![]() |
প্রচ্ছদ. মরজানে সতরপির 'পার্সেপোলিস' |
সৌরীশ ঘোষ ও শুদ্ধায়ন চট্টোপাধ্যায়
“সত্যান্বেষণে দূর হবে অজ্ঞানতা”
[তাহিরিহ]
যদিও এর উৎস সম্পর্কে কোন নিশ্চিত ধারণা পাওয়া যায় না তবু পর্দা প্রথা ইরান তথা মধ্যপ্রাচ্যের এক অতি পুরাতন কাল থেকে প্রচলিত। আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে এই প্রথা শরিয়াতি আইনের আওতায় আসে এবং সমাজে মহিলাদের কুক্ষিগত করে রাখার অন্যতম প্রধান অস্ত্র হয়ে ওঠে। সেই থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এই চিরাচরিত নিয়মের কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। কিন্তু এই দেশগুলিতে ইসলাম ব্যতীত অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নারীদের ওপর এরকম অত্যাচারের কোন নজির ইতিহাসে বিশেষ পাওয়া যায় না। তবুও ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে ১৯৩৬ সালে রাজতন্ত্রের আদেশে ইরানের মহিলারা পর্দার থেকে মুক্তি পায়, কিন্তু পাঁচ বছর যেতে না যেতেই আবার আইন বদল করা হয়। এরপর ১৯৪১ থেকে ইসলামিক বিপ্লব অর্থাৎ ১৯৭৯ পর্যন্ত দেশে এই নিয়ম চালু হয়ে যে মহিলারা স্বেচ্ছায় বা তাদের পুরুষ শাসিত পরিবারের ইচ্ছায় পর্দা গ্রহণ করতে পারে।
ইসলামিক বিপ্লবের পরে সমগ্র ইরানের সামাজিক চিত্রটাই বদলে যায়, বিশেষ করে মহিলাদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকা এই উদ্ধত পুরুষতন্ত্রের ভারে আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। নতুন আইন তৈরি হয় যে, দেশ জুড়ে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মহিলা পর্দা বা অন্তত পক্ষে হিজাব ছাড়া প্রকাশ্যে বিচরণ করতে পারবে না। ৯০ এর শুরু থেকে ইরানের প্রশাসন স্পষ্ট ভাষায় নিয়ম জারী করে যে মহিলাদের লঙ কোট ও হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। অন্যথায় দু’ মাসের কারাবাস থেকে শুরু করে ২৫ মার্কিন মুদ্রা জরিমানা ধার্য করা হয়। ঘরের মধ্যে নিয়ম না মানলেও কোন অপরিচিত পুরুষের গৃহে আগমনে মহিলাদের অনাবৃত চুল দণ্ডনীয় অপরাধ। ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ইরানকে পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ লিঙ্গ বৈষম্যময় দেশ বলে অভিহিত করে।
সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রটা কিন্তু একই রকম নয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে পর্দা প্রথার প্রচলন রয়েছে। এই কথা অনস্বীকার্য যে অনেক মুসলমান মহিলাই পর্দা প্রথাকে উপযুক্ত মনে করেন কিন্তু সবাই নয়। যারা এই প্রথাকে মেনে নিচ্ছেন তাদের মতামত বিচার করার আগে এটা ভেবে দেখা প্রয়োজন যে ইরানের মহিলাদের কোন মতামতের অবকাশ পর্যন্ত নেই। পুরুষতন্ত্রের এই অবদমন মেনে নেওয়া ছাড়া তাদের কোন বিকল্প নেই।
১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পূর্বে মেয়েদের বিবাহযোগ্য বয়স ছিল ১৮ যা বিপ্লবের পরে ৯ স্থির করে প্রশাসন। বয়ঃসন্ধিকালে মেয়ের পিতা বা পরিবারের কোন বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষের নির্দেশে বিয়ে হতে পারে এই ইসলামিক রীতি অনুসরণ করে ২০১৩ সালে বিবাহের বৈধ বয়স বাড়িয়ে ১৩ করা হয়। যদিও এই পরিবর্তনটি এত সরল ছিল না। ইরানের সংস্কার যুগে ষষ্ঠ সংসদে একটি ১৩ মহিলার সংগঠনের লড়াইয়ের ফসল এই পরিবর্তন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনটি সংসদে শতকরা পাঁচ শতাংশ হয়ে ইরানী নারীদের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করে গেছেন যা সমগ্র দেশের ইতিহাসে একটি বিরল নজির। কিন্তু শিক্ষার প্রসার বাড়তেই বাল্যবিবাহের হার কমতে থাকে দেশে। রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে ২০০৩-২০০৪ সালের মধ্যে দেশের মেয়েরা প্রায় ৫০% স্নাতক ডিগ্রী, ২৭% স্নাতকোত্তর ডিগ্রী এবং ২৪% পিএইচডি অর্জন করেছেন। তবুও দরিদ্র পরিবারের মধ্যে, এখনও বাল্যবিবাহ অব্যাহত রয়েছে। মহিলাদের স্বেচ্ছায় বিয়ে করার কোন অধিকার নেই। বিয়ে করতে চাইলে তার বাবা, পিতামহ বা দেওয়ানী আদালতের অনুমতি নিতে হবে। আইনত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ধর্ষণ বলে কিছু নেই। বিবাহবিচ্ছেদ আইন আর ধর্মনিরপেক্ষ পারিবারিক আদালতের কর্তৃত্বের অধীনস্থ নয়। যদিও বা সে ক্ষেত্রে স্ত্রী এবং স্বামীদের বিবাহবিচ্ছেদের সমান অধিকার ছিল। কিন্তু এই নবনির্মিত আইনে শুধু স্বামীদেরই তালাক দেওয়ার একতরফা অধিকার রয়েছে। একজন নারীর মৌলিক অধিকারও সীমিত করা হয়েছে। বাধ্যতা/অবাধ্যতা এবং রক্ষণাবেক্ষণ (তামকিন/নাশেজে এবং নাফাকা) হিসাবে উল্লেখ করা আইনগুলি শর্ত দেয় যে স্বামী তার স্ত্রীকে রক্ষণাবেক্ষণ করবে এবং বিনিময়ে সে তার আনুগত্য করবে। অর্থাৎ, আইনের অধীনে, একজন স্বামীর তার স্ত্রীর উপর নিরঙ্কুশ অধিকার রয়েছে। তার যৌন উপলভ্য ক্ষমতার পাশাপাশি বাড়ির বাইরে কাজ করার ক্ষমতাকে অস্বীকার করার বা খর্ব করার ক্ষমতাও একজন স্বামীকে দেয় ইরানের আইন। অস্থায়ী বিবাহ আইন (সিগেহ) সাময়িক বিবাহের অনুমতি দেয় মূলত শুধু মাত্র যৌন সম্পর্কের জন্য। যে কোনো পুরুষ, বিবাহিত বা অবিবাহিত এবং একজন অবিবাহিত মহিলার (কুমারী, তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা) সঙ্গে এই ক্ষণিকের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। পুরুষের অস্থায়ী বিবাহের যেমন সংখ্যার কোন সীমা নেই তেমনই কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। সম্পর্কগুলি কয়েক মিনিট থেকে আজীবন স্থায়ী হতে পারে।
এছাড়াও বিপ্লব পরবর্তী ইরানে রয়েছে নারী বিচারকদের অপসারণ এবং বিচারক হিসেবে নারীদের নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা। মহিলারা কোন পাবলিক অ্যাথলেটিক ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারে না। নারীরা তাদের পুরুষ অভিভাবকের লিখিত অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারবে না। বিদেশে যাওয়ার প্রসঙ্গ তো স্বপ্নাতীত। কর্মক্ষেত্রেও লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হতে হয় মেয়েদের এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় নিয়োগ-কর্তারা পুরুষদের নিয়োগ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। যতই উচ্চ শিক্ষায় নারীরা অগ্রগতি করুক না কেন বেকারত্বের হার বাড়তেই থাকছে। পরিসংখ্যান বলে যে ২০১১ সালে মহিলাদের বেকারত্বের হার ২৮% যা পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ যদিও প্রতি তিনটি মহিলার মধ্যে একজন স্নাতক উপাধি অর্জন করে চলেছে প্রতি বছর।
পরিমাণগত সংখ্যার নাগালের বাইরে, পর্দা এবং অন্যান্য বৈষম্যমূলক আইনি বিধি-নিষেধ ইরানে নারীদের জীবনে প্রতিনিয়ত অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে। এই দুর্বিনীত পুরুষ তন্ত্রের চাপে গোটা দেশের মহিলারা কোণ ঠাসা হতে হতে কোন তুচ্ছ বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই বাক-স্বাধীনতা রোহিত নারীর দল ক্রমশ সমাজের চোখে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যখন একজন মহিলা এই আইনগুলি অমান্য করার অঙ্গীকার করে ওঠে তখন তার ফলাফল হয় ভয়ঙ্কর, এমনকি তা প্রাণঘাতীও হতে পারে। মনে পরে যায় ১৯ শতকের সেই কবির কথা যার উদ্ধৃতি দিয়ে এই নিবন্ধ শুরু হয়েছে—তাহিরিহ, যিনি কুররাতুল-আয়ন নামেও পরিচিত। তাহিরিহ ছিলেন ইরানী মহিলাদের মধ্যে প্রথম যিনি এই চিরাচরিত অবদমনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন এবং সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে পর্দা উন্মুক্ত করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে নারী মুক্তির সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাঁর কবিতা, যা আজও আশ্চর্যজনক ভাবে বেঁচে আছে মানুষের মনে, ন্যায়বিচার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার নির্ঘোষে পূর্ণ। তাহিরিহ তাঁর পণ্ডিত ও প্রগতিশীল মা বাবার কাছে গৃহে শিক্ষালাভ করেন এবং এক স্বাধীনচেতা চিন্তাশীল বিদ্বান মানুষ হয়ে ওঠেন এবং গৃহের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দেশের ধর্মীয় শাসকদের সরাসরি প্রশ্ন করতে শুরু করেন তার চিন্তা যুক্তি ও লেখনির মাধ্যমে। এমনকি তিনি একটি নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন-বাবি ধর্ম, বাহাই ধর্মের অগ্রদূত। ইসলামিক আইন থেকে সরে এসে এই নতুন ধর্মকে জন-সমক্ষে আনার জন্য উত্তর ইরানের বাদশত গ্রামে বিশিষ্ট বাবি পুরুষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাহিরিহ ছিলেন সেই সমাবেশের একমাত্র উপস্থিত মহিলা বক্তা। তার এই অদম্য সাহস ইসলামী মৌলবাদীদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। তার গতি প্রতিহত করার জন্য সরকার বাধ্য হয় তাকে গ্রেপ্তার করতে এবং মিথ্যা খুনের দায়ে গৃহ বন্দী করে রাখা হয় বহুদিন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ইসলামী আইন তাকে মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করে। আজ পর্যন্ত, ইরানে তাহিরিহের গল্প নিয়ে আলোচনা করা নিষিদ্ধ।
ইরানের নারীবাদ
ইরান বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে নারীবাদ খুবই জটিল একটি বিষয়। যাদের ইসলামিক নারীবাদী বলে অভিহিত করা হয় তাদের মত অনুযায়ী, নারীদের শৃঙ্খল মোচন এই চিরাচরিত ইসলামী আইন ও শিক্ষাকে সংস্কারের মাধ্যমেই একমাত্র হওয়া সম্ভব। কিন্তু আরেক দল নারীবাদী যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী তারা এমনটা মনে করেন না। ধর্মনিরপেক্ষ ইরানী নারীবাদীরা বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির অধীনে দমন ও প্রান্তিকতা বিচার করছেন এবং দাবী করছেন মানবাধিকার, সুশীল সমাজ, নাগরিক শাসন এবং গণতন্ত্রের। তারা বিশ্বাস করেন যে রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজের দায়িত্ব নারী ও পুরুষের নাগরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সমানভাবে রক্ষা করা।
পীড়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা অহিংস আন্দোলনই ইরানের মহিলা সব থেকে শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠেছে। শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ও দেশের প্রথম মহিলা বিচারক, আইনজীবি শিরিন এবাদি নির্যাতিতাদের অধিকার রক্ষার জন্য তার কার্যকলাপের কারণে দীর্ঘ দিন কারাবন্দী ছিলেন। তিনি তার লেখায় বর্ণনা করেছেন যে পুলিশ প্রশাসনের কত ধরণের অত্যাচার সত্ত্বেও নারী আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে—২০০৬ সালের ১২ জুন তেহরানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পুরুষ নারী নির্বিশেষে প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্যাম্ফলেট নিয়ে একজোট হয়। বিক্ষোভ শুরু হতে না হতেই পুলিশ তাদের ঘিরে ফেলে এবং কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে বিক্ষোভ কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করে। মুহূর্তের মধ্যে বিক্ষোভ ভেঙে যায় এবং অগুন্তি মানুষ পুলিশ জোর করে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এর পরেই, সাংবাদিক নওশিন আহমাদি খোরাসানি এবং পারভিন আরদালান সহ নেতৃস্থানীয় নারী অধিকার কর্মীরা শিরিন এবাদির অফিসে মিলিত হয়ে ওয়ান মিলিয়ন সিগনেচার ক্যাম্পেইন চালু করার পরিকল্পনা করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল মহিলাদের বিরুদ্ধে সরকারের বৈষম্যমূলক আইনের অবসানের দাবিতে এক মিলিয়ন পিটিশন স্বাক্ষর সংগ্রহ করা। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর দিন, পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ভবনের প্রবেশপথ অবরোধ করেও তাদের প্রতিহত করতে অসফল হয়। তারা দাবী তোলে সুস্থ বিবাহ বন্দোবস্ত, উত্তরাধিকার আইন, ফৌজদারি আইন এবং বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য সমান অধিকারের পক্ষে। এই অভিযানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল সমাজের সকল স্তরের নারী-ধর্মনিরপেক্ষ ও ধার্মিক, যুবক ও বৃদ্ধ, গ্রামীণ ও শহুরে, ধনী ও দরিদ্রদের একজোট করে তুলতে এই মহিলারা সক্ষম হয়েছিলেন এবং পাঁচ বছর ধরে এই আন্দোলন জারী ছিল দেশ জুড়ে। তার কারণে আরদালান এবং খোরাসানি সহ অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষে এই যুদ্ধে তাদের আংশিক জয় হয়। সরকার সংসদীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় যা নারীদের তাদের স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের অধিকার দেয় এবং সড়ক দুর্ঘটনার শিকার নারীদের পুরুষদের সমান পরিমাণ "ব্লাড মানি" পাওয়ার অধিকার দেয় (নতুন আইন পাসের আগে, মহিলারা প্রদত্ত অর্থের মাত্র অর্ধেক পেতেন)। সংসদ পারিবারিক সুরক্ষা বিল পাস করাকেও বাধা দেয়, যার বক্তব্য অনুযায়ী মহিলাদের তাদের বাগদত্তার যৌতুক উপহারের (মেহরিহ) উপর কর দেওয়া বাধ্যতামূলক এবং পুরুষদের প্রথম স্ত্রীর সম্মতি ছাড়াই অতিরিক্ত স্ত্রী গ্রহণ করা অপরাধ নয়।
২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর তেহরানের এঙ্গেলাব (বিপ্লব) স্ট্রিটে এক ৩১ বছর বয়েসের মা একটি রাস্তার ধারের বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে মাথা থেকে হিজাব খুলে ফেলে। তারপর সেই কাপড়টিকে একটি কাঠির মাথায় বেঁধে সগর্বে ওড়াতে থাকে। তার নাম ভিভামোভাহেদ। এই ঘটনার পর থেকে, ‘গার্লস অফ রেভলিউশন স্ট্রিট’ নামে একটি প্রতিবাদ আন্দোলন সারা ইরানে ছড়িয়ে পরে। সোশ্যালমিডিয়ার মাধ্যমে মোভাহেদের মত নারীদের ছবি সমগ্র বিশ্বে নারী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। মাসিহ অ্যালাইনেজাদের ‘মাই স্টিলথিফ্রিডম’ নামে একটি ফেসবুক পেজ তৈরি করেছেন যেখানে নারীরা নিজেদের পর্দা উন্মুক্ত ছবি পোস্ট করে। তেহরানের একজন মানবাধিকার আইনজীবী নাসরিন সোতউদেহ, যিনি তার কার্যকলাপের জন্য ৬ বছর হাজতবাস করেছেন,লক্ষ্য করেছেন যে নারীরা যারা রাস্তায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ করে তারা একটি সহজ বার্তা মানুষের সামনে তুলে ধরছেন—মহিলারা হিজাব পরবেন কিনা সেটা একান্তই তাদের ব্যাক্তিগত মতামতের ওপর নির্ভরশীল!
এই নিপীড়নের আরেকটি নজীর এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন। মাহভাশ সাবেত ও ৬ ব্যক্তিকে তেহরানে গোয়েন্দা ও জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা এজেন্টরা গ্রেপ্তার করে। বাহাই ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে অন্যান্য সংখ্যা লঘু ধর্মের মত বিশেষ মর্যাদা তো দূরস্থান বরং অত্যাচারের মাত্রা তাদের উপর দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। এই বৈষম্যের সূত্র খুঁজলে দেখা যায় বিভিন্ন গোপন নথিতে এর উল্লেখ রয়েছে যে ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আলি খোমেইনিবাহাই ধর্মের অনুসারীদের ওপর এই বৈষম্য ও পীড়নের রূপরেখা দান করেন। তাদের প্রথমে ২০ বছরের জন্য কারাদন্ড হয় যা পরে কমিয়ে ১০ বছর করে দেওয়া হয় ২০১৭ সালে। বলাই বাহুল্য যে জেলের মধ্যে মিথ্যা অভিযোগ থেকে শুরু করে নানান নির্যাতন ও অপব্যবহার সহ্য করতে হয়েছিল সাবেতকে। তাও তাদের কণ্ঠ রোধ করে রাখতে পারেনি। তিনি জেলের মধ্যে বসেও কবিতা লিখতে থাকেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে ইরান একলা নয়। প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে গেছে গুলাগ থেকে আফ্রিকা হয়ে গোটা আমেরিকায়। সমাজের সমস্ত স্তর থেকে প্রতিরোধের নির্ঘোষ উঠে আসছে ইরানে। তাদের পোশাকের স্বাধীনতা, তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, অবাধে বিচরণের স্বাধীনতার দাবীতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর এই আন্দোলন দৃঢ় থেকে সুদৃঢ় হয়েছে। ইরানের নীতি পুলিশের হাতে মহাশা আমিনির মৃত্যু, এক নতুন আন্দোলনের জন্মে দিয়েছে। মহিলারা সব বাঁধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তেহেরান, রাশ্ত, ইস্ফাহান এবং কমের মতন শহরে (এই শহরগুলি ইসলামি মৌলবাদীদের আখড়া বলে পরিচিত) লাগাতার অদম্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। ইরানের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসি পরিষ্কার জানিয়েছেন যে তারা এই আন্দোলন আর সহ্য করবেন না, এই বক্তব্য প্রচারিত হওয়ার পরে, পুলিশ এবং কমান্ডো বাহিনী প্রতিবাদীদের উপর দমন আর তীব্র করেছে। তবুও দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না, কারণ আন্দোলনের পথ সব সময় আপসহীন সংগ্রামের পথ। ক্রমে সব বাঁধা, সীমা, লজ্জা, ভয়, ক্ষয়, লোভ, মায়া, ভালবাসা, স্নেহ, ক্রোধ, কাম ধুলোয় মিশিয়ে মুক্তির দিকে এগিয়ে চলেছে; তাঁকে আর বেশি দিন দমিয়ে রাখা যাবে না, খতম করা যাবে না। কালে, কালে বিপ্লব বৃদ্ধি পায়, সে দীর্ঘজীবী হয়, চিরজীবী হয়। এখানেই কবি লিখেছেন-
“হাত দিয়ে বলো, সূর্যের আলো রুধিতে পারে কি কেউ?
আর আমাদের মেরে ঠেকানো কি যায়, গণসংগ্রামের ঢেউ”