়ের গতানুগতিক ভাবনা, আমেরিকায় তখনই আবিষ্কৃত হয়েছে গর্ভনিরোধক পিল, গর্ভপাতকেও তখনই ধীরে ধীরে বৈধ ঘোষণা করার ব্যবস্থা নেওয়ার আরম্ভ হয়ে গেছে, এমনকি এক সমাজবাদী নারীর কলম লিখছেন—“সে স্বাধীনতা কোনো স্বাধীনতাই নয় যেখানে নারীর তার নিজের দেহের ওপর সম্পূর্ণ অধিকার নেই। নারী যদি তার শরীরকে তার নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে তাহলে সে দাস ছাড়া আর কিছু নয়।”(মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়, “বাঁধন ছেঁড়ার সাধন”) এই সমস্ত ভাবনার পরেও একবিংশ শতক আমাদের দৈনন্দিনতায় এসব দেখায়। সেই চিরাচরিত পুরাতন পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোটি যে একবার পেরেক দিয়ে গেঁথে ফেলা হয়েছে সেটার আর অপসারণ তো দূরের কথা তার আপডেশনটুকুও হয় না। আসলে ইতিহাস খুঁড়ে মহিমান্বিত বিপ্লবের গল্পে বা বিপন্নতার অতীতের উদাহরণ তুলে ধরে এর কোনো সমাধান হবে না। প্রতিদিন নতুন করে মানসিক সংস্করণ না হলে বিপন্নতার চিত্র যেমন তৈরি হবে, তেমনি পৃথিবীর কোনো একটা ভূগোলে নয়, সব দেশেই হিজাব পুড়বে। আসলে নারীর মুখ্য পরিচয় শুধু যদি হয় শরীর দিয়ে, তাহলে ক্ষণে ক্ষণে বিপদের সম্ভাবনা। নারী মানে স্তন, যোনি—শরীর, সম্পত্তি, জিনিস? নারীকেই সুন্দর হতে হয়, সুন্দর হতে হয় বাজারনীতির হিসেবে। চকচকে, মসৃণ, নিদাগ ত্বক, পরিপাটী, সুশ্রী। বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা। সে সৌন্দর্যের অর্থ কী? বাহ্য কাঠামোর পরিপাট্য। নির্দিষ্ট শরীরের মাপ। এতটুকু এদিক-ওদিক নয়। আর ‘Beauty with Brain’ এও তো সেই কাঠামোরই নির্মিত বুলি। আসলে নারী যতদিন যৌনতা পরিমাপের একক বলে গণ্য হবে, ততোদিন এই নীতি পুলিশি চলবে। তার জন্য প্রশাসনিক পরিচয় প্রয়োজন নেই। বন্ধু, প্রেমিক, স্বামী, প্রতিবেশী, রাস্তার অচেনা কোনো পুরুষ যে কেউ নারীকে নিদান বা বিধান দেবে। আর ধর্মগুরুরা তো আছেনই। লিঙ্গগত পরিচয়ের ধারণা সমাজের সমস্ত স্তরে না পৌঁছনো পর্যন্ত এর থেকে মুক্তি নেই। মুখে আওড়ালাম নারীপুরুষে ভেদ নেই আর মস্তিষ্কের পরতে পরতে প্রতিনিয়ত গাঁথলাম পুরুষতন্ত্রের বীজ, তাতেই বিড়ম্বনা উত্তরোত্তর বাড়ছে।
 
আসলে এসব কিছু নতুন কথা নয়। পুরাতন কথাদেরই চর্বিতচর্বণ। কিন্তু এই লাঞ্ছনার এই নির্মম ইতিহাসের যে ইতি টানা যাচ্ছে না। ধর্মের নামে যে রাজনীতি চলছে, তাতে জুড়ে যাচ্ছে লিঙ্গ রাজনীতি। ‘নারী’ বারংবার শুধু ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইতিহাস তার সাক্ষ্য। এসবের ভিত্তিতেই একসময় নারীবাদের উদ্ভব। তার পশ্চাদ্‌পটের পর্যালোচনার ইতিহাস সুগভীর এবং ব্যাপক। তথ্যসূত্রে জানতে পারছি, ছয়ের দশককে নারীমুক্তির দশক বলা হলেও নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলন আরম্ভ হয় ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই। আর উনিশ শতক থেকেই ভোটাধিকার, কাজ ও শিক্ষার অধিকার, মজুরি বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা দাবি নিয়ে শ্রমিক নারীরা সংগঠিত আন্দোলনে নামে। ষাটের দশকে এইসব অধিকার পেলেও মেয়েরা দেখল ‘সম্পূর্ণ এক ব্যক্তিমানুষের স্বীকৃতি তারা পায়নি।’ কোথায়, কীভাবে তারা এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েছে—ইতিহাস এবং জীবন তার সাক্ষ্য। কিন্তু প্রশ্ন এ শতকেও, এখনো কি নারী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মর্যাদা পেয়েছে? পাচ্ছে? ঠিক এর আগেও নারীবাদ এবং নারীবাদীদের যেভাবে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। বর্তমান প্রশ্নটিও সেই একই সমালোচনার মুখোমুখি হবে। তবুও এ প্রশ্নটা থাক। বরং আরও কতকগুলো পুরাতন প্রশ্ন প্রতিদিন আওড়াতে থাকি নিজেরা নিজেদের কাছে—

এক. নারী-পুরুষের সমানাধিকারের দাবিতে উদ্ভূত একটা ভাবনা একটা বিশেষ মতবাদ (নারীবাদ) হিসেবে পরিচিত হল। নারীবাদকে কেন্দ্র করে তর্ক-বিতর্কের জন্ম হলো। নারীবাদকে বুঝতে বিশেষ বিদ্যাচর্চার আয়োজন হলো—মানবীবিদ্যা। উনিশ শতক থেকে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যে নারীর অধিকার বুঝে নেবার জন্য নানান প্রতিষ্ঠান এবং আন্দোলন গড়ে উঠল। এতদ্‌সত্ত্বেও এই শতকে দাঁড়িয়ে এখনো কেন পোশাক বিতর্ক আসে? এবং সেটা মূলত নারীর পোশাক নিয়ে? উপরন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে? লিঙ্গ সাম্যের ভাবনা কি শুধু ভাবনার স্তরেই থেকে যাবে নাকি তার যথাযথা প্রয়োগে প্রয়াসী হবো?
ভাবাটা প্র্যাকটিস করে ফেলতেই হবে এইবেলা। শেষে এটুকু বলতে চাইবো সভ্যতার প্রতীকী হিসেবে আদিম আদুল শরীরে প্রথমে গাছের বাকলে কিংবা পত্রে তারপর নিরন্তর বুদ্ধির বিকাশে বস্ত্রের আচ্ছাদন আসে। আসলে নগ্নতা তো মনের অন্দরমহলে। নগ্নতা আমাদের অসংযমে। আমাদের সব বাহ্য চর্চা। আমাদের শুধু আমারটুকু বুঝে নেওয়া। এই আমারটুকু বুঝে নিতে নিতে ‘দিনকাল খুব খারাপ বলে’ নিজেদের দায় এড়িয়ে যাওয়া। আর এই দায় এড়িয়ে যেতে যেতেই বিভাজনের রাজনীতির পথটা খুব মসৃণ হয়ে যায়। যত বিভাজন ততো সুবিধে। কিন্তু ক্ষমতার স্বার্থ এবং দম্ভ যে ভুলে যাচ্ছে ‘নগর পুড়িলে দেবালয়’ও এড়ায় না। তাই হত্যা দিয়ে প্রতিবাদের কন্ঠ রোধ করা যায় না। যাবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন