দোঁহা

বন্ধ জানালা



অন্তরা চৌধুরী

প্রসাধনের পসারের মাঝে দাঁড়িয়ে বাছাই করা জামা কাপড়গুলি আয়নায় দেখে একটি একটি করে  যাচাই করে নিচ্ছি কতটা মানানসই হচ্ছে। হঠাৎই আয়নার ফ্রেমে ধরা দিল আর একটি চরিত্র। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, এটি একটি ঝা চকচকে শপিং মলের আন্তর্জাতিক মানের বিখ্যাত ব্র্যান্ডেড স্টোর, যেখানে মহিলাদের প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাওয়া যায়। "Excuse me" মৃদু আবেদনটি পেছন থেকে আসায় আয়নার অধিকারটি অগত্যা পরিত্যাগ করতে হলো। যেতে যেতে এক ঝলক দেখলাম। বছর তিরিশেক হবে । সাজ পোশাকে অতিমাত্রায় আধুনিকা। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অব্দি ব্র্যান্ডে মুড়ে আছে। আপাততঃ ছোট পোশাকের নিরীক্ষণ চলছে আয়নার সামনে। যাইহোক, প্রায় ঘন্টাখানেক পরে আমার গুটিকয় সামগ্রীর দাম দিতে ক্যাশ কাউন্টারের সামনের লাইনে দাঁড়ালাম, আগে জনা চার পাঁচেক। আমার সামনে আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকায় এক নারী। বিল পেমেন্টের জন্য তিনি যখন মুখের পর্দাটি সরালেন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, মনে হল মাথাটা যেন একটু ঘুরে গেল। বোরখার আড়ালে থাকা ইনি তো সেই ক্ষণিক আগের দেখা অতি আধুনিকা নারী। এখন প্রশ্ন হল, একই ধর্মের গণ্ডিতে থেকে কোন মহিলা অতি আধুনিক জীবন যাপন করছেন, আবার কাউকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পর্দানশীন হয়ে থাকতে হচ্ছে। এই পার্থক্যটা কেন, তা নিয়ে কি কখনো মনে প্রশ্ন জেগেছে আমাদের?
 
 আসলে বোরখা, হিজাব, নারী স্বাধীনতা, মানবাধিকার, ধর্ম, রাজনীতি–সব মিলেমিশে একাকার। বর্তমানে সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে বহুল চর্চিত ঝালমুড়ির মিশ্রনে গরম টাটকা বিষয়। সবাই এ বিষয়ে অবহিত, কিন্তু কারোর কাছেই এর কোন সুনির্দিষ্ট নিরপেক্ষ মতামত নেই। প্রশ্ন হল কেন? মার্কেটিং বা সেলস-এ একটি প্রচলিত প্রবাদ হলো–"if you can't convince, then confuse."– ঠিক এই চালাকিটাই সব জায়গায় চোখে পড়ল। তা সে সংবাদমাধ্যমই হোক বা ধর্ম, রাজনৈতিক নেতা বা বুদ্ধিজীবীর মন্তব্য–সবক্ষেত্রেই। সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশ সহ সঠিক মন্তব্য উপস্থাপনে সকলেই ব্যর্থ। কারণটা কি? দায় এড়ানো? ঝামেলায় না যাওয়া? কেউই দায়ভার বহন করতে চান না। সত্যিই তো, মৌচাকে ঢিল মারলে তার ফল তো মারাত্মকই হবে। আর উদাহরণও তো নিতান্ত কম নয়। তসলিমাকে নিজের দেশ ছেড়ে ভারতে, তারপরে আবার পশ্চিমবঙ্গও ছেড়ে দিল্লিতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। প্যারিসের কার্টুনিস্ট থেকে সলমন রুশদি...আর কত নাম নেব। বুদ্ধিজীবীদের গালভরা, আবেগভরা মন্তব্য কোনোভাবেই অক্সিজেন যোগায় না এই বোরখা নামক চলমান জেলখানার আবরণে মোড়া নারীদের। সারা পৃথিবী আজ মূক দর্শকের আসনে। সকল মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে আর মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর অঙ্গুলি নির্দেশে আমাদেরই অজান্তে এক অদৃশ্য শক্তির দ্বারা আজ আমরা চালিত হচ্ছি।

তাই সমস্যা সমস্যার জায়গাতেই থেকে যাচ্ছে অমীমাংসিতভাবে, ক্ষমতার অলিন্দে ভবিষ্যতের তুরুপের তাস হিসেবে। এইটাই হচ্ছে মূল জায়গা, যেটা আমাদের খুব ভালো করে বুঝতে হবে। সেটা হল কোন সমস্যা তৈরি করা, সেটাকে জিইয়ে রাখা বা সেটার সমাধান–পুরোটাই থাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির হাতে। তাকে ব্যবহার করা হয় কখনো ধর্মের ছলে কখনো বর্ণ-বৈষম্য রূপে বা অন্য কোন মাধ্যমে। ধর্মের দ্বারা মায়া, ইনকা, রোমান, মিশরীয় ও ভারতের রাজতন্ত্র কিভাবে পরিচালিত হয়েছে ও তার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সে ইতিহাস সকলেরই জানা। এখনো সেই একই ধারা অব্যাহত, শুধু ধরণটা বদলেছে। বিদ্যাসাগর, রামমোহন, কেশবচন্দ্র সেন এর প্রচেষ্টায় বিধবা বিবাহ, সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, স্ত্রী শিক্ষা বিষয়ক সংশোধন হয়তো সম্ভবপর হতো না যদি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সহযোগিতা না করতেন। এক্ষেত্রেও পরোক্ষভাবে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত ছিল। এভাবে বিভিন্ন ধর্মের সংশোধন হয়ে চলেছে সময়ের সাথে সাথে। খ্রিস্টান ধর্মের সংশোধনও বহুবার হয়েছে, আধুনিকতম সংযোজন হল পেন্টাকোস্টাল চার্চ, যা রূপ নেয় বিশ শতকে। প্রশ্ন হলো ইসলাম ধর্মে এমনটা হয়নি কেন ? বা এখনো হচ্ছে না কেন? কারণ, কমবেশি ৫০ টি মুসলিম দেশ আজ এই বিশ্বে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সম্বল করে এই সাম্রাজ্য সম্ভবপর ছিল না, তাই দেশ চালানোয় রাজনৈতিকভাবে একে অপরের সাহায্য আসতে লাগলো ধর্মীয় কারণে আর ধর্মকে সম্বল করে একত্র হতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি। এই ইসলামধর্মী দেশগুলির মধ্যে কেউ কেউ অর্থনৈতিক উন্নতির চরম সীমায়, কেউবা উন্নয়নের শুরুতে, আবার কেউ কেউ দারিদ্র্য জর্জরিত। অর্থাৎ সবাই এক সুষম অর্থনীতিতে অবস্থান করছে না। ইসলাম গোষ্ঠীর এই ভারসাম্যহীনতা তাদের ঠেলে দিয়েছে বিভিন্ন শক্তিশালী গোষ্ঠীর দিকে। ইসলাম দেশগুলি তাদের স্বার্থে বিদেশনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে ব্যবহার করে চলেছে ইসলাম ধর্মকে প্রতিনিয়ত। ধরা যাক, সংযুক্ত আরব আমিরশাহীকে। সকলেই জানি দুবাই শহর অর্থনৈতিক প্রাচুর্য ও আতিশয্যের চরম সীমায়। ইসলাম দেশ হয়েও এখানে ধর্মের গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। এটি আজ মধ্যপ্রাচ্যের এক শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক কেন্দ্র এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য কেন্দ্রগুলির এক শক্তিশালী প্রতিযোগী। অপরদিকে তালিবান অধ্যুষিত দেশগুলি ধর্মের দ্বারা উৎপীড়িত। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে এই দেশগুলি কখনো শত্রু, কখনো বন্ধু, তেলের দাম ওঠা পড়ার মতো। যেহেতু ইসলাম এখন কোনো একটি দেশের অধিকার বহির্ভূত, সেহেতু ওই অস্থিরতার অবসান না হলে সকলের একমত হওয়া সম্ভব নয়। আর যতদিন তারা সহমত হতে না পারছে ততদিন ধর্মের কোনো সংশোধনও সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটা দেশের সমস্যা ও লক্ষ্য আলাদা, তাদের বিদেশনীতিও ভিন্ন, যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল।
 

বর্তমান হিজাব বিরোধী আন্দোলনে ভারত ও ইরান ইসলাম ধর্মের সমালোচনায় শিরোনামে। এরা আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় একে অপরের বন্ধু রাষ্ট্র এবং ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ। সেই কারণেই কর্নাটকের আন্দোলনের ঘটনায় ইরানে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে ইরানীয়দের বিক্ষোভ প্রদর্শনকে সুনিপুণ ভাবে ইরান সরকার সামলে নেয়। কেননা এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তাই ইসলাম দেশ হয়েও ইরান এই প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে চায়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন এই বিষয় এখন রায়ের অপেক্ষায়। আশা করি, ভারত সরকার আপন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার স্বার্থে এবং ইসলাম ধর্মী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের সুষম ভারসাম্যের কথা মাথায় রেখেই সযত্নে এর সমাধান খুঁজবেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ফ্রান্স সহ অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ক্যামেরুন, চীন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস-এর মত দেশগুলিও কিন্তু বোরখা আর নাকাব উভয়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই নিয়ে এই সকল দেশে কোনরকম বৃহত্তর আন্দোলন বা প্রতিবাদ হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কেননা, এরা কোনভাবেই ইসলামধর্মী দেশগুলির উপর নির্ভরশীল নয়। তাই বোরখা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে তা নির্ভর করছে সেই দেশের অর্থনৈতিক দৃঢ়তা ও নিরাপত্তার উপর। অর্থাৎ ধর্মের গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে মানবাধিকারকে কতোটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত বা উন্নত জীবনযাত্রা প্রদান করা প্রয়োজন তা অবশ্যই নির্ভর করছে সেই দেশের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও অন্যন্য দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বোঝাপড়ার ওপর। 

আজকে ইরানে যে বিদ্রোহ বা আন্দোলন চলছে, তা সারা পৃথিবী দেখছে। অধীর আগ্রহে সকলেই উন্মুখ যে ইরান সরকার কী সিদ্ধান্ত নেন। কারণ ইরান মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ এক উন্নয়নশীল দেশ, যা বিভিন্ন পশ্চিমী দেশ ও অ-ইসলামিক দেশের হাত ধরে উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। সেখানে অন্যান্য ইসলামিক দেশের সাথে সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে অবশ্যই তারা বিচার করবেন, কোন সিদ্ধান্তে যাবেন। অবশ্যই তা নির্ভর করছে বর্তমান রাজনৈতিক স্থায়িত্ব ও ভবিষ্যতের আর্থিক উন্নয়নের ওপর। এই মুহূর্তে ইরান কতটা ইসলামধর্মী দেশগুলির উপর নির্ভরশীল বা কতটা উন্নত দেশগুলির প্রতি সংবেদনশীল তার প্রতিফলন দেখতে পাবো এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। যেহেতু আন্দোলন এক একটি দেশভিত্তিক, সেহেতু তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সেই দেশের নিজস্ব স্বার্থ ও আইনের উপর। ইসলাম ধর্মের ব্যাপ্তি এখন ৫০টি দেশের মধ্যে বিন্যস্ত। এই দেশগুলি একত্র হয়ে কোন সিদ্ধান্ত না নিলে, কোন একটিমাত্র দেশ ইসলাম ধর্মের পৌরহিত্য করার স্পর্ধা করবে বলে মনে হয় না। অতএব ইসলাম ধর্ম ও তার গোঁড়ামি যেখানে আছে সেখানেই থাকবে, আর কিছু কিছু দেশ এই বিষয়টিকে তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে সামলাবে। মোটকথা সমস্তটাই নির্ভর করছে এক দেশের সঙ্গে অপর দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা অর্থনৈতিক অবস্থানের উপর। তাই বিভিন্ন সমাজসেবী সংগঠন, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা যতই চেঁচামিচি করুন না কেন, আখেরে তাঁদের নিজস্ব বিজ্ঞাপন হওয়া ছাড়া আর বিশেষ কোনো লাভ তো আপাতত চোখে পড়ছেনা। তাই নারী স্বাধীনতা, মানব অধিকারকে আপাতত বোরখার মধ্যেই ঢেকে রাখছি। শপিং মলের অভিজ্ঞতায় মনে হয় আরো কিছুকাল এই বোরখার আড়ালে খ্যামটা নাচটা দেখে যেতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন