দোঁহা

একক শক্তি–চেতন ও অবচেতন

 

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রবীণ সভাপতি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এই সে প্রথম দেখলে এমন একটা কাণ্ড যার কোনো মানে নেই।" –[‘ভুল স্বর্গ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

শক্তিকে আমরা কেমন ভাবে চিনি? কেমন ভাবে আমরা চিনি কবিতাকে? লক্ষ্য করে দেখবেন, আমি সচেতন ভাবে আগের বাক্যে ‘তাঁর কবিতাকে’ না লিখে ‘কবিতাকে’ লিখেছি কেবল। সচেতন ভাবে এ’কথা লিখেছি কারণ–শক্তির জন্মদিনে আমাদের শক্তির চেয়েও বেশি করে, কবিতাকে উদযাপনের দিন। কবিতা যে কখনও কখনও যাপন হয়ে ওঠে, জীবন হয়ে ওঠে–যে সমস্ত কবির ব্যবহারিক জীবন থেকে এই বক্তব্যকে সবচেয়ে স্পষ্ট ভাবে উপলব্ধি করা যায়, নিঃসন্দেহে শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন। শক্তি কবিতাকে জীবন করে নিয়েছিলেন। যাপনকে কবিতা করে নিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বোহেমিয়ানিজম আদতে কবিতা। গোছানো, বাঁধাধরা, নিয়মের গণ্ডিতে, বাঁধা-ধরা পৃথিবীর প্রতি প্রত্যাখ্যানের কবিতা। তাঁর অস্থিরচিত্ততা, একেকজনের সাজানো সংসার-আপন করে নেওয়া জীবনের অধিকারী একেকজনের বিপরীতে প্রত্যাখাত, নিপীড়িত–হয়তো বা মানসিক ভাবে একা হয়ে যাওয়া, একজন মানুষের কবিতা। ভাঙাচোরা এই সমাজের ভাঙনকে সম্পূর্ণ করতে, শক্তির ‘পদ্য’ আদতে কশাঘাত, নিঠুরতা, ও প্রত্যাঘাতেরও কবিতা। শক্তির কবিতায় সেই আগুনেরই ওম ও তার দাহ্যক্ষমতারও প্রকাশ। দুইই সেখানে সমান উজ্জ্বলতা নিয়ে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।

কেবল সেখানে ছাই হয়ে থেকে গিয়েছে, অতীতেরও যা অতীত। কবিতার শব্দগুচ্ছেরাই কেবল নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।

আবার কে মাথা তোলে ফুলে ফেঁপে একাকার চাঁদ,
সাধ হয় মাথা তোলে ফাঁসা মাথা  একাকার মাথা,
গহ্বরে মাংসের ভিড়ে মাড় মুত ফুল রক্তপাত
আগায় দুপাড় পিছে... স্তম্ভ লাল, ছিলা লাল, লাথি” [‘জন্ম এবং পুরুষ’, কাব্যগ্রন্থঃ ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ফাল্গুন, ১৩৬৭]

অবচেতন। সম্প্রতি তাঁর এক প্রবন্ধে জয় গোস্বামী শক্তির কবিতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিখেছেন, শক্তির কবিতা আসলে ‘অবচেতনের উদ্ধার’। আগাগোড়া কবিতা-পৃথিবীই কি তাই নয়? আমরা কি আমাদের, অবচেতনের ভেসে চলা চিত্রগুচ্ছকেই অক্ষরে সাজিয়ে তুলতে চেষ্টা করিনা? কবিতা কি কেবলই তার প্রকাশ নয়?

আমরা শব্দ থেকে শব্দে লাফিয়ে চলি। ভাব থেকে ভাবে। চিত্র থেকে চিত্রকল্পে। দুর্বোধ্য, আধেক আঁধারে ঢাকা স্বপ্নেরই একক দৃশ্যে, একেক দৃশ্যে... আমরা কবিতাকে অনুসন্ধান করি। শক্তি ও তাঁর পরবর্তীতে আরও অন্যান্য সমস্ত কবি, লেখক, শিল্পী, চিন্তক–কবিতার ঘাটে এসে, কবিতার আশ্রয়ে এসে, অবচেতনের এই প্রতিরূপটিকেই নিজেদের ‘মুর্শিদ’ করে নিয়েছেন। বাধ্যই হয়েছেন একরকম। কবিতার পৃথিবীতে অর্থের চেয়েও ঝংকারের জোর বেশি। ভাবনার সাদা পিঠটির বিপরীতে, আবছায়া পিঠটিরই সেখানে উপস্থিতি, উদযাপন বেশি। যেমন ভাবে মহাকাশ বিজ্ঞানীর কাছেও চাঁদের বিপরীত পৃষ্ঠেরই আকর্ষণ অধিক। একই দশা হয়েছে কবিতা-উৎসুক মানুষেরও। চেতনের চাইতেও অবচেতন, স্পষ্টের চাইতেও অস্পষ্টের প্রতিই তার দুর্নিবার অভিযান। অসীম থেকে অনন্তের অভিমুখেই। শক্তির কবিতা একই সঙ্গে আমাদেরকে তাড়িত করে। ভাবিত করে। আবার প্রশান্তিরও হদিস দেয় কোথাও।

মাপ করবেন, আমি এখানে শক্তির জীবনী শোনাতে আসিনি। জন্মদিনে গঙ্গাপুজোর আয়োজন যদি বা করতেই হয় আমায়, সেখানে স্মৃতিচারণের বিপরীতে শক্তির ‘পদ্য’ময় পৃথিবীতেই বরং আমাদের চারণের আয়োজন করি...

...আমাদের যাপনের আয়োজন করি এখন। মুখোমুখি বসে পড়ি কবির সম্মুখে হঠাৎ। সামনে থাকুক খোলা টেবিল-কাঠ। বাঁশের কঞ্চিতে ঝোলানো দোয়াত কলম, অথবা টেবিলে সাজানো খালাসিটোলারই উপকরণ। প্রশ্নটা এখানে উপকরণের নয়। কাগজ কলমেরও নয়। খালাসি-মার্কা আয়োজনের তো নয়ই, একেবারেই। যে মানুষ ছেঁড়া, ঝোলের হলুদ লেগে থাকা ন্যাপকিনের উপরেও পদ্য লিখে দেওয়ার অনায়াস ক্ষমতা রাখতেন, বইমেলার মাঠে দাঁড়িয়ে নাছোড়বান্দা সম্পাদকের পিঠের উপরে রাখা দুমড়োনো কাগজের ক্যানভাসে এঁকে দিতেন স্পষ্ট অক্ষরের ফসল–তাঁর নেশাগ্রস্ততার জন্য কখনও কোনও তরল অথবা বায়বীয় কোনও রাসায়নিক, জৈবিক পদার্থেরই কোনও সময়ে দরকার পড়ত না। ছবিরা এসে দাঁড়াত তাঁর মস্তিষ্কের ভিতর। দুই চোখ ভরে তিনি, তাঁর চারপাশেকার ছবিগুলিকে একে একে মস্তিষ্কে ভরে নিতেন। কখনও কখনও বা নিজস্ব অনুপানের খাতিরে তাতে চড়ত রঙ। কিন্তু তার চাইতেও বেশি কিছু নয় একেবারেই। সৃষ্টির সময় সেই সরল, সহজ, অথবা ঈষৎ রঙ মাখানো একেকটা অবয়বই হঠাৎ, এসে দাঁড়াত সেই মানুষটির চোখের উপর, লেখার কাগজে ঝরে পড়ত। অক্ষর হয়ে, শব্দ হয়ে ঝরে পড়ত। শক্তিও তখন বোধহয় স্বগতোক্তি করে বলতেন...


লিচু গাছের ঝুলন্ত সব ডালপালাতে,
জড়িয়ে আছে খেলার শিশু, পলকা হাতে
বোঁটার থেকে নিচ্ছে ছিঁড়ে রসের মুঠোর
মতন লিচুগুচ্ছ, এখন বিকেলবেলা।” [‘লিচু চোর’, কাব্যগ্রন্থঃ ‘ও চিরপ্রণম্য অগ্নি’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বইমেলা, ১৯৮৫]

কে বলে দুর্বোধ্য শক্তি চট্টোপাধ্যায়? কে বলে তিনি শুধুই অবচেতন? তাঁর প্রতিটি কবিতার অক্ষরে তিনি যে সমস্ত চিত্রের জন্ম দিয়ে থাকেন, চিত্রকল্পের জন্ম দিয়ে থাকেন, একটুও অথবা অনেকটুও তলিয়ে দেখলে পরেই, ভাবলে পরেই আমরা তার তল খুঁজে পেতে পারি। ছুঁয়ে দেখতে পারি শক্তিকেও। অনেক মাস আগে আমি যখন আমার এক বন্ধুর বাড়িতে প্রথম যাই, ছাদে নিয়ে গিয়ে সে আমাকে তাদের বাগানে একখানি লেবুগাছ দেখিয়েছিল। হাতে করে একখানি লেবুপাতা ছিঁড়ে নিয়ে, আমি তার গন্ধ নিয়েছিলাম। শহরে বেড়ে ওঠা আমি, এমন সুযোগ বড় একটা পাইনি। কেন পাইনি জানি না–পাওয়া উচিত ছিল বোধহয়। আমি শক্তির কবিতায় সেই অবচেতনের অন্ধকার অনুভূতিটাকে দেখতে পাই। যা কেবল গন্ধের ভিতরেই অবশিষ্ট ছিল। তখন সন্ধ্যে নেমে এসেছিল। পাতার রঙ অথবা গাছের গড়নকে তেমন ভাবে ঠাহর পড়ছিল না। কেবল অনেক দূরেকার এক দিগন্ত, কলকাতা শহরের ইঁট-কাঠ-পাথরের স্কাইলাইন, আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অবয়ব, তারও হাতে লেবুপাতার ঘ্রাণ। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে,

এমন অনুভূতির কারণ খোঁজা কি যায়? যাওয়া কি উচিত কখনও?
ফ্রস্ট বলেছিলেন, অনুবাদের কারণে যতটুকু হারিয়ে যায়–ততটুকুই কবিতা!
আমি বলতে চাইব, সমস্ত পার্থিব অস্তিত্ব, সমস্ত পার্থিব অর্থকে নিঃশেষে নিংড়িয়ে বের করে নিলে পরে–যতটুকু বোধ, যতটুকু অবচেতন বাকি পড়ে থাকে, ততটুকুই কবিতা!

ততটুকুই!

শক্তি লিখেছিলেন,

আমরা যাব রাত বিরেতে ধরনা দিতে।
দেখব লিচুবাগানখানি দেয়াল ঘেরা,
দরজা থেকে কেউ কি পারবো কুড়িয়ে নিতে–
ছড়িয়ে দেওয়া দুইটি লিচু পাতায় চেরা?” [‘লিচু চোর’, কাব্যগ্রন্থঃ ‘ও চিরপ্রণম্য অগ্নি’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বইমেলা, ১৯৮৫]

ফিসফিস করে কারোকে আবৃত্তি করতে শুনেছি, “সে কি জানিত না এমনি দুঃসময় / লাফ মেরে ধরে মোরগের লাল ঝুঁটি / সে কি জানিত না হৃদয়ের অপচয় / কৃপণের বাম মুঠি... সে কি জানিত না যত বড়ো রাজধানী / তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর / সে কি জানিত না আমি তারে যত জানি / আনন্দ সমুদ্দুর” [‘আনন্দ-ভৈরবী’, কাব্যগ্রন্থঃ ‘ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আশ্বিন, ১৩৭২]

এক অবাক আনন্দ শরীরকে গ্রাস করে। ভোররাতে, ঘুমচোখে, বরযাত্রী বোঝাই বাস থেকে নেমন্তন্ন ফেরত কুয়াশায় ঢাকা দ্বারকেশ্বর দেখার সুখ। একটু পরে সকাল হবে। বাস থেকে নেমে এসে রাস্তার পাশের দোকানে মাচাইতে বসে চা খাওয়া হবে। নবদম্পতি আসবে বিকেলে, অন্য গাড়িতে। আরাম করে জিরুতে জিরুতে। অথচ এই বাসেরই শেষ প্রান্তে এক দঙ্গল বরপক্ষের হইচইয়ের পিছনে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে দুজনে। এক বছরও তাদের বিয়ে হয়নি। বরযাত্রী সকলের মধ্যে তারাই কনিষ্ঠতম। বয়সের দিক থেকেও, বিয়ের দিক থেকেও। ক্লান্ত বধূটি, এখনও পুরনো না হওয়া স্বামীর কাঁধের উপরটিতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে রয়েছে। এসবই তো আমার নিজের চোখে দেখা। সত্য অবিকল! আমি সেই কুয়াশার ঘ্রাণ মেখে বুকে, নিশ্চুপে শক্তিকে আবৃত্তি করি। চোখ বুজে শ্বাস নিই, বুক ভরে ওঠে।

শক্তি আসলে কবিতাকে ভালোবাসতে চেয়েছিলেন। কবিতাও আসলে শক্তিকেই ভালোবাসতে চেয়েছিল। উজাড় করে সে অক্ষরের মতো, ঝর্ণার মতো শক্তির কব্জির হাড়গুলোয়, বুকের পাঁজরে, আঙুলের ডগাকার অক্ষরে পাখি হয়ে, প্রজাপতি হয়ে এসে বসত। আমরা তার নাম দিতাম কবিতা। আমরা তার অর্থ করতাম-হয়তো বা ‘রাজনীতি’, হয়তো বা ‘পদ্যনীতি’, ইত্যাদি... অবচেতন। আদতে কবিতার কোনও অর্থ হয় না। আদতে অর্থের আড়ালে লুকিয়ে কখনও কবিতা হয় না। প্রেমে পড়লে যেমন টুপ করে বুকের ভিতরটায় জল পড়ে, আগুন জ্বললে যেমন সমস্ত শরীর বিদ্রোহ করে উঠতে চায়, কখনও বা যুগের আহ্বান শুনলে পরে যেমন হাতদুটো আপনা থেকেই মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসে–কবিতা তো কেবল সেইটুকুই। শক্তি আমাদেরকে কেবল সেইটুকুই চেনাতে চেয়েছিলেন। বিস্মিত হয়ে উঠে সাজিয়ে দিয়েছিলেন প্রশ্নোত্তরের আসর–জবাব লিখে বলেছিলেন,

বদ্ধ ঘরে চাঁদের আলো দেখিয়েছিলাম
প্রবৃত্তি নেই।

বাতাস বইতে দিয়েছিলাম
প্রবৃত্তি নেই।

চতুর্দিকের কিছুই কি নয় স্মরণীয়?” [‘স্মরণীয়’, কাব্যগ্রন্থঃ ‘ও চিরপ্রণম্য অগ্নি’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বইমেলা, ১৯৮৫]

হে চিরপ্রণম্য ‘শক্তি’, হে সশব্দ আঘাত– তোমাকে স্মরণ করেছি!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন