শাশ্বতী গঙ্গোপাধ্যায়
শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটি গদ্যপ্রবন্ধে অন্য কবিদের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ব্যক্তিগত মিথের প্রতিষ্ঠার মধ্যেই কবির শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে এবং প্রত্যেক কবিরই একটি কল্পস্বর্গ রয়েছে। সেখানে ক্ষীরসমুদ্র, মেষপালকের বিকেল থেকে রঙ ছড়ানো অস্থিরাশি, মানমন্দির, টেরোডাকটিল, কুয়োশিরো স্রোত তো আছেই, তার সঙ্গে আছে, খর্জুর বীথি, আফিম ফুল , সাইপ্রেস ও তমাল। শক্তির কবিতার মধ্যে ছবি ও শব্দ একে অপরের সাথে হাত ধরাধরি করে আছে। চাইলেও তাকে আলাদা করা যায় না। তাই মনে হয় শক্তির কবিতা ‘বোঝবার জন্য নয় বাজবার জন্য’।
অস্থির, অশান্ত, অব্যস্থিতচিত্ত অথচ অসম্ভব শক্তিমান এক কবি। জগৎ ও জীবন তাঁর কাছে সর্বদা চলমান। চঞ্চলতা যেন ঘিরে রয়েছে তাঁর পদ্যকে। কবিতাকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলতেন পদ্য। পদ্যময়তার তিনি শব্দ ধ্বনি ও সঙ্গীত সাধনা করেছেন। বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের সঙ্গে তিনি নিজেকে মিলিয়েছেন। কিন্তু বাধা পড়েননি।
‘ভালবাসা কথা বলো, হোক না সে ছুঁচের মতন
নিষ্ঠুর, নঞর্থ কথা বলো আমার ভিতরে-
বৃষ্টির মতন কথা, বিদ্যুতের শিকড়ের কথা’-
নিমেষেই আচ্ছন্ন আবার সতত উন্মুখ করে রাখা পাঠককে শক্তি চট্টোপাধ্যায় চমকিত করেছেন, কখনও চোদ্দ মাত্রার বাঁধা পয়ারে, কখনও দীর্ঘতর খোলামেলা অক্ষরবৃত্তে, মাত্রাবৃত্তে, আবার কখনও বা ছড়ার ছাঁদে। রোমান্টিকতার এক আশ্চর্য উচ্চারণ তাঁর কবিতায়। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার রক্তের মধ্যেই একটা গন্ডগোল আছে। সেটা আমার ছন্নছাড়া ভাবটা। ছন্নছাড়া জীবনটা আমার খুব ভালো লাগে…এক এক সময় মনে হয় পরনের কাপড়টা মাথায় বেঁধে বেরিয়ে যাই’। তাই বোধহয় তাঁর কবিতায় উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণের ছবি বারবার এসে পড়ে। যার পিছনে থেকে যায় কিছু কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা, কখনও বা বিশুদ্ধ জল্পনা। জীবনানন্দের পথ হাঁটার সঙ্গে কিছু মিল খুঁজে নেওয়া যায় সেই সঙ্গে।
-‘জানালার কাছে মনে হয় পৃথিবীতে শুধু
এসেছি জাহাজে ভেসে যাবো বলে
কোনদিকে নয় কিংবা কলকাতার মৌলালিতে
পাইপের ভিতর অমন মুমূক্ষু আমি দেখেছি অনেক
বৃষ্টির দিনে দেখছে সঞ্চারমান ট্রাম স্টিমারের মতো
কাল রাতে এমন অন্ধকারে গ্রীস দেশে ঘুরেছি আমি অনেক’।
শক্তির ব্যক্তিগত স্বরসুধায় বাংলা কবিতা পেয়েছিল এক আবেশজড়িমা। ‘ধর্মে আছো জিরাফেও আছো’র স্বপ্নবিধুর লিরিক বুকের মধ্যে উতরোল জলতরঙ্গ বাজিয়েছিল। মনে দাগ কেটেছিল শক্তির সেই বিশ্বাস-
তোমার নয় কূটকচাল, টানাপোড়েন, সর্বজনীন মৌতাত রাধেশ্যাম
যাত্রী তুমি-পথে-বিপথে সবেতেই তোমার টান থাকবে এই তো চাই’।
শক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, উত্তাল প্রেম এবং গৈরিক বিবিক্তি। এই দুই বিপ্রতীপ প্রবণতা তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছে এক বিচিত্র দ্বৈধ। জীবনের সঙ্গে সোনালী গাঁটছড়া বেঁধেও নির্লিপ্তভাবে থাকা। চতুর্দশ কবিতাবলীর অনেকগুলি সনেট কিংবা ‘সোনার মাছি খুন করেছি’র একাধিক কবিতায় ভালবাসার উষ্ণ মদিরাঘন উচ্চারণের স্বাদ পাওয়া যায়।
‘আমি মুক্তি মানে বুঝি
তোমার বুকের পরে বসে থাকা,
গায়ে থাবা গুঁজি
তোমারে জাগাতে যেন কুমোরের মতন গম্বুজে’।
তারই পাশাপাশি নিরাসক্তি বলে-
‘কে তুই মাছি দুঃখদায়ক
আমাকে বাঁধনে বেঁধে ফেলে রেখেছিস তোর-কোটরে
হেঁটোয় কাঁটা ওপরে কাঁটা, এই কি দীর্ঘ জীবনযাপন?’
অথবা
‘যে কোনও দিকেই যেন ভেসে যাওয়া চলে
যাবার সন্ন্যাসে’।
ক্লান্তি, ভারবহনের এই অবসাদ দেখা যাচ্ছে ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ এবং ‘কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছো’র অনেক কবিতায়। এই বিষণ্ণতার ছোঁয়া লেগে আছে চাঁদের গায়েও। তাই কি সে পড়ে আছে অনন্ত কুয়ার জলে? তবু এই ‘হলুদ অসুখে’র বিরুদ্ধে তিনি কবিতায় নিয়ে আসতে চেয়েছেন এক ভিন্ন স্বাদ। যেখানে জীবনের এক অন্য অর্থ খুঁজে পান তিনি। এক দীঘল সবুজ প্রতিশ্রুতি দেখতে পাই আমরা। ‘পাতার করাতে চাঁদ ছিন্নভিন্ন, টের পাই সবুজ বাদার গন্ধ ঝাপটা মারে নাকে’।
জীবনানন্দের পর এমন চিত্রল কবিতা আর কেই বা লিখেছেন শক্তির মতো?
কবিতার আঙ্গিক নির্মাণে বারবার বিনির্মিত করেন তিনি নিজেকে। কবিতার ভাষা যেন তাঁর কাছে খেলবার সরঞ্জাম। কখনও সে স্বাচ্ছন্দ্য ধরা পড়ে কারুকৃতির ফাঁদে। তাই তিনি বলতে পারেন, ‘শব্দ শুধুই শব্দ এবং শব্দ মানেই সাশ্রু তুমি’। আবার ‘শব্দ হাতে পেলেই আমি খরচা করে ফেলি’। কখনও লিখছেন, ‘শব্দেরা নিজস্ব একটি শহর গড়েছে। এবং অর্বাচীন এ শহরে ক্ষণজন্মা প্রাণ করে ধূ ধূ’। তাই বলা যায় শব্দপ্রেম শক্তির কবচকুন্ডল। কিন্তু কোথাও কোথাও কবিতার ক্ষেত্রে এক অনতিক্রম্য দূরত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক বর্ণাঢ্য কবি ব্যক্তিত্ব। দুর্লভ অন্তর্ভ্রমণ। তাই প্রেমিকার চোখের বিশেষণও তাঁর কাছে ‘পর্যটনপ্রিয়’ হয়ে দেখা যায়। এক মানবিক বেদনার্তিতে কখনও তিনি বড় কাতর। হেমন্তের অরণ্যে পোস্টম্যান যে হলুদ পাতা কুড়িয়ে নিচ্ছে চিঠির ঝুলিতে, তাতে পাতা ও বৃক্ষের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মতো দূরত্ব বাড়ছে না।
‘একটি গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব বাড়তে দেখিনি আমি; গাছেরা একই জায়গায় আছে, কিন্তু মানুষ চিঠির লোভে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, তাই সে নির্জন, একাকী, আত্মপরিচয়হীন।'
শক্তি জানতেন সবকিছু চলে গেলেও জীবন থাকে। এ কি মানুষের মৃত্যু হলে ‘মানব’ থেকে যাওয়ার মতো? আর জীবন থাকে বলেই তার আকাঙক্ষা; শেষমেষ বুকের কাছের নরম মাটিতে ফুটন্ত টগর বসিয়ে চৌচম্পট-সটান ধরাছোঁয়ার বাইরে’। আর তখনই মনে হয়, ‘বহুদিন বেদনায় বহুদিন অন্ধকারে হয় হৃদয়ের উদ্ঘাটন। সে সময় পর্দা সরে যায় প্রাচী দিগন্তের দিকে’। এছাড়া এখানে পথের নেশা, প্রেমের সুতীব্র কিন্তু বাধা ও বিরহ, নিঃসঙ্গতা প্রকৃতির দৃশ্য তাঁর চিত্তকে ভরিয়ে রেখেছেো এলোমেলো, বিশৃঙ্খল চিত্রকল্পগুলি যেন সংকেতের রোদ্দুর।
তিন দশক ধরে বাংলা কবিতায় একাধিকপত্য করে গেছেন তিনি। তাঁর কবিতার ভাষাভঙ্গি, কবিতাবিন্যাস প্রথম থেকেই আলাদা। জীবনানন্দের ছায়া তাঁর মনে, কখনও কলমেও। কিন্তু অচিরেই তিনি তাকে উল্লঙ্ঘন করে গেছেন।
‘বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে বসে আছে দেবতা আমার
শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন।
সম্ভ্রমের মূল কোথা, এ মাটির নিথর বিস্তারে…
সেইখানে শুয়ে আছি মনে পড়ে, তার মনে পড়ে?'
প্রথাবদ্ধ ভাষারীতি সংক্রামিত করে আমাদের। স্যুরিয়ালিস্ট ভঙ্গি তাঁর কবিতায় এক বাস্তব বাস্তবের আলোচ্ছায়া তৈরি করে। এভাবেই ‘যে সময় মনোহর প্রত্যভিবাদন নিতে নেমে আসে ধানক্ষেতে চাঁদ
অন্ধকার অবহেলা অন্ধকার বড় বেদনার। ’
বেদনা বা ব্যথা কি আকাশ ছাড়িয়ে হেঁটে যেতে পারে? কবি যখন বলেন, ‘আধেকলীন হৃদয় দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়া নাড়া
অবনী বাড়ি আছো’।
এই যে দেখা না হওয়া, এ কি সেই ঔদাস্য? যা রবীন্দ্রনাথকেও পেয়ে বসেছিল? কোন অতিথি যে দ্বারে করাঘাত করেও ফিরে ফিরে গেল? সে কি তবে দুঃখরাতের রাজা? বা আঁধার ঘরের রাজা? আয়োজন নেই, অভ্যর্থনা নেই, তবু কেউ আসে। বিপন্ন অতিথির আগমন ও আশ্রয় প্রার্থনা ছাপিয়ে অবনী অর্থাৎ পৃথিবী সজীব হয়ে ওঠে। যেখানে সমাজের নানা উৎপীড়নে পৃথিবী ঘুমোতে চায় হয়তো, কিন্তু আগন্তুক তার গভীর সান্নিধ্য প্রত্যাশী। আসলে দেশ-কাল-ব্যক্তিরূপ ছাপিয়ে এভাবেই হয়ে ওঠেন অপরিহার্য এক বিস্ময়। স্বেচ্ছাচার যদি ছদ্মবেশ হয়? ছন্দের রহস্যে যদি ডুবসাঁতারে নামে শব্দের গোষ্ঠী ? যে নেশাগ্রস্ত পদ্যসমগ্রকে কলকাতা আর সিংভূম দিয়েছে যৌথ নাগরিকত্ব, সেই অনন্ত মহানদীর পংক্তিস্রোত যখন আজীবন মোহগ্রস্ত করে পাঠককে, তখন নিশ্চিত প্রস্তাবে, সেই সংকেত-সরণীর একক পথিকের নাম হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
- প্রথম পাতা
- বিষয়
- _গল্প
- _কবিতা
- _প্রবন্ধ
- _ভ্রমণ
- _ফটোফিচার
- _বাংলাদেশের কলম
- _ধারাবাহিক
- _ফিল্ম রিভিউ
- _পাঠ পরিক্রমা
- Editions and Archive
- _২৫শে বৈশাখ
- _বৈশাখী সংখ্যা
- _স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা
- _প্রাক শারদ সংখ্যা
- _ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সংখ্যা
- _শারদ সংখ্যা
- _মাহশা ইরান সংখ্যা
- _দীপাবলি সংখ্যা
- _ঋত্বিক ঘটক সংখ্যা
- _শক্তি চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা
- _শীতকালীন সংখ্যা
- _প্রথম বর্ষপূর্তি সংখ্যা
- _বইমেলা সংখ্যা
- _ভাষা দিবস সংখ্যা
- _দোলযাত্রা সংখ্যা
- _পয়লা বৈশাখ সংখ্যা
- _কার্টুন সংখ্যা
- _শারদ সংখ্যা ১৪৩০
- _বিশেষ সংখ্যা
- _রক্ত করবী সংখ্যা
- Contact Us
- Editorial Team
- About Us