দোঁহা

বন্দিনী

 

প্রচ্ছদ. মরজানে সতরপির 'পার্সেপোলিস'

শুভা মিত্র

রোজকার কিছু কথা প্রায়ই ভেসে আসে কানে; কখনো পাড়ার মোড়ে, ট্রামে, বাসে, মেট্রোতে যাতায়াতের পথে; অস্ফুটে বলা কিছু কথা…তবুও কানে ভেসে আসে।
"দেখো, কেমন জামা পরে বাইরে বেরিয়েছে! আজকালকার মেয়েদের লজ্জাশরম বলতে কিছুই নেই গো!"
"দেখো, কেমন পেট-দেখানো জামা! এটুকুই বা পরতে গেলি কেন!"
"বাবা-মায়ের কোনো শিক্ষাই নেই! বেশি মডার্ন!"
শুনতে শুনতে যাকে উদ্দেশ্য করে বলা তার দিকে তাকিয়ে নিজেও কেমন অস্বস্তি বোধ করি। সত্যিই, চোখে লাগছে। কেমন করে পরে আছে জানিনা বাবা! তারপরেই সচেতন হয়ে খেয়াল করি, আমার এই চোখে-লাগাটা মেয়েটির ব্যক্তিগত জায়গায় একরকম নাক গলানো হয়ে যায় না? তাকে না চিনে, না জেনে যারা তার চরিত্র বিচার করতে বসেছেন, কখন যেন আমিও তাদের দলের অংশ হয়ে তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছি! কয়েক জোড়া লালসার দৃষ্টি যে তখন থেকে মেয়েটির শরীরের চারপাশে ঘোরাফেরা করছে, সেদিকে খেয়াল না করে মেয়েটিকেই কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছি কখন!
"এমন পোশাক পরে বেরোলে এই তো হবে!"
সঙ্গে অকাট্য যুক্তিঃ "সমাজের কিছু নিয়ম আছে। আমাদের সংস্কৃতি এমন পোশাককে কখনোই গ্রহণযোগ্য মনে করেনা। সমাজে বাস করতে গেলে তার নিয়মগুলো তো মেনে চলতেই হবে।"
আবার যেন থমকে যাই। বিচারকের আসনে যারা বসেছি স্বেচ্ছায়, তারাও যে নারীই। মস্তিষ্কের কোন অভ্যন্তরে আবহমান কাল ধরে বয়ে আসা একরাশ রীতি-নীতি কেমন অনায়াসে পুলিশের বেশ ধারণ করে ব্যক্তি তথা সমাজের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে! প্রশ্ন আসে মনে, কে তৈরি করল এই নীতি-পুলিশবাহিনীকে? দেশ-কাল নির্বিশেষে আমাদের ব্যক্তিমানস ও সমাজমানস যেভাবে আক্রান্ত হয়ে আছে, এর মূলে কি পিতৃতন্ত্র, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ ও ক্ষমতার অশুভ লড়াই সব জোট বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে? এই প্রশ্নের উত্তর সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে আছে এই বিশ্বের সমস্ত নারীর অস্তিত্বে-মাতৃগর্ভে ভ্রুণাবস্থা থেকে পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া পর্যন্ত তাদের ব্যক্তি ও সামাজিক যাপনে।

পর্দা, হিজাব, ঘোমটা, বোরখা-সমাজ, সম্প্রদায়, দেশ, কাল বিচ্ছিন্ন হলেও মিলেমিশে একাকার। কয়েক মিটার কাপড়ের ফারাক শুধু। যেন, লজ্জা নিবারিত হওয়াই সব নয় মেয়ে, আরো ঢাকো। এই নিয়ম অলিখিতই, যদি না ঢাকো, বাইরে তো শেয়াল-কুকুর আছেই তোমায় ছিঁড়ে খেতে চোখ-মুখ-দাঁত-নখ দিয়ে। তুমি নষ্ট হয়ে যাবে। এই শরীর তোমার, এই লজ্জা তোমার, এই বসন তোমার তবু তোমার নয়। যে সমাজেই তোমার বাস, নারী, সে সমাজ তোমার এই সব ব্যক্তিগত স্বত্ব নিয়ে রেখেছে। বিংশ শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকে সমগ্র বিশ্বে নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউ, ক্যারল হ্যানিষ্কের উক্তি “The Personal is Political”, এত তত্ত্ব ও তথ্য না জানলেও প্রতিটি নারী তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই এই সারসত্য বুঝে যায়। কে জানে, জীবনের শেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে হয়তো বুঝেছিল সে; নদী-মাঠ-ঘাট, সুবিশাল মরুপ্রান্তর পেরিয়ে সুদূর ইরান দেশের মেয়ে, বাইশ বছরের ঝকঝকে তরুণী মাহশা আমিন। রাষ্ট্রের বিধান অনুযায়ী তার মৃত্যু একটি দুর্ঘটনা; কারণ হিসেবে বলা হয়েছে হৃদরোগ। নিজের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মাহশা একটি আস্তরণ সরিয়ে দিয়ে গিয়েছে বটে; সমাজের কিনে রাখা স্বত্বের নিচে হাজার হাজার নারীর আর্তনাদ, স্বাধীনতার তীব্র গোঙানি। তারপর এই ঘটনা এক স্ফুলিঙ্গ হয়ে পরিণত হয়েছে এমন এক দাবানলে যা আঘাত হেনেছে রাষ্ট্র শাসনতন্ত্রের ভীতে, তোলপাড় করে তুলেছে বিশ্বের রাজনীতি। বৃহত্তর আলোকপ্রাপ্ত সমাজের ব্যক্তিমানসে যেন জাগরণ ঘটিয়েছেঃ নারীর পরিধান যখন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক হাতিয়ার, তখন ‘The personal is political’ এবং এর অপরদিকে ;’The political is personal’- এই দুইই প্রাসঙ্গিক।

তবু আবারও যেন থমকে দাঁড়াই। কাকে আলোকপ্রাপ্ত আখ্যা দিলাম? কোন আলোয় এগিয়ে চলেছে সমাজ? চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাম্প্রতিক ঘুরতে থাকা ১৯৭৯ সালের আগেকার ইরানের ছবি। ইসলামি বিপ্লব হওয়ার আগেকার তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ, শহরের রাস্তাঘাটে শর্ট স্কার্ট, স্যুট জাতীয় পোশাক পরা নারীদের ছবি। এই পরিপ্রেক্ষিতে মনে পড়ে যায় বছরখানেক আগেকার আরও একটি ভাইরাল হয়ে যাওয়া পোস্টঃ সত্তরের দশকে আফগানিস্তানে কাবুলের রাস্তায় স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো মেয়েদের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা। কিছু স্বাভাবিক ধারণাই তখন কেমন নড়বড়ে হয়ে যায়; যেমন সময়টা কোনদিকে এগোচ্ছে? আধুনিকতা আসলে কাকে বলে? আধুনিকতা কি কেবল বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত তথা privileged এক শ্রেণির? আধুনিকতাও কি পিতৃতন্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত?
নিজের দিকেই তখন তাকাই। একবিংশ শতাব্দীর শহুরে আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা, উচ্চশিক্ষার অধিকার পাওয়া এক নারী; তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করেও আঙুলের স্পর্শ সমগ্র বিশ্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে কোনো বাধা নেই আমার, নিজের আশেপাশে আমার যে ছোট্ট জগৎ, তাতেই আমার স্বাধীনতার অভাব নেই। স্বার্থপর হয়ে তখন মনে হয়, এই তো বেশ ভালো আছি। অথচ অধিকাংশ সময়ে খেয়াল থাকেনা, যে নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করেও কখনো 'গা-দেখানো' জামা পরিহিতার চরিত্র বিচার করতে বসে যাচ্ছি, নিজের মনেই উঁকি দিচ্ছে বহুবারঃ "এই পোশাক আমি পরব? না, পরা উচিত হবে না। এ সমাজ, সংস্কৃতি সবকিছুর বিরুদ্ধে। লোকে কী বলবে?"
প্রতিবাদ করিনা, যখন শুনতে পাই এই চেনা জগতের মধ্য থেকেই,
"বউ মানুষের এসব কাপড় পরা চলে?"
"আমরা সমাজে বাস করি, এর নিয়ম তুমি মানবেনা?"
সেই কোন উনিশ শতকে বাঙালি বাড়ি থেকে পর্দাপ্রথা উঠে গিয়েছে, তবু এখনো,
"আত্মীয়রা যখন আসবে, একটু ঘোমটা দিয়ে থেকো। অত বাইরে যাওয়ার দরকার কী?"
নীরব হয়ে শুনে যাই। নীরবতা একপ্রকার সায় দেওয়াই। আধুনিকতার মোড়কে এই তবে সমাজ, যেখানে উচিত-অনুচিতের সংজ্ঞা এমন ভয়ংকরভাবে শিকড় গেঁড়ে বসে আছে মনে; একা আমার নয়, এক গোষ্ঠী, আপামর সমাজের মননে। বাড়তে বাড়তে এই মননের ওপরেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে মৌলবাদী আইনকানুন, পশ্চাৎমুখী রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং তার ফলস্বরূপ সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত নারী, তার দেহ এবং অস্তিত্বের ওপর। সেখানে সমাজের মানসলোক থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রের অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থায় ধর্মের ধ্বজাধারী হয়ে বাস্তব রূপ ধারণ করেছে নীতিপুলিশ, যারা উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য যখন খুশি পুরুষ-নারী যাকে খুশি তুলে নিয়ে যেতে পারে সঠিক পোশাক না পরে ধর্মীয় চেতনায় আঘাত করার অপরাধে। হায় মানবী! হায় মানবিকতা!

হিজাব, ঘোমটা, পর্দা…নারীর একটুকরো বসন সাংঘাতিক এক রাজনৈতিক উপলক্ষ বটে। একদিকে এক রাষ্ট্র বলপূর্বক নারীদের সঠিকভাবে হিজাব পরতে বাধ্য করছে গত চার দশক ধরে, অপরদিকে আরেক রাষ্ট্র অন্য একরকম ধর্মবিদ্বেষে মত্ত হয়ে মিথ্যা ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে বিধান দিচ্ছে হিজাব না পরার। প্রশ্ন হিজাব বা অন্য পোশাকের চাইতেও বেশি আসলে স্বাধীনতার। যে অদৃশ্য শৃঙ্খল আপামর বিশ্বের নারীরা পায়ে পরে ঘুরছি, দেখতে পাচ্ছিনা অথচ শব্দ শুনতে পাচ্ছি, প্রশ্ন আসলে সেই স্বাধীনতাহীনতার। কোথাও গিয়ে তাই নীতিপুলিশের হাতে শহীদ হওয়া মাহশা আমিন থেকে সমাজের রক্তচক্ষু এড়িয়ে নিজের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া নামহারা মেয়েটি; কেউ বিচ্ছিন্ন নয়। পায়ের শৃঙ্খল যেন ধ্বনি তুলেছে, আর নয়! দেশের সীমান্ত পেরিয়ে, ইরানে এই শৃঙ্খল ভাঙার কাজে লেগে পঁচাত্তরজনের বেশি শহীদের দেব পেরিয়ে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তা, আর নয়! অন্তরের নারীসত্তা কেমন যেন বিশ্বের প্রতিটি নারীসত্তার সঙ্গে একাত্ম হতে চায়। পরাধীনতার বিরুদ্ধে এই লড়াই সকলের। হয়তো বেশিদিন বাকি নেই, একটুখানি আশার আলো দেখার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন