![]() |
প্রচ্ছদ. মরজানে সতরপির 'পার্সেপোলিস' |
শালিনী ঘোষ
১. সংবিধান স্বীকৃত বিয়ের বয়স মেয়েদের ১৩ আর ছেলেদের ১৫
২. বিবাহবহির্ভূত শারীরিক মিলনের শাস্তি ৯৯ বার বেত্রাঘাত
৩. গর্ভপাতের উপর নিষেধাজ্ঞা
তিনটি নিয়মই প্রথম বিশ্বের যে দেশে রমরমিয়ে চলে এই ২০২২'এ এসেও, তার নাম ইরান। মাহশা আমিনি উপযুক্ত ভাবে হিজাব না পরার কারণে নীতিপুলিশ যে তাকে 'শিক্ষা' দিতে আইনি হেফাজতে নিয়ে গিয়ে রাখবে এবং মাথায় উপর্যুপরি আঘাতে প্রথমে সে কোমায় যাবে এবং তারপর তার মৃত্যুকে হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়েছে বলেই চালানো হবে-এ সংবাদ তৃতীয় বিশ্বে ভারত নামক দেশে বসে তাই আমাকে বিস্ময়াভিভূত করে না। বরং সন্তর্পণে এড়িয়ে যাই মুম্বইয়ের তিলক বিহারকে, যেখানে রূপালীকে তার স্বামী খুন করছে বোরখা পরবে না পণ করে শিশুকে নিয়ে আলাদা বসবাস শুরু করার কারণে।
ইরান- ১৫০১ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত এখানে শাসন করতেন রাজতন্ত্রী শাহ বা রাজারা। ১৯৭৯'এ বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং শাহ মহম্মদ রেজা পহলভিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সূচনা হয়। রাজতন্ত্র চলাকালীন অবশ্য পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে ঢের বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতেন মহিলারা। বাধ্যতামূলক হিজাব বাদই দিন, সমুদ্রসৈকতে বিকিনি, শহরের পথে মিনিস্কার্ট এবং রূপচর্চার জন্য পার্লারের সংখ্যাও ছিল আলাদা করে নজরে পড়ার মতো।
ইসলামী ইরানের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ্ রুহুল্লাহ্ খোমেইনি ১৯৭৯ থেকেই বাধ্যতামূলক হিজাবের পক্ষে সওয়াল শুরু করেন৷ এতদিন আলগোছে গলায় বা মাথায় বস্ত্রখণ্ডটি ফেলে রাখতে অভ্যস্ত মহিলারা প্রতিবাদ করলেও দুই বছরের মধ্যেই আইন প্রণয়ন হয়ে যায়৷ ভিক্ষা জোটে ঘরের ভিতর যেমন খুশি পরার অনুমতি। প্রায় ৪৭৮ বছরের রাজতন্ত্রের অবসানে দেশের শীর্ষ নেতার শিরোপা আমরা যার হাতে তুলে দিচ্ছি, অর্ধশতাব্দীরও কম সময়ের শাসনকালে তার নেতৃত্বেই রচিত হচ্ছে নারীসমাজ তথা দেশের প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতার কালা ইতিহাস।
১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ্ রুহুল্লাহ্ খোমেইনির উত্তরসূরী হিসাবে দেশের শীর্ষনেতার দায়িত্ব ন্যস্ত হয় আয়াতুল্লাহ্ আল খোমেইনির উপর৷ এবার এই শীর্ষনেতা একাধারে সেনাবাহিনীর প্রধান, নিরাপত্তাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রের নিয়ন্ত্রক, এমনকী বিচারবিভাগীয় প্রধানের নিয়োগও তার হাতে৷ সরকারবিরোধী অসন্তোষের মোকাবিলায় তারই অঙ্গুলিহেলনে চলে 'বাসিজ' নামক আধা-সামরিক বাহিনী। ফলে তার জমানায় যে ইসলামি ইরানে প্রবর্তিত নিয়মের বদল সহজে ঘটবে না এ বলাই বাহুল্য৷
সমাজ, ধর্ম, নিয়মকে বজায় রাখাই দক্ষিণপন্থার লক্ষ্য। আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে তা প্রগতিশীলতার পরিপন্থী। অথচ ইরানকে বাদ দিলেও ব্রাজিল, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কোস্টারিকাই বলুন বা নিউজিল্যান্ড, জাপান, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশ, সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে তারা প্রত্যেকে কিন্তু বেছে নিচ্ছেন কোনও একজন ব্যক্তিকে, যার মর্জিমাফিক চালিত হচ্ছে রাষ্ট্র। শিক্ষা যুক্তি দিয়ে ভাবতে গেলে বিস্মিত হই ২০২২ সালেও লড়ে যেতে হচ্ছে স্টেম সেল গবেষণা, এলজিবিটি অধিকার বা গর্ভপাতের মতো বিষয়গুলি নিয়ে। জাতপাতের বৈষম্য হতে থাকছে তীব্রতর। যতই বলি না কেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অচলায়তন ভাঙতে চান, এও তো সত্যি যে নেতা নির্বাচনের কারিগর আমরা সাধারণ মানুষরাই।
প্রখ্যাত সমাজবিদ এরিক সেলিগমান ফ্রম তাঁর একাধিক বইতে উল্লেখ করছেন স্বাধীনতার প্রতি মানুষের ভয়কে। দক্ষিণপন্থীরা সওয়াল করছে যে প্রথামান্যতা তথা গতানুগতিকতার পক্ষে, ব্যক্তিবিশেষের হাতে তুলে দিচ্ছে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার-সাধারণ মানুষ তাতে আপাতভাবে স্বস্তি পাচ্ছে। পারিপার্শ্বিক অস্থিরতা ব্যতিরেকে স্রোতে গা ভাসানোকে তারা মনে করছে শান্তি। সমাজের প্রচলিত নিয়ম বদলানোর জন্য যে লড়াই, দীর্ঘ পথ এবং পরিশ্রম-সেই মানসিক চাপ তারা নিতে চায় না। অন্য কেউ তাদের জীবন তথা সমাজের হয়ে সবটুকু ভেবে দিচ্ছে, এই বোধ ও স্বস্তি স্বাধীনতার ভয়ের কবল থেকে বাঁচাচ্ছে তাদের। ক্রীতদাস প্রথা লুপ্ত হলে ঠিক যেমন ক্রীতদাসরা নিজেরাই তা চাইতে থাকে, তাদের চোখে লেগে থাকে ছত্রছায়া, নিরাপত্তার, বাঁধা পাঁউরুটির মায়া। একদিক থেকে বলা যায়, এ এক দেশব্যাপী ম্যাসিভ স্কেলের স্টকহোম সিনড্রোম। আর এই অচলায়তন ভাঙার প্রথম কুঠারাঘাত হল মাহশার কপালের রক্তদাগ।
অনেকেই মাহশা আমিনির পক্ষ নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ, মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবী সম্প্রদায় নারী পুরুষ নির্বিশেষে শ্রমজীবী মানুষের যোগদানকে দিনবদলের সূচনা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। হিজাব পুড়িয়ে দেওয়া শুরু করে চুল কেটে ফেলে যে আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠেছিল বিক্ষিপ্তভাবে, গোটা বিশ্বের সভ্য মানুষ আজ তার সর্বগ্রাসী অশিক্ষা-অপসংস্কৃতি-অন্ধকার দূরীকরণের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখার অধীর অপেক্ষায়। ৮ কোটি ৩০ লক্ষ ইরানবাসীর মধ্যে ৫ কোটি ৮০লক্ষ ভোটারের বয়স যেখানে ৩০এর নীচে, সেখানে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয় বইকি! কারণ ওরাই 'ঝড়ের মাতন, বিজয় কেতন নেড়ে অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে' বদল আনতে পারে।