আধেকজান
(পর্ব # ৩)
কিন্তু কোথায় বাস! রাস্তার ধারে লাট লাগানো অগুনতি বাসের ভিড়ে তাদের উদ্দিষ্ট বাসটি খুঁজে পেতে উদ্দালকদের কাল ঘাম ছুটে যায় যেন। চৈত্রের খরদুপুরে যখন কাক-চিল কিংবা পথকুকুরও ছায়ার আশ্রয়ে নিজেদের হারায়, তখন উদ্দালকরা ক্লান্ত পায়ে রোদ ভাঙে বাসের সন্ধানে পরস্পরের ছায়া মাড়িয়ে। বাসযূথের ধাতব শরীর থেকে ছিটকে আসা প্রখর আলোয় সে সন্ধান দীর্ঘতর হয় যেন। অবশেষে উদ্দিষ্ট বাসটি নজরে এলে তারা একযোগে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, সে কম্পনে রোদগলন্ত রাস্তার পাশ থেকে প্লাস্টিক প্যাকেট সহ কিছু ধুলো ঘূর্ণি তোলে, দূরতর রাস্তার পিচে মরীচিকা নেচে ওঠে।
--যা হোক দাদা, বাসটা নতুনই, লজঝড়ে নয়! রমেশ আশ্বাস খোঁজে বোধহয়।
বাসে উঠে দেখে অন্য পার্টির কয়েকজন বসে আছে। উদ্দালক আবার তার বাহিনীকে ফোনে ধরে এবং সবারই প্রায় একই উত্তর যে, তারা কাছেই আছে ও এক্ষুনি আসছে! যদিও এক্ষুনিটা কখন হবে বুঝতে না পেরে অগত্যা উদ্দালক সিটের পিঠে মাথা এলিয়ে দেয় চোখ বন্ধ করে, যে ভঙ্গিমায় হালছাড়ার অসহায়তা ফুটে ওঠে যেন বা। সে অসহায়তা এ কারণেও যে বাসের জ্বলন্ত ধাতবশরীর অনভ্যস্ত তাকে দগ্ধ করতে থাকে, অথচ বাইরেটাও ছায়াকৃপণ।
--দাদা, চিন্তা করবেন না। ওরা ঠিকই আসবে।
সরফরাজের এ আশ্বাসে অবসন্নতার ধূসরতা থেকে কষ্টে ভেসে ওঠে উদ্দালক। ক্লান্ত চোখ তার ছায়া খোঁজে দ্বিতীয় পোলিং-এর ভাসন্ত বাক্যে।
--সেই সকাল থেকে তো কিছু খাওয়া হয় নি। চিড়েভাজা খান। ব্যাগ থেকে প্যাকেট বার করে সরফরাজ।
এ নিবেদনে মায়া থাকে, যা শীতলতা দেয় উদ্দালককে। তবুও চটকা ভেঙে শশব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।
--না, না, আমার আছে আপনি খান।
--আরে, খান তো এখন এটা। এখনও অনেক সময় পড়ে আছে। তখন আপনার থেকে...অনন্যবাবু আপনিও হাত স্যানিটাইজ করুন।
ওরা তিনজন পকেট থেকে স্যানিটাইজার বের ক’রে যে যার হাত ভাইরাস মুক্ত করে। তিন ভোটযোদ্ধার চোয়াল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নড়ে চড়ে। ছটফটে রমেশ কম বয়েস বলেই বাসে তার ব্যাগ রেখে কোথায় যেন গেছে। ইতিমধ্যে তাদের দলের একজন পুলিশ লোটা-কম্বল, বালতি-মগ এবং অবশ্যই গাদা বন্দুক নিয়ে হাজির হয় ও জানায় যে তার সঙ্গীও আসছে। উদ্দালক একটু স্বস্তি পায় এ আগমন বার্তায়। একটু হাসি খেলে যায় তার মুখে—পুলিশের রাইফেলকে তার গাদা বন্দুক বলে মনে হয় কেন! পুলিশের থলথলে ভুঁড়ির জন্যই কি!
এক এক করে অন্য শান্তিরক্ষকটি, ভিডিওগ্রাফার এবং আধাসেনার দলও হাজির হয়ে যায়। অপর পোলিং পার্টিরও সকলেই এসে গেছে প্রায়। ঘড়ি দেখে উদ্দালক—দুটো চল্লিশ। ধোঁয়া উগরে, ধুলো উড়িয়ে কোনও কোনও বাসও গড়াতে শুরু করে দেয় রণাঙ্গনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাদের বাস কখন ছাড়বে বুঝতে পারছে না উদ্দালক। এক পোলিং পার্টির সেকেন্ড পোলিংবাবু নাকি আসছি-আসছি বলে তার প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ লুকোচুরি খেলার পর অবশেষে নেহাত্ই দায়ে পড়ে ধরা দিতে বাধ্য হয়। বা, বলা ভালো যে ধরা দিয়ে সে তাদের টিমকে ধন্য করে, কেননা তার যোগদানে তার প্রিসাইডিং সত্যিই কৃতার্থ বোধহেতু স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল। যদিও তার সুচেতনার মূলে ছিল এই শিবিরের এক নির্বাচনীকর্তার শো-কজ ধরানোর কড়া চেতাবনি। ভোটরঙ্গে দু-এক গণ্ডা এমন কমিক রিলিফ দস্তুরই নাকি! দেরিতে এসে বা কিছুক্ষণ লুকোচুরি খেলে সময় কাটাতে পারলে অনেক সময় শিকে ছিঁড়লেও ছিঁড়তে পারে নাকি। তখন রিজার্ভ থেকে অন্য লোক আসে আর এ লোকটি তার জায়গায় রিজার্ভে চলে যায় হাসতে হাসতে, নিজের বুদ্ধির নিজেই তারিফ করতে করতে, যেহেতু কাজ না করেই নির্বাচনী ভাতা তার ট্যাঁকে ঢুকে যায় গৌরী সেনের দয়ায়। অবশ্য এবারে পরিস্থিতি ভিন্ন, কেননা করোনার কল্যাণে বুথ সংখ্যা পঞ্চাশ শতাংশ বেড়েছে, ফলত লোকাভাব এবং কমিশনও কড়া তাই। ভোটের এসব রঙ্গ উদ্দালককে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয় এ উপল আবহাওয়ায়। কিন্তু তার স্বস্তি টাল খায় এ ধমকে,
--তখন থেকে শুধু এই আসছি- এই আসছি শুনছি। ভবিষ্যত্টাকে একটু বর্তমানে আনুন। গোটা বাসের সবাই হাজির, শুধু আপনি ছাড়া। আর দশ মিনিট বাদে বাস ছেড়ে গেলে আমি কিছু জানি না কিন্তু।
এ বার্তা উদ্দালককে ঘড়ির পানে চোখ ফেরাতে বাধ্য করে। সত্যিই তো তিনটে বেজে গেছে! সময়ের এ ঢলে পড়া তাকেও উদ্বিগ্ন করে তোলে যেন। আস্তাবল ফাঁকাই প্রায়। তাদের মতো কয়েকটি বাসই মাত্র এখনো ক্লান্ত শরীরে ঝিমচ্ছে রোদে ভিজে। অথচ একটি পোলিং পার্টির একজন পুলিশ তখনও এসে পৌঁছায় নি। ফলে সে পার্টির প্রিসাইডিং-এর উদ্বেগ উদ্দালকেও চারায়। উদ্বেগের টানেই সে নিচে নেমে আসে। বাসের চিলতে ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। তার মতো আরও দু-একজন এটুকু ছায়ার আশ্রয়েই শীতলতা ডেকে নেয় নিজেদের দেহে, অথবা মনেই। তাকে দেখে সরফরাজও নেমে আসে অনন্যের জিম্মায় মালপত্র রেখে। রমেশও আপাতত বাসেই মোবাইলে মশগুল।
অবশেষে সে পৌঢ শান্তিরক্ষক মুখে দেঁতো হাসি ঝুলিয়ে, ভুঁড়ি নাচিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয় এবং সে বিনা বাক্যব্যয়ে আগেই তার সঙ্গের ব্যাগ, বিছানা-মশারীর বাণ্ডিল ও অবশ্যই বালতি-মগ ছুঁড়ে দেয় বাসের অন্দরে। ততক্ষণে তার প্রিসাইডিং খিঁচিয়ে উঠেছে,
--এতক্ষণ কোথায় ডিউটি দিচ্ছিলেন শুনি? আপনার জন্য এই এতগুলো মানুষ...
-আরে দাদা, এখনই মাথা গরম করলে চলে? এ তো কলির সন্ধে সবে। এখনও আজ রাত, কালকের গোটা দিন।
বাসে উঠতে উঠতে মুখে ঝোলানো হাসির সঙ্গেই কথাগুলো ভাসিয়ে দেয় সে। রাইফেল সামলে মালপত্র টানতে টানতে বাসের পেছনপানে আগাতে আগাতে বাকি কথাগুলো উগরে দেয়।
--আপনাদের মতো কি আর আমাদের ডিউটি? এই তো আমাদের থানা এলাকায় তো আর আজ ভোট নয়, কাল ভোট প্রচার ছিল... নাও, সারাদিন রোদে দাঁড়িয়ে শান্তি বজায় রাখ... আজ আবার এই গরম... পেটটা গুরগুর করে উঠল... আবার বড়-বাইরে যাই...ভাবলাম এ অবস্থায় শুকনো না খেয়ে...
নিজেকে নিজের সিটে ছুঁড়ে দিয়েই সে পুলিশটি শান্তিতে শেষ কথাগুলো মেলে দেয়— তাই ভাতের হোটেল খুঁজতে গিয়ে এই একটু দেরী হল।
ততক্ষণে বাসটি গোঁ-গোঁ গর্জন তুলে ধোঁয়া উগরে, ধুলো উড়িয়ে গড়াতে শুরু করে দিয়েছে। কে একজন যেন আলতো উচ্চারিত হল— দুগ্গা! দুগ্গা!
বাজারের ভিড় ছেড়ে বাসটা একটু আগাতেই পথের ধারে শুয়ে থাকা গঙ্গা ফাঁক ফোকর দিয়ে উদ্দালকের নজরে লুকোচুরি বুনলে তার মন শীতলতা পায়। যদিও আহ্নিক নিক্তিতে বর্তমান অপরাহ্ন তবুও চৈত্রের আলো তখনও যেন যুবা, ফলে নদীর জলের ঢেউয়ে ঝিলিক হেনে সে আলো হাজার কেউটের হিলহিলে সৌন্দর্য আঁকছিল যেন! এ ঝলসানো সৌন্দর্যে উদ্দালকের আনমনা চোখ মাঝে মাঝেই ভেসে উঠতে বাধ্য হচ্ছিল।
বেশ কিছুটা যাওয়ার পর নদীটি দূরে সরে যায়। পথের দুপাশে জেগে ওঠে গ্রাম বাংলা তার সোনালি-সবুজ রঙে, যা উদ্দালকের নাগরিক মনের নজর টানে। মুগ্ধবিস্ময় ছায়া দেয় তাকে। গ্রীষ্মের ভরভরন্ত ধানগাছ তার সোনালি গড়নে গা এলিয়ে শুয়ে আছে দিগন্তজুড়ে, সবুজের আদরে। এতক্ষণে বিকেল তার নিজস্ব মায়াবী আলোয় সেজে ওঠায় সে সোনারঙ আদুরে-উজ্জ্বল যেন। যেন বা, ভ্যানগখীয় হলুদ! ভ্যানগখ বাংলায় জন্মালে এ অতিলৌকিক হলুদ তার ক্যানভাসে ফুটে উঠত কি? ভাবে উদ্দালক, যে ভাবনায় রঙের টান-টোন—তবে সে হলুদ কখনোই আগুনে উগ্র হয়ে উঠত না নিশ্চয়, বরং তাতে বিছিয়ে থাকত জীবনানন্দীয় নরম-উজল মায়া। উদ্দালকের নাগরিক মন আদর পায়। মনন পায় কি? জানে না সে।
আপাতত বাস ছুটে চলে বিকেল ছিঁড়ে তার কর্তব্যের টানে।
[ক্রমশ]