দোঁহা

দৃষ্টি বদলের কবিতাগুচ্ছ:ছিন্ন বিচ্ছিন্ন



সব্যসাচী মজুমদার

১.
আগাগোড়া মিথ ছড়িয়ে রেখে গেছেন, নাকি আমরাই মিথিক্যাল করে তুলেছি কবিতা বহির্ভূত বিষয় আশয়? এ প্রশ্ন অন্ততঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে সমাধানহীন। আজ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে পড়তে চলেছি যে কাব্যকে, অর্থাৎ 'ছিন্ন বিচ্ছিন্ন'(১৯৭৫), তার প্রস্তুতি পর্ব সম্পর্কেও সমানভাবে শক্তি-সংবাদ প্রচলিত থাকলেও, সেই সদা পিচ্ছিল পথে অগ্রসর হতে চাই না। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আসলে তো কাল পেরনো কিছু কবিতাই লিখেছেন এবং কবিতাই লিখেছেন। আর কিচ্ছু নয়।

২.
'ছিন্ন বিচ্ছিন্ন' রচিত হচ্ছে কবির বিয়াল্লিশ বছর বয়সে। এর পূর্ববর্তী প্রহরে না বলে, বলা ভালো, সমকালে বিস্ময়করভাবে ঐ ১৯৭৫-এই প্রকাশিত হচ্ছে কবির আর‌ও তিনটি কাব্যগ্রন্থ, 'ইশ্বর থাকেন জলে', 'অস্ত্রের গৌরবহীন একা', 'জ্বলন্ত রুমাল'।কাব্য তিনটির শরীরে চোখ রাখলেই আপনার পাঠে স্পষ্ট ধরা পড়ে যাবে, কবিতার কালীক ও পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনগুলি। প্রতিটি কাব্য একটি আরেকটির পর থেকেই যেন শুরু হচ্ছে। উনিশশো পঁচাত্তর সালে প্রকাশিত শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের চারটি কাব্য যেন আলাদা গ্রন্হাবলী নয়। একান্তই একটা প্রলম্বিত সিরিজ। যার বিন্যাস কয়েক মাসের এবং 'ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন'-এর শ্লোক সকলে যার পরিণতি।

আপনি 'ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন'-র পূর্ববর্তী কয়েকটি কবিতার ওপর অভিনিবেশ রাখলেই এই বক্তব্য পরিস্ফুট হতে পারে। এক হতচ্ছাড়া যুদ্ধ চাই, কার জন্য এসেছেন, আমাদের সম্পর্কে, তাঁকে, পাথর গড়িয়ে পড়ে/গাছ পড়ে বোধে, এবার আমি ফিরি, টোবোর বাংলোয় রাত, মানুষের মধ্যে আছো-তে ছড়িয়ে রাখা চিহ্নগুলো ধরে ধরে যদি পৌঁছে যাই, 'জ্বলন্ত রুমাল'-এর কাছে, শেষ চারটি পংক্তি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে,

"মানুষের মধ্যে থেকে ভালোবাসা শূন্য হয়ে গেলে
তাকেই পাথর বলে ছায়ারোদে ওঠে মুখোমুখি-
যেন বা সরল গাছ খোয়াই প্রান্তরে পড়ে আছে।
এক দীর্ঘ পড়ে থাকা মানুষের মৃত্যুর‌ও অধিক।।"(জ্বলন্ত রুমাল)

কেননা, এর পরেই আপনাকে পড়তে হবে 'ছিন্ন -বিচ্ছিন্ন'র প্রথম স্তোত্রখানি,

"দুঃখ নিবিড় একটি ফোঁটায়-দুঃখ চোখের জলে
দুঃখ থাকে ভিখারিনীর এক মুঠি সম্বলে।
ছোট্ট হয়েই আছে
একের, না হয় বহুর, না হয় ভিড়ের বুকের কাছে।"(১)

এক আশ্চর্য পরিশুদ্ধি তৈরি হয় পাঠকের রসিক হৃদয়ে। দুঃখ, চোখের জল, ভিখারিনী, এক মুঠি সম্বল-টিপিক্যাল দারিদ্র্য সংবলিত কয়েকটি চিহ্ন ব্যবহার করে শক্তি রচনাটিকে অনায়াসে প্রতিবাদের কবিতায়, আর‌ও নিরপেক্ষভাবে বলা যায় আকাঙ্ক্ষার আয়াতে পরিণত করতে পারতেন। কিন্তু, অভিপ্রায় ছিল পিনদ্ধ। রচনার শেষে লিখেছেন,

"একটি ঝিনুক থাকে
জন্ম থেকেই, একটু-আধটু, বাইরে ফেলে রাখে।"

এই অন্তিম 'সা'যেন বৈরাগী। ক্রুদ্ধের বদলে কান্না শেষের সান্দ্র করে দেয়। যন্ত্রনা, ময়লা ন্যাকড়া, সাদা ঠোঁটের কোনা-সব কিছু মুছে যায়। কেবল বিদ্ধ কাতরতার সুখ থেকে যায়, একটি মাত্র শব্দের অভিঘাতে, 'ভিখারিনী'।

 অসহায়ের আততি, স্বরূপ দেখানোর বাসনা ছিল না।'ভিখারীদের' শব্দটিও স্বরবৃত্তে চারমাত্রা। ব্যবহার করলে অনায়াসে এ কবিতা কবিকে টেনে নিয়ে যেতে পারতো শব্দের রূঢ় দশায়। কিন্তু এখানেই, এই পাঠককে শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রথমাবধি বিস্ময়াবদ্ধ করে রেখেছেন, অবিকল্প শব্দ সংযোজন এবং শব্দের অভিপ্রায়কে গ্রাস করে ফেলে ব্যবহার করায়। 'ভিখারি' শব্দটির স্ত্রী লিঙ্গ প্রয়োগের কারণ যে প্রেম ব্যতীত আর কিছুই নয়, মাতৃত্বের ঝিনুক‌ই মাত্র, এক‌ই পংক্তিতে উপুর্যপরী 'দুঃখ' আর 'সম্বল'এই পরস্পর বিপরীত ব্যঞ্জনার ব্যবহারে দ্বন্দ্বের দর্শন নির্মাণ করে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন পাঠককে।
৩.
হার্বাট রিও একদা একটি চমৎকার কথা লিখেছিলেন,

"The word-music, image, metaphor are the blood stream of poetry, without which it can not for a moment exist."

প্রায়শই প্রতিধ্বনি শুনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'ছিন্ন বিচ্ছিন্ন 'পড়বার সময়। কী প্রবল সংগীত ধর্ম! বাংলা শব্দ ও পদের নিজস্ব স্বর ও সুরের চলনে ভরা নামহীন পদগুলির প্রত্যেকটি, এক‌ই সঙ্গে রূপক দৃশ্যের নির্মাণ করেই চলেছে অনায়াস গতিতে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় অনির্ধারিত শব্দের ওপর, সম্ভবত, অধিক নির্ভর করতেন বলেই তাঁর অধিকাংশ রচনার মতোই এই শিরোনামহীন কবিতাগুলিও সহজগতিতে স্বচ্ছ। সরলভাবে বলে যেতে পারছে একটি জীবনের দর্শনের অংশ,

"দুঃখ কিছু গোপন এবং দুঃখ কিছু কাছের
হয়তো আমার মধ্যেও তার বসার জায়গা আছে
দু‌ঃখ কিছু পাথর এবং দুঃখ থাকে কাদায়
দুঃখ আছে বাইরে এবং ঘরদুয়ারে বাঁধা"(১৭)


৪.
প্রধানত স্বরবৃত্ত ছন্দ এবং স্বরবৃত্ত ব্যতীত কথ্য, গদ্য ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে সমানভাবে ব্যবহার করলেন। কখনও যেন আনমনা, সাজিয়ে গেলেন শব্দ সংস্হান, কিছু আলুথালু,

"তখনো গাছের কাছের কাছে ছায়া পড়ে আছে
কিছু পাতা, কিছু ফুল
মানুষের মধ্যে ভুল
পড়ে আছে।"(২৭)

পরক্ষণেই সে ভঙ্গি সরিয়ে গদ্যের সপাট বলে ওঠে,

"আগুন যথেষ্ট আছে
কাঠ আছে
কর্তব্য রয়েছে
একমুষ্টি ভাত নেই, ভাতের গন্ধ‌ও নেই কোনো।"(২৯)

 এডগার অ্যালান পো-র সেই বিখ্যাত গল্প 'দি ওভাল পোর্ট্রেট'-এ যখন তরুণ তাঁর আঁকা ছবিতে দেখতে পান জ্বলজ্যান্ত জীবন, তখন সে ছবির উৎস-প্রেরণা, তার স্ত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। এ -প্রসঙ্গে যে-নিষ্ঠুর নির্লিপ্তির কথা উঠে আসে, সেই নির্লিপ্তি আদৌ ছিল না শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়। এ রচনাগুলোর আলেখ্যেও নির্লিপ্তি ভিন্ন বোধ গড়ে তোলেন। যার মধ্যে থাকে বহুমাত্রিক বয়নের ইঙ্গিত,

"দেরি নেই, অসংখ্য সোনালি সুতো গাছে পড়ে আছে
পাতায় পাতায় তার নরম, কোমল তুলো আর
সোনালি তাঁতের পাশে কারিগর পণ্যের সম্ভার
নামিয়ে দিয়েছে।"(৩৩)

এখানে আপনার অবলোকনে এসেছে এক‌ই পদ হিসেবে 'সোনালি' শব্দের দুটো পৃথক সম্বন্ধে ব্যবহার। প্রথমটি কর্তা সম্বন্ধে, দ্বিতীয়টি কর্ম -সম্বন্ধে। এবং ব্যবহারের প্রেক্ষিতভিন্নতা আপনাকে যে বহুমাত্রিক দৃশ্যের ভেতর নিয়ে চলেছে, সেই বহুমাত্রার কথাই ইতিপূর্বে বলতে চাওয়া হয়েছে,

"সোনালি রুপোলি মানুষের শিশু
মানুষের সঙ্গে সমুদ্রে যায়...
ওদের যাওয়া দরকার।"(৪৫)

 -রঙে রঙে এক‌ই সঙ্গে শ্লেষ ছড়িয়ে গেলেন।'মানুষের' শব্দটি ব্যবহার করার ফলেই 'সোনালি' আর 'রুপোলি' রঙ দুটো কর্কশ, নির্মম আত্মশ্লেষ তৈরি করে নেয়।
 
কীর্ণ কবিতাগুলোর প্রত্যেকটির মধ্যে যেমন পরিচিত শক্তি চট্টোপাধ্যায় রয়ে গেছেন, স্মরণীয় পংক্তি বয়ানে,

"কে যেন ঈশ্বর তাই মাঠে বসে আছে"(তাই -শব্দটির জাদু ছড়িয়ে গেল যেন )
কিংবা,
"এভাবে নয়, এভাবে ঠিক হয় না
নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে, পাহাড় তাকে সয় না
এভাবে নয়, এভাবে ঠিক হয় না"

এই আশ্চর্য চূর্ণের শেষে নিয়তির মতো সমাধান নির্বাচন করেছেন শক্তি-সাঁই,

"কেমন করে ফুলের কাছে রয়
গন্ধ আর বাতাস দুইজনে
এভাবে হয়, এমনভাবে হয়।"(৫৩)

এই সম্পৃক্তির নেশা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাকে তীব্র করেছে, কোমল করেছে, মানবিক করে তুলেছে-এমন‌ই সচরাচর অধরা শক্তি এক‌ই সঙ্গে ভালোবাসার স্তোত্র বলে যান,

"সে শুধু পালায় দূরে, ত্রস্ত ঘুরে ঘুরে
সে শুধু পালায় আর একলা বসে থাকে
ঘর থেকে দূরে গিয়ে প্রকৃত পোশাকে"...

বলেই কবিতাটির স্তবক গঠনের নিয়ামানুবর্তী না হয়ে একটি স্পেস ব্যবহার করে লিখছেন,

"সে শুধু পালায় আর একলা বসে থাকে "(৬০)।

ধ্রুবপদ হিসেবে পংক্তিটিকে ফিরিয়ে আনার আগে ঐ নাটকীয় কাল-প্রক্ষেপণ অমোঘ হয়ে ওঠে কবিতাটির ক্ষেত্রে। এই পালানো আর একলা বসে থাকাটি আর‌ও একটি ভিন্ন অবস্থানের আয়োজন করল। প্রথমটি অভিধেয়ার্থে ব্যবহৃত হলো।দ্বিতীয়টি লক্ষণার্থে ব্যবহৃত হতে পারতো, ঐ স্পেস দিয়ে তাকে সরাসরি নিয়ে চলে গেলেন ব্যঞ্জনার্থে তৈরি রূপকে। এক অর্থে বিপরীত অভিপ্রায় তৈরি করে দিতে লাগল এই একলা এবং বসে থাকা। একাকীত্ব যেন বিস্তারিত হয়ে যায় এবং নিশ্চিত ভাবে গ্রাস করতে থাকে বহুত্বের বাসনামূল,

"পথে পড়ে আছে চাঁদ, তাকে নাও তুলে
সংকেতের মতো রাখো কৃষ্ণ সিঁথিমূলে
জঙ্গলের, আর নিজে পাহাড়ে দাঁড়াও-
চূড়ায়...(১০৯)

৫.

'ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন' মূলত সুফিয়ানায় বিশ্বাস করেছে। ক্রমশঃ আত্ম-নির্লিপ্ত হতে হতে এমন একটা জগতের নির্মাণ করে ফেলা, যে জাগতিকে কীর্তিনাশা সভ্যতার দখল থাকে না,

"ফুলের মতো সহজ হয়ে আসে
তোমার কিছু বলার মতো ভাষা
দেয়াল নেই, দরজা নেই তাতে
তোমার হাত রেখেছি দুই হাতে"(১১১)

সেই জাদু স্ফিতির সন্ধান বাংলা কবিতায় নতুন না হলেও বয়ান চাতুর্যের বহুমুখী ইশারায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় এ-কাব্যকে করে তুলেছেন দৃষ্টি বদলের কবিতাগুচ্ছ,

"কাছে আনো, দূরে নিয়ে যাও
সুন্দর সর্বত্র আছে, এই কথা জানো।"(১০২)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন