মঞ্জিপুর। অদ্ভুত-সুন্দর নামের গ্রামেই উদ্দালকদের পোলিং বুথ। গ্রামের বুক চিরে পাকা রাস্তা চলে গেছে দূরে। সে রাস্তার ওপর ছোটখাট বাজার মতো একটা জায়গায় বাস তাদের উগরে দেয়। না, শহুরে লব্জে বাজার ঠিক না, তা গাঁয়ের হাটতলা, অন্তত তেমনটাই জানায় দু-একটা দোকানের সাইনবোর্ড উদ্দালককে। সে মোড় থেকে দু দিকে পঞ্চায়েতি ঢালাই রাস্তা ঢুকে গেছে গাঁখানার অন্দরে। উদ্দালকের দল ডানহাতি পথ ধরে। আর দুটো পার্টি বাঁহাতি পথ।
মঞ্জিপুর বেশ বড় গ্রাম চার-চারটে পঞ্চায়েত কেন্দ্রের দাপুটে বিন্যাসে, যেখানে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই বাস। এছাড়াও পরে উদ্দালক জেনেছিল যে, এ গাঁ নাকি আঠারো পাড়া গ্রাম, যাতে এ গর্বিত পরিচয়ও থাকে—এ গাঁখানি হরেককিসিমের জাতেরও আবাসভূমি। অন্তত তেমনটাই জানিয়েছিল উদ্দালককে তার বুথের স্থানীয় দেখভালকারী মিঠুন, যে নাম নাছোড় বিরক্তির আঁশুটে জালে জড়িয়ে যেতে যেতেও শহুরে প্রিসাইডিং অফিসারের মনে একটুখানি হলেও আনমনা শ্বাস এঁকেছিল—মিঠুন! তার মানে এর বাবা নায়ক মিঠুনের অন্ধভক্ত ছিল। আর এর জন্মও নিশ্চয় গত শতকের আটের দশকে। যদিও সে মিঠুনের কথায় তেমন নায়কোচিত বীরভাব ছিল না, বরং তা যথেষ্টই হতাশাজনক ও দায় এড়ানোর।
-ভাই মিঠুন, আমাদের খাওয়াদাওয়ার কী বন্দোবস্ত?
-তা আমি কী ঝানি? করোনা টেইমে সেল্পেপ মাইয়াদের রাঁধার আইন নাই। ও আপনেদের নিঝি করি নিতি হবে।
নায়ক মিঠুনের এ হেন উত্তরে সে আঁশুটে জাল আরও ফাঁদে জড়িয়েছিল উদ্দালককে। সে আরও অতলে তলিয়ে যায় যেন। অবশ্য কূলহীন অতল তখনই তাকে গ্রাস করেছিল যখন ফাঁকা মাঠে বসানো নতুন টিনের একটা দশ x বারো চৌখুপিতে রোদ ছলকে তার চোখ ঝলসে দিয়েছিল, তার চেতনাকেও। এই টিনের বাক্সই নাকি তার পোলিং বুথ! উদ্দালকের নাগরিক ইংরেজিয়ানা মুহূর্তে ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল—শিট!
করোনাকালে নির্বাচন কমিশন ভোটারদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে এতটাই সচেতন যে বুথপিছু ভোটার সংখ্যা কমিয়ে বুথসংখ্যা বাড়িয়েছে, যাতে ভোটাররা নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব মানার সুযোগ পায়। ভোটকর্মীরা অন্য সব ভারতীয়ের মতো নাগরিক তো নয়ই, ভোটারও নয় বোধহয়। ভাবে উদ্দালক, ভাবতে বাধ্য হয়। এ গাঁয়ে দুটো প্রাইমারি স্কুল, সেখানে কোনো রকমে পাঁচটা বুথের জায়গা হয়েছে, বাকি ফালতু বাড়তি বুথের তাই এ অস্থায়ী ধাতব অবতাররূপ! সঙ্গে আবার বায়ো টয়লেট! হাসি পায় উদ্দালকের, যে হাসি চারিয়ে যায় ক্ষণিক হলেও অন্য সবার মনে অসহায় বিরক্তিকে ঠেলে সরিয়ে ছটফটে যুবা রমেশের বেপরোয়া অশ্লীলতায়,
-এটা বুথ! গাঁড় মেরেছে! আমাদেরকে কি বুড়িচো... পেয়েছে নাকি!
রমেশের মুখ, নাকি বৃহত্তম গণতন্ত্রের এই উত্কট দেখানেপনা—কোনটা বেশি অশ্লীল? ভেবে পায় না উদ্দালক।
সে সাঁঝে উদ্দালক ও সরফরাজ মসজিদ থেকে ফিরে দেখে তাদের বুথের মাঠটার লাগোয়া সেই নাম না জানা গাছটার, যা আঁধার মেখে ঘননিঝুম এখন— তার নিচে গুটি কয়েক মানুষের ছায়া-আদল। তারা দু-জন এগোতেই ছায়া মানুষগুলো প্রাণ পায় যেন।
-ভোটবাবু! আপনেদের ঝন্যিই দাঁড়ায়ে আচি। আমরা সব এ গেরামেরই। তা সার, আপনেদের কিছু পেয়োজন হলি বলবেন। আমি এ মহল্লার পঞ্চাত্ মেম্বার... তা আপনেদের রাতের খানা... করোনার ঝন্যি সেল্পেপ গ্রুপের মাইয়াগুলানের...
কথাটার মাঝপথেই থামে সে পঞ্চায়েত মেম্বার। সে অবসরের অপেক্ষায়ই যেন ছিল উদ্দালক। হাত জোড় করে সে।
-নমস্কার। না, না, খাওয়ার ব্যবস্থা আমাদের আছে। ও নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না।
-মোদের এ গেরামে বেবাক শান্তি। কোনো ঝুট-ঝামিলি নাই। ঝামিলি রাখতি দেলে তো। মোদের নব জাতীয়তা পার্টি ছাড়া আর কোনো পার্টিকে পা গাড়তে... হেঁ-হেঁ!
অসম্পূর্ণ কথাটা দেঁতো হাসি হেসে ভরাট করে সে নেতা। কী বলবে, কতটা বলবে—সে দ্বন্দ থেকে ভোটবাবু উদ্দালককে রেহাই দিতেই গ্রাম্যনেতাটি সঙ্গে সঙ্গেই খেই ধরে,
-আপনেরা মোদের মেহমান। আপনেদের সুখ-দুস্কির দেখভাল মোদের ডিউটি... তাই আসা। মোরা আপনেদের দেখব, আপনেরা মোদের... হেঁ-হেঁ! তা’লে আসি আজ্ঞে। ছালাম।
হাতজোড় করে সে নেতা, ফলে পাল্টা আবারও হাতজোড় করতে হয় উদ্দালকদের। নেতাটি পেছন ঘুরতে ঘুরতে আবার ফুকরে ওঠে, তবে এবার তার এক ছায়াসঙ্গীর উদ্দেশ্যে—গোকুল, একখান সিগ্রেট থাকলে দিস তো, সি শালা দোপর থিকা মাথাটো ঢিসঢিস করতি নেগেছে।
এবং গোকুল নামক ছায়াটি না ঘুরেই, উদ্দালকদের দিকে মুখ করেই সিগারেট প্যাকেট বার করার অছিলায় প্যাণ্টের ওপর থেকে জামাটা তোলে ও বেশ কিছুক্ষণই যেন তুলেই থাকে, অন্তত উদ্দালকের তেমনই মনে হয়, কেননা ততক্ষণে বুথের দরজা থেকে চোঁয়ানো বৈদ্যুতিক আলোয় সে ছায়ার কোমরে গোঁজা ধাতব অস্ত্রখানি ছলকে ওঠে। রিভলবার! একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় উদ্দালকের শিরদাঁড়া বেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে দুটো ঘটনা জড়াজড়ি করে থাকে। সরফরাজ তার প্রিসাইডিং অফিসারের কাঁধে হাত রাখে, পরম ভরসার সে হাত। আর ওদিকে জামা নেমে এসে যেন বা পর্দা ফেলে দেয় ভোট-নৌটঙ্কির আপাত এ দৃশ্যে, এমত সংলাপে—লিন গো মামুদদা।
ছায়ামূর্তিগুলো আঁধারে মিশে যেতে থাকে বুথের গণতান্ত্রিক আলোকছটার বাইরে।
বুথে এসে উদ্দালক দেখে যে পুলিশ দু-জন ততক্ষণে উর্দি ছেড়ে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে বৈঠকী মেজাজে। ঘরের এক কোণে দুটো বেঞ্চে চাদর-বালিশ বিছিয়ে বিছানাও পেতে ফেলেছে। এবার বডি ফেললেই হয়! উদ্দালকের মনে নিরাপত্তা—এ কথাখানি হাসি দাগে। আর এক কোণে আধাসেনারা তাদের ব্যাগের ওপর হেলান দিয়ে বিশ্রামরত কিংবা মোবাইলমগ্ন হলেও তাদের একজন কিন্তু দরজার পাশে অস্ত্র হাতে অতন্দ্র প্রহরায়। এ দৃশ্য তাকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়।
প্রিসাইডিং অফিসার উদ্দালক আইনি তথা কাগুজে কাজসমূহ সারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ কাজে অভিজ্ঞ সরফরাজ তাকে যথাসম্ভব সাহায্য করে। অনন্যবাবুও তার কাজ গুছিয়ে রাখে। কিন্তু মনের কোণে কোথায় যেন সেই আলো-ছায়ায় ধাতব অস্ত্রের ক্ষণিক উদ্ভাস ঘাই মারেই, যেহেতু সে উদ্ভাস মৃত্যুশীতল। ফলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথারা ভেসে উঠতে থাকেই।
-আমাদের বুথের সবাই তো মুসলিম দেখছি। অন্য বুথগুলোতেও নিশ্চয় কিছু আছে। তা, এখানে মুসলিম দল নেই? হতে পারে? মুসলিম দলের ক্যান্ডিডেটও তো আছে দেখছি।
-হিন্দুদেরও তো অনেক জাতের বাস এখানে। হিঁদুয়ানির দেশ জোড়া রমরমার যুগে হিন্দুদলের কেউ থাকবে না, তা কি হতে পারে? সবাই নব্য জাতীয়তাবাদী দলের? আদি জাতীয়তাবাদী, সমাজতন্ত্রীরা না হয় বিলুপ্ত প্রজাতির... আর ওরা তো তো এবার মুসলিম দলের সঙ্গে জোট করেছে।
-আসলে দাদা, সমাজতান্ত্রিক জমানা থেকেই মানুষ মনে এক আর কাজে আরেক। যে দল ক্ষমতায় প্রকাশ্যে তারা সে দলের। নইলে গাঁয়ে থাকতে পারবেন না আপনি। তাছাড়া বাড়িশ্রী, রেশনশ্রী, পড়াশ্রী, বৃদ্ধশ্রী—যাবতীয় শ্রীমান/শ্রীমতি হতে গেলে আপনাকে শাসকদলের লেজ ধরতেই হবে। গাঁ-গঞ্জের এটাই অলিখিত আইন।
কথারা এমন শ্রীযুক্ত হলে সকলের মুখই হাসিশ্রী হয়ে ওঠে, যদিও পরের কথার চাপা হিসহিসানি সে হাসি মুছে দেয় যেন।
-চুপিচুপি একটা কথা জানাই—এবারে মুসলমানরা মনে ঠিক করে নিয়েছে হার্গিস তারা ভোট ভাগ হতে দেবে না হিন্দুদলকে রুখতে। তাই মুসলিম পার্টিকে ভোট না দিয়ে সবটাই নব জাতীয়তা পার্টিকেই দেবে।
এ হেন গুহ্য ও চাপাস্বরের কারণেই বোধহয় শব্দেরা খেই হারায়। থকথকে শীতল এক রাত্রি শুধু ছাইতে থাকে বুথজুড়ে, যা আরও ঘন হয়ে ওঠে পুলিশ দু-জনের পাল্লা দিয়ে নাক ডাকায়।
কাজ গুছোতে গুছোতে রাত একটা বেজেই যায়। সরফরাজ, অনন্য, রমেশ ডেকোরেটরের নকল কার্পেট পাতা মেঝেতে চাদর বিছিয়ে যে যার মতো শুয়ে পড়ে। উদ্দালক আর শোয় না। সে একটা চেয়ারে পা টান টান ছড়িয়ে শরীর এলিয়ে দেয় চোখ বন্ধ করে। করোনাকালে ভোটারদের জটলা এড়াতে ভোট এক ঘণ্টা এগিয়ে আনা হয়েছে এবার। সকাল ছ-টায় ভোট শুরু। ভোর পাঁচটায় মক পোল। সুতরাং তাদের তিনটে-সাড়ে তিনটেয় উঠে পড়তে হবে। একটাই বায়ো-টয়লেট। এতগুলো মানুষ, লাইন পড়ে যাবে। আর ভারতীয়দের জাতীয় বৈশিষ্টই বাথরুম নোংরা করা! ভাবে উদ্দালক, যে ভাবনায় অজানতেই তার ঝিমন্ত ঠোঁটদুটো দৃঢ হয়, হয়তো বা শব্দহীন এই সিদ্ধান্তেও—সবার আগেই বাথরুমটা সেরে নিতে হবে। এবং সে ভাবনাও ছিঁড়ে যায় চকিতে বর্তমান বাস্তবতায়—উঃ, কী মশা! আর গরমও তেমনি! তার হাত-পা নড়তেই থাকে। এ চঞ্চলতায় চোখ খোলে সে। দেখে সরফরাজরাও ঘুমোয় বোধহয়, কেননা তাদেরও ব্যস্ত হাত-পা তেমনই ইঙ্গিত দেয়। কোণের দিকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা উর্দি পরেই চোখ বুজে বসে আছে নিজেদের ব্যাগে হেলান দিয়ে। এই গরমে ওই মোটা উর্দি পরে থাকে কী করে তারা সব সময়? তার অলস চোখে ভাবনা ভেসে ওঠে, যা ভাসতে ভাসতে এ মাটি পায় যে, জওয়ানদের এ বিশ্রামভঙ্গিতেও যেন বা সাবধানতার তার ছায়া, যেহেতু দরজার পাশে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে এক জওয়ান অতন্দ্র খাড়া।
উঠে পড়ে উদ্দালক। জল খায়। দরজার ফাঁক দিয়ে জোছনালোকিত মায়া, যেন বা পাগলপারা, হাতছানি দেয় তাকে! সে দরজার দিকে পা বাড়াতেই প্রশ্ন ছুটে আসে সেই অতন্দ্র প্রহরীর কাছ থেকে।
-কাঁহা যানা হ্যায় সাব?
-ইঁহাই। নজদিক। ঘরমে বহুত গরমি। আউর মচ্ছর ভী।
-ঠিক হ্যায়। দূর মত্ যানা। আপলোগোঁ কা সেফটী হমারা ডিউটি।
উদ্দালক বাইরে আসে। আদিম উন্মুক্ত রাত্রি আদরে গ্রহণ করে তাকে। জুই ফুলের মতো ফুটে আছে যেন থোকা থোকা তারা রাত্রির আকাশে। তাদের কলকাতার একফালি নাগরিক আকাশে দু-চারটে ধূসর ম্লান তারা কখনো সখনো ফোটে ফোটারই অভ্যাসে যেন। মোহিত উদ্দালক আকাশ থেকে চোখ ফেরাতেই পারে না এ অতিপ্রাকৃতকতায়। একটা তারা হঠাত্ই ছুটে গিয়ে মিলিয়ে গেল সহসা। একে কি তারা খসা বলে? ভাবে সে। তাকে চমকে দিয়ে একটা রাতচরা পাখি আঁধার চিরে ডেকে উঠে উড়ে যায় সে নাম না জানা গাছটির ছায়াময় শরীরে, যে ছায়ার ফাঁকে দোল খায় একফালি বাঁকা সোনালি চাঁদ। আজ কী তিথি? কোন পক্ষ? জানে না উদ্দালক। সিগারেট ধরায় সে, আনমনা অভ্যাসে। সে অবসরে তার দৃষ্টির পরিধি জুড়ে বিছিয়ে থাকে মাটিময় এক মায়াজগত। নৈ:শাব্দিক এ মায়ায় ঘোর লাগে তার চেতনায়। মায়াগ্রস্ত সে আবারও নজর হানে আকাশপানে, তার নাক্ষত্রিক বিশালতায়। বিরাট প্রকৃতি গিলে নেয় যেন তার সকল ক্ষুদ্রতাকে সে মুহূর্তে। তার বিহ্বল চেতনায় নক্ষত্রপুঞ্জের জঙ্গমতা জেগে ওঠে, যে চলাচলে নক্ষত্রপুঞ্জ একাঙ্গী হয় এক মানুষি অবয়বে। সে মায়ায় উদ্দালকের অবচেতন প্রতিধ্বনি আঁকে—এই-ই তোমার দেশ, তোমার বাংলা। সত্তর শতাংশ শিকড়বাসী মানুষের মূলভূমি!
-বা-বা!
ভূতগ্রস্ত উদ্দালক ছুটে ঢুকে যায় তার গণতান্ত্রিক নিরাপত্তার খোপে।