দোঁহা

একমাত্র 'দোস্তোজী'

 


মেঘদূত রুদ্র

'দোস্তোজী' ছবির এক-একটি দৃশ্য আমায় এখনো তাড়া করে ফেরে। যেমন ছবির একদম শেষের দিকে সফিকুল স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আর তখনই তার মাথার ওপর দিয়ে একটা কাটা খাওয়া নীল ঘুড়ি উড়ে যায়। 'দোস্তোজী' পলাশের সাথে এরকমই একটা নীল ঘুড়ি ও উড়িয়েছিল যেটা কাটা খেয়ে অনেক দূর চলে গেছিল। ওরা ভেবেছিল বুঝি দূর বিদেশ চলে গেছে। একা সফিকুল আর ঘুড়ির দৃশ্যটি স্বপ্নের মত বারে বারে চেতনায় এসে ঘা দেয়, এ দৃশ্যটি জীবনের একটি গভীর সত্যকে কেমন করে জানি না উদঘাটিত করে দিয়েছে, একটা উপলব্ধিতে পৌঁছে দিয়েছে। এরকম আরও দৃশ্যের কথা মনে পরে। মনে পরে পলাশ-সফির বায়োস্কোপ দেখার দৃশ্য। অনবদ্য। মনে পরে ঘুড়ি কেনার টাকা বাঁচানোর জন্য পলাশের স্কুল থেকে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার দৃশ্য। অপূর্ব সুন্দর। মনে পরে পড়া করে না রাখার কারণে সফিকুলের টিউশন ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা এবং তাতে সফল না হয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য। স্নিগ্ধ মধুর, পরম সত্য হাস্যরস। তেমন ভালো লাগল পলাশের অন্তিম যাত্রায় একদম পেছনে সফিকুলের বাবা আর খেলনাওয়ালার উপস্থিতি বা শুঁয়োপোকার প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাওয়ার পর পলাশের মায়ের নাটকীয় কান্না। ছেলের মৃত্যুতে তাকে আমরা কাঁদতে দেখিনি। সেই কান্না আমাদের বুকের ভেতরেও জমা হয়ে ছিল। এই দৃশ্যে প্রজাপতির সাথে সাথে আমরাও মুক্তি পেলাম। তেমনই ভালো লাগে আলো জ্বলা টুপি পরে দুই বন্ধুর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। এই প্রতিটা দৃশ্য নির্মাণের পেছনেই ‘পথের পাঁচালি’-র অনুপ্রেরণা আছে। দুর্গা মারা যাওয়ার পর অপুর পুতির মালা আবিষ্কার এবং পুকুরে নিক্ষেপ থেকে শুরু করে যাত্রা দেখে অপুর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। তবে প্রেরণা হিসেবে ‘পথের পাঁচালী’ থাকলেও 'দোস্তোজী' ছবির এই জগৎ একেবারেই ভিন্ন। এর মধ্যে বর্তমান সময়ের একটা দাবি আছে। আর আছে পরিচালক জীবনের নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং তার শৈশব যাপনের অনুপুঙ্খ।

আমরা অনেকেই এই ধরণের জগতের কিছু খণ্ড খণ্ড চিত্র স্বপ্নে দেখেছি, কল্পনা করেছি কিন্তু সেই খণ্ড চিত্রগুলিকে একসাথে সাজিয়ে একটা গল্প বলতে পারিনি। যেটা পরিচালক প্রসূন চ্যাটার্জি পেরেছেন। 

ছবিতে পলাশের মারা যাওয়ার দৃশ্যটা আমার মনমতো লাগে নি। মনমতো বলতে বিশ্বাসযোগ্য লাগেনি। পলাশ গ্রামের ছেলে, ধরে নেওয়া যায় যে ও সাঁতারও জানে, ওর এইভাবে কোমর জলে ডুবে মারা যাওয়াটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য লাগে নি। সেরকমই শুঁয়োপোকার প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাওয়ার দৃশ্যটায় প্রজাপতিটাকে আরেকটু দেখতে পেলে ভালো লাগতো। মনে হত দুই বন্ধুর স্বপ্ন যেন অবশেষে ডানা মেলে উড়ছে। মনটা আরেকটু ভিজত। কিন্তু আমার পাড়ার কিছু ছোটো ভাই আর মা-কাকিমারা আমার ভুল ভাঙাল। এই পাড়াটায় আমি নতুন এসেছি। পাড়ার ইতিহাস জানি না। ছবি দেখে ভাইদের একজন বলল যে এই পাড়ারই ওদের এক বন্ধু ছোটবেলায় ওর সামনেই লেকের জলে ডুবে মারা গেছিল। পলাশের মৃত্যু দৃশ্য ওদের মনকে ভিজিয়ে দিয়েছে। প্রথমবার ছবিটা আমি প্রিমিয়ারে দেখেছি। সেখানে আশেপাশে সব সিনেমার লোকেরাই ছিল। সিনেমার পাবলিকরা অধিকাংশরাই দেখার পর ভাবতে শুরু করে যে কি বলবে আর তারপর ভেবেচিন্তে নিজেদের সুবিধা মত অদ্ভুত কিছু একটা বলে। সেখানে 'অনেস্ট অপিনিয়ন' পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। কিন্তু মা কে নিয়ে যখন দ্বিতীয়বার ছবিটা পাড়ার প্রেক্ষাগৃহে দেখতে যাই তখন প্রজাপতির দৃশ্য দেখে মা সহ আসে-পাশের মহিলাদের চাপা কান্না আমায় বুঝিয়ে দেয় যে আমাদের ফিল্ম স্টাডিজ আর ফিল্ম স্কুল মার্কা টেকনিক্যাল পেঁয়াজি এখানে চলবে না। ছবিটা টেকনিক্যাল অ্যানালিসিস আর ফিল্ম ল্যাঙ্গুয়েজের বেড়াজাল পেরিয়ে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে ফেলেছে। কোনো সমালোচনাতেই আর দর্শকদের কিছু যাবে আসবে না। যদিও আমি সমালোচনা লিখতে বসিনি। একজন ছবি করিয়ে হিসেবেও ছবিটার ব্যাখ্যা করতে চাইছি না। কথাগুলো আমি একজন শিল্প রসিক হিসেবেই বলছি। আমি ছবি করি কি না করি সিনেমা ব্যাপারটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি এবং বুঝতে চেষ্টা করি। নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে দর্শকের আবেগকে কিভাবে ধরা যায় সেটা ভাবার চেষ্টা করি। আমার মনে হয়েছে 'রিসেন্ট পাস্টে' বাংলা ছবির কোনো পরিচালক যদি সেই জিনিসটা সফলভাবে বুঝে থাকেন সেটা প্রসূন বুঝেছে। ছবি শুধু হাতে গোনা কিছু বিজ্ঞ দর্শকদের কাছে সমাদৃত হলেই হয় না, তাকে ব্যবসাও করতে হয়। ছবি বানানোটা শুধুমাত্র একজন পরিচালকের খেয়াল খুশি চরিতার্থ করার মাধ্যম হতে পারে না। কারণ এর পেছনে একজন বা একাধিক মানুষের একটা বিপুল পরিমাণ টাকা লগ্নী করা থাকে। সেই টাকা লাভ সমেত ফিরিয়ে দেওয়াটা একজন পরিচালকের দায়িত্বের মধ্যে পরে। অন্যদিকে অনেক ব্যবসাসফল ছবি আবার অনেক সময় বিদগ্ধ মহলে সমাদৃত হয় না। দর্শকের নাড়ি ধরতে গিয়ে অনেক সময়য়েই পরিচালকরা একধরণের সহজ পথ নিয়ে নেন। সেটা যে সবসময় অন্যের হিট ছবি থেকে টুকে দেওয়া তা নয় বরং বলা যায় যে সেই সব ছবিতে নির্মাতার নিজস্ব সত্য থাকে না। কিন্তু প্রসূনের ক্ষেত্রে দুটোই একসাথে হচ্ছে। ছবি বিদেশের বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে সমাদৃত হয়েছে আর এখন হাউসফুলও হচ্ছে, দেশের মানুষের প্রশংসাও পাচ্ছে। এই কাজটা এমনি এমনি হয় না। আমি আমার মত করে একটা ছবি করব এবং সেটা করার জন্য যা যা অগ্নিপরীক্ষা আমায় দিতে হবে সেগুলো আমি দেবো–এই বিশ্বাস একজন পরিচালকের মধ্যে এলে তবেই এই ছবি বানানো যায়। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ছবিটা ও সাত বছর ধরে বানিয়েছে। কোনো শর্টকাট বেঁছে নেয় নি। ওর একটা জাপন আছে। তার মাধ্যমে ওর মনে কিছু ভাবনা এসেছিল। ভাবনা গুলো ওকে দীর্ঘদিন তাড়া করে বেড়িয়েছে, নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেয় নি। তাই সেই ভাবনা গুলোকে নিয়ে ও একটা গল্প সাজিয়েছে এবং ছবি বানানোর মাধ্যমে দর্শকের সাথে সেই ভাবনাগুলো ও ভাগ করে নিতে চেয়েছে। এর সঙ্গে ওর দীর্ঘদিনের ছবি দেখার অভ্যাস, সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা এগুলো বিভিন্ন যায়গায় মিলে মিশে গেছে। এই প্রসেস গুলোর মধ্যে দিয়ে ও গেছে বলে দর্শক ওর ছবির পাশে দাঁড়িয়েছে। কোন ছদ্মশিল্পী স্বভাব কবির ভাব করে এসে ন্যাকামি মারলে দর্শক তার পাশে দাঁড়ায় না। দর্শকের খেয়ে দেয়ে অনেক কাজ আছে। তারা সবকিছুই বোঝে। 'দোস্তোজী'র সাফল্য আমাকে অনেকটাই সাহস দিয়েছ, বাকি ছবি করিয়েদেরও সাহস দেবে বলে আমার ধারণা।
 
 
ছবির শেষে দেখা যায় যে একদিকে কোকিল ডাকছে আর তার সাথে সফিকুলও কোকিলের মত করে ডাকছে। তাতে কোকিলটা আরও বেশী করে ডাকছে। এইভাবে চলতে থাকে। এই দৃশ্যের মোটিফ আমি প্রথমবার দেখায় ঠিক ধরতে পারি নি। দ্বিতীয়বার দেখাতেও পারি নি। অনেকটা ধাঁধাঁর মত ব্যাপার। পারলে পারলেন নইলে আর হল না। আমার বাড়ির সামনে একটা ছোট মাঠ আছে। রাতে আমরা বড়রা সেখানে ব্যাডমিন্টন খেলি। দিনে বাচ্চারা খেলে। তো একদিন ভর দুপুর বেলা দেখি কিছু বাচ্চা খেলতে খেলতে এরকম কোকিলের মত করে খুব কর্কশ ভাবে ডাকছে। আশেপাশের লোকেরা বিরক্ত হচ্ছে। আমিও হতে যাবো। কিন্তু তখনই হঠাৎ করে ছবির দৃশ্যটার কথা মনে পরে গেলো। আমার আর বিরক্ত হওয়া হল না। ওরা কিছু একটা খোঁজে মনে হয়। আমরা তো ছিনিয়ে নেওয়ার চক্করে কবেই এইসব খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে দিয়েছি। একজন ধমক দিয়ে ওদের থামিয়ে দিলো। আমি অপেক্ষা করে আছি ওরা আবার কবে এরকম ভাবে ডাকবে। সেদিন জিজ্ঞেস করব ‘হ্যাঁ রে তোরা কি খুঁজিস রে। আমাকে খেলাটা শেখাবি’। প্রসূন কিভাবে কিভাবে যেন ব্যপারটা শিখে গেছে। আমাদেরও শিখতে হবে।
 

ছায়াছবি: দোস্তোজী (২০২২)
অভিনয়ে: আরিফ শেখ, আশিক শেখ, জয়তী চক্রবর্তী প্রমুখ।
নির্দেশনা: প্রসূন চট্টোপাধ্যায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন