দোঁহা

অন্তরঙ্গ কথনের কবি

 

মালবিকা মিত্র

না না, শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার পছন্দের কবির তালিকায় ছিলেন না কখনো। তার কবিতা আকাশের দিকে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলে ধরে শ্লোগান হতোনা। আমার শৈশবে ছিল ষাট দশকের খাদ্য আন্দোলন, দু দুটো যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন ও তার পতন। জয়প্রকাশ নারায়ণের ডাকে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন, বিশ লক্ষ রেলওয়ে শ্রমিকের লাগাতার ধর্মঘট, বারো লক্ষ ডাক ও তার কমর্চারীর লাগাতার ধর্মঘট, সর্বোপরি এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা। দুরন্ত গতিতে ধেয়ে আসা ষাঁড়ের মতো সময়। তখন আমার প্রিয় কবিতা প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য। 

এরপর জরুরি অবস্থার দিনগুলো কাটলো আমার কিশোর বেলায়। শৃঙ্খলা আর উন্নতির রাষ্টীয় ঢক্কা নিনাদ ও তারই পাশাপাশি নির্বিচারে দমন পীড়ন। এই কি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সময়? বরং "রাত্রির তপস্যা সেকি আনিবে না দিন" পোষ্টার লিখেছি। দেওয়ালে লিখেছি "তুমি আলো আমি আঁধারের আল বেয়ে, আনতে চলেছি লাল টুকটুকে দিন"। লিখেছি,

"ছড়ানো সূর্যের কণা 
জড়ো করে যারা 
জ্বালাবে নতুন দিন
তারা আজও পলাতক। 
দল ছাড়া ঘুরে ফেরে 
দেশে আর কালে
রাত্রির সাম্রাজ্য তাই এখনও অটুট। 
তবু সূর্য কণা বুঝি হারাবার নয়।"

জরুরি অবস্থার আপাত শান্ত শ্মশানের শান্তির দিনে দেওয়ালে লিখেছিলাম,
 
"আজকের নৈঃশব্দ হোক
যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি।" 

এইসব কবিতার পাশে কোথায় স্থান দেবো সেদিন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে। 

১৯৬৬ র খাদ্য আন্দোলন। আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী। পাঠশালার বারান্দায় আমাদের ক্লাশ। আর রাস্তায় রক্ত পতাকার মিছিল। শহীদ নুরুল আনন্দের হত্যার জবাব চাই...রক্ত ঋণ শোধ করো। আমি সেদিন কিছু বুঝে কিছু না বুঝে কাঁচা হাতে ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে দিলাম "রক্ত ঋণ শোধ করো"। পুরো ক্লাশ আমাকে কান ধরে ওঠবোস করানোর পর সাক্ষাৎ যম হেড মাষ্টার আমাকে দুই হাতে ইট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলো ছুটি পর্যন্ত। আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। এখানে কোথাও কোনো ভাবে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা খুঁজে পাইনি। বরং মনে পড়েছে
"এ লড়াইয়ে তুমি নও প্রসন্ন? 
চোখ রাঙানো কে করিনা গণ্য
ধারি না ধার।"

জীবন তো আর ব্রেক ফেল করা বাস নয়। একই ভাবে শুধু চলতেই থাকবে। জরুরি অবস্থার অবসান হলো ১৯৭৭ সালে সারা দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটলো। কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে পরিবর্তন। সেই বদলের হাওয়ায় দেখি আমার "সাক্ষাৎ যম হেড মাষ্টার" লাল ঝান্ডার লোকাল কমিটির সদস্য। সময় পাল্টেছে বুঝতে পারলাম। এখন সোচ্চারে অন্যকে ডাক দেওয়া নয়, ঘোষনা নয়। নিজের সাথে অন্তরঙ্গ আলাপ আত্মকথন আত্ম বিশ্লেষণের সময়। বোঝাপড়ার সময়। 

"এবার হয়েছে সন্ধ্যা। সারাদিন ভেঙেছো পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো 
শালের জঙ্গলে
তোমারও তো শ্রান্ত হলো মুঠি
অন্যায় হবে না–নাও ছুটি
বিদেশেই চলো
যে কথা বলনি আগে, 
এ-বছর সেই কথা বলো।"

এবার মনে হচ্ছে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমাদের অন্তর্গত কথা বলেন। মনের কথা, মনের সাথে। দৌড়ের সময় অন্য কোনও দিক নয়, শুধু সামনে চোখ রেখে দৌড় হয়। থামলে, তবেই আশপাশে পেছনে নিজের দিকে তাকানো যায়। ১৯৭৭ এর পর যখন এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন উদয় হলো, এতো রক্ত অশ্রু ঘামের বিনিময়ে কি পেলাম? সব কিছু ব্যর্থ পন্ড মনে হয়, প্রার্থনার সকল সময়। কারোর কোনো কাজেই লাগিনি এতদিন। এরচেয়ে ঢের ভালো ছিল, "পড়ে থাকি ঢিবি হয়ে" পথের 'পরে'। পথক্লান্ত পথিকের যদি মেলে মুহূর্তের বিশ্রাম। এই দেখো অজান্তেই কখন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শব্দগুলো আমি আশ্রয় করেছি। 

আধুনিক তথাকথিত উন্নয়নের ধাক্কায় নগর কলকাতার রাস্তা থেকেও আর আকাশ দেখা যায় না। সর্পিলাকার ফ্লাইওভার মেট্রো রেল আকাশ ঢেকে দিচ্ছে। আমরা নাগরিক ক্লান্তির চাপে ধ্বস্ত। তখন জঙ্গলমহল থেকে আসা মজুরেরা পাতা আর টিনের অস্থায়ী আবাসে আগুন জ্বেলে রুটি শেঁকে, ধামসা মাদল বজিয়ে, কলকাতার বুকে নামিয়ে আনে এক টুকরো জঙ্গল মহল। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় দেখে পাগল পারা হন। আমিও কি এমন কিছু দেখার আশায় উন্মুখ থাকি না। ঝাঁ চকচকে আভিজাত্যের গায়ে গ্রাম্য মলিনতার ছোঁয়া আমাকেও তৃপ্তি দেয়। বুঝি আমার মনেও নেশা ধরে। 

জলা ভেড়ি বাগান জঙ্গল লোপাট করে সেই কবেই কলকাতা নগরী সল্টলেক থেকে রাজারহাট নিউটাউনে বাড়তে থাকে লম্বায় বহরে উচ্চতায়। 

যত বড়ো রাজধানী 
ততো বিখ্যাত নয় এ হৃদয় পুর। 

মানুষের তরে মানুষের নেই কো সময়। শুধুই "হৃদয়ের অপচয়"। আশৈশব শুধুই ছুটে ফিরলাম মরিচিকা সম স্বপ্নের পেছনে...আনতে চলেছি লাল টুকটুক দিন। কিছুই আনা হয়নি। মুঠোয় ধরা স্বপ্ন আর বাসি ফুলগুলো শুকিয়ে কাঠ। শত শত হাইরাইজে হারিয়ে গেছে তেপান্তরের মাঠ। তাই আমি আজ আর ছুটি না, সেই সামর্থ্যই বা কোথায়। পাঁচটি মাথা এক হলেই শয়তান ফাঁক খুঁজে নেয়। একটি মাথা নিয়ে আমি পড়ে থাকি ঢিবি হয়ে। যদি কোনো শ্রান্ত ক্লান্ত মানুষ মানুষীর বিশ্রাম হতে পারি।

মানুষ বড় একলা, 
তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও,
এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও 
এবং ভালোবেসে দাঁড়াও,
মানুষ বড় কাঁদছে, 
তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন