সব্যসাচী মজুমদার
একটি ঠিক একটি বিভাব কবিতার জন্য মলাট জুড়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো কাঁচা রক্ত। পাঠকের গায়ের রক্তে পানি...পানি রে পরদেশি পানি যেন তীক্ষ্ণ করে তুললো স্রাব। কড়ির একটা সা ভেঙে দিলো কোমলের সব রেখা। স্নায়ুতে তখন মালকোষ গুঁড়ো গুঁড়ো ভেঙে যেতে থাকে, একটু আগেই সে কী তীব্র রকম কোমল হয়ে ছিল। তাও কী ছিল!
একটা সংশয় আর সংশয়ের আর্তি আপনাকে অস্হির করে দিতে পারে এই পিয়া মনোভাবের পাঠে। মানে যেভাবে আপনি জীবনানন্দের সংশয়কে চিনেছেন ঠিক সেই দ্বিধা নয় কিন্তু। এ বোধহয় জীবন আর যাপনের সংশয় থেকে একটি তীব্র সুরের ব্যবহার করে ক্রমশঃ কথা হয়ে ছড়িয়ে পড়া দ্রুত গতে। ক্রমশঃ খণ্ড খণ্ড হয়ে মিশে যায় উতরোল নীরবতায়। কিংবা সমাধানহীন সংশয়রোলে। উৎপলকুমার বসু প্রণীত পিয়া মনোভাবের পাঠ অভিঘাত আমাকে দুটি অনুসরণের মিশে গিয়ে শূন্য হয়ে যাওয়ায় দৃশ্য দেখায়।
দু হাজার এগারো সালে প্রকাশিত হয় এই কাব্য। উৎপল বাবুর তখন বাহাত্তর বছর বয়স। কী মারাত্মকভাবে তখনও নিজেকে ভাঙছেন, একেবারে উল্টো ম্যাজিক দেখিয়ে দিচ্ছেন,
"পদ্মপাতা উল্টে যাচ্ছে জলে।/তুমি আমার অধিক কথা-বলা/মায়ের মতো নেমেছে পল্বলে-/সারা জগৎ তোমার কথাই বলে।"(স্মরণ)লেখাটির, অর্থাৎ প্রবেশক হিসেবে ব্যবহৃত লেখাটির শেষ হচ্ছে এইভাবে,
"মহাজীবন, তুমি ওদের খাতা,/ওই পিঁপড়েদের,পতঙ্গদের চলা,/পায়ের ছাপে ভরিয়ে তোলা পাতা-/মলমূত্রের বিন্দুবিসর্গতা/আজ বৃষ্টিজলে ধুয়ে যাচ্ছে বন,/শুনতে পাই মানুষজনের গলা-/আকাশজুড়ে মেঘের গর্জন,/স্মরণাতীত, তুমি আমার স্মরণ।"
আর চার বছর পরেই মারা যাবেন উৎপল। অনেকটা এপিটাফের মাধ্যমেই যেন প্রবেশ করলেন গ্রন্হের মূলপর্বে। পাঠের কোড দিয়ে দিচ্ছেন যেন ঐ প্রবেশকে। মূল গ্রন্থ বত্রিশটা কবিতায় নিবদ্ধ। তারপরে চতুর্থ প্রচ্ছদে একটি।লেখার শিরোনাম কেবল প্রবেশক ও চতুর্থ প্রচ্ছদেই আছে। বাকিগুলো অর্থাৎ মূলপর্বের বত্রিশটি শিরোনামহীন। সংখ্যা চিহ্নিত। ফলত সূচীপত্রে শিরোনাম দিয়ে পৃষ্ঠা সংখ্যা রাখা হয়েছে।
হিরণ মিত্র কৃত প্রচ্ছদে তখন পুরনো ফুলছাপে কাঁচা রক্ত গড়িয়ে চলেছে। সাদা জমি ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে কালো কিংবা লাল...
গ্রন্হের সূত্রপাতেই লিখেছেন উৎপল,
"দেব ও দেবতাগণে মিনতি জানাই, পায়ে পড়ি, এ যাত্রা/উদ্ধার করো, ঠিক সময় মতোই যেন এদের গ্রেফতার করি,/অত্যাচারে দিকভ্রান্ত করে রাখি-যতক্ষণ জলযান অ-প্রস্তুত,/আমাদের তৈরি হতে যতক্ষণ লাগে।"(১)
আমরা জেনে ফেলেছি মৃত্যুর পর আর কিছু নেই। থাকতে পারে না। থাকতেও নেই। অথচ আমরা ধারণা তৈরি করি।ধারনা তৈরি করেই আমাদের যাপন তৈরি করে নিতে হয়। নচেৎ বেঁচে থাকাটা ভীষণ বিষাদ সিন্ধু হয়ে যায়। এই ধারণা তৈরির সুমধুর মিথ্যেটা বহন করে শিল্প। নূহের নৌকায় চড়তে চায় না কে? কে চায় না তার অবয়ব না হোক শাশ্বত হয়ে থাক বীজক্ষেত্র। সে জানে তার জীবনের কোনও সমাধান নেই। তবুও ক্রম সংরক্ষণের নেশায় পড়ে অর্থনৈতিক মনস্তত্ত্ব। বিবিধ বাঁকে সে লড়াই করে করে অস্তিত্বের একটা আশ্রয় চায়।উৎপল বাবু জীবনের শেষ অধ্যায়ে নিরপেক্ষভাবে বুঝে নিয়েছিলেন এই দ্বন্দ্বমূলক স্হিতি বাসনাকে। আর তারই ফলাফল মধ্যবিত্তের সামাজিক মনস্তত্ত্ব আর সার্বিক বিণ্যাসের দ্বন্দ্ব। ভেবে দেখুন, কী অত্যল্প পরিসরে এক বাহাত্তরের বৃদ্ধ নিজেকে অবাধে ভেঙে বস্তুত এক স্বতন্ত্র হয়ে ওঠার বাসনায় গুমড়ে না উঠে বরং মুছে যাওয়ার প্রস্তুতিকালের কথা বলেছেন। এই নিরপেক্ষ আতপ কী আমরা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ে দেখেছি! এমনকি রবীন্দ্রনাথেও দেখি একটা সত্তার পক্ষে কথা বলছেন একক। কিন্তু বিসংলগ্নভাবে অপরের জন্য বলে দেওয়াটা বাংলা কবিতায় সম্ভবতঃ উৎপলকুমারই এনেছেন। জীবনানন্দও শেষতক কৈ মানুষ নিরপেক্ষ হলেন,
"তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ আর আমি জেগে আছি।/অথচ দু'জনে একই স্বপ্ন দেখেছিলাম।/নিদ্রায়, জাগরণে দেখেছিলাম/গাছে গাছে মুকুল ধরেছে, শীত শেষ হয়ে এল,/এ-বছর ফলন ভালোই হবে মনে হয়।"(৬)
তারপরেই আপনি ঢুকে পড়ছেন একটি বিনির্মীত দুনিয়ায়,
"অথচ এতো জানা কথা যে সে মাঝরাতে ফিরে আসবে--/দূরের জলাভূমি থেকে, বনজঙ্গল থেকে উৎসারিত হবে /ওই সুর। তখন হয়তো আমাকেই বেরিয়ে পড়তে হবে/তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য।"(২৭)
একটি বেহাগের পটভূমিটি বুঝতে শেষ পর্যন্ত কিন্তু ঐ জঙ্গল জলের কাছেই যেতে হচ্ছে অবিরল। আপনি ও আপনার আমার প্রহরগুলি বুঝতে পারছে ব্যাক্তি ব্যাতি রাখলে অস্তিত্ব ভীষণভাবে অনিপুণ। আর তখনই তীব্র শলাকা এসে বিঁধে যায় শরীরে। শূন্য টেনে নিতে থাকে টেনে নিতে থাকে,
"তন্দ্রা কেটে গেল। দেখি লেভেল ক্রসিং-এ
আটকে পড়েছে। পিছনের সিটে আমি একা।
সরোজ হয়তো চা খেতে গিয়েছে কোথাও, ধারে কাছে।
প্রচণ্ড বৃষ্টি নামলো। সত্যি জল নাকি? কাচ নামিয়েছি।
বাইরে হাতের পাতা মেলে ধরি। তীক্ষ্ণ একটা কিছু,
সূচের মতন, তৎক্ষণাৎ শিরায় বিঁধল। আজ রবিবার।
সকাল-সকাল এক রক্তদান শিবিরের উদ্বোধনে চলেছি।"(২৯)
এই তুমুল কড়ির সা-এ কেঁপে উঠেই সুর ধীরে ধীরে সমে ফিরতে থাকে। অতীতচারীতার ভেতর দিয়ে কাব্য পৌঁছে যায় আদিমতম দৃশ্যের কাছে। তারপর আবার ফিরতে থাকে সমপর্ব থেকে উত্তর পর্বের স্হিতি বাসনায়, ধারণার নির্মাণে, পুনর্নিমাণে-
ডাকে শ্বেত, হিংস্র লেখার পাতা,/ডাকে সিংহীর শৈশব, কবিদের প্ররোচিত করে/আরেক ছন্দের পথে-অস্হির অনিশ্চয় বোধে।"(৩১)
শেষাবধি ফসল সভ্যতার ডিসটোপিয়া ভেঙে পিয়া মনোভাবে কয়েকটি অস্পষ্ট অবয়ব রেখে যায় যারা ভেঙে ফেলার আর কিছু স্বতন্ত্র ভাবেনি,
"ধাতু ছিল পাথরের মুখোমুখি-মাটির গভীরে।
শূন্যতাও অবলম্বনহীন ছিল-অকস্মাৎ, মূঢ় ও জটিল।
খ্যাতি ভেঙে ফেলে ডালপালা। জড়ো করে। আগুন জ্বালায়।
এসেছে বেদনা,যেন নিজ ব্যয়ে তীর্থ দেখতে বেরিয়েছে।
গ্রামে ওরা যাঁতা ভেঙে খণ্ড খণ্ড করেছিল।"(৩২)
সপ্তর্ষি প্রকাশন
প্রচ্ছদ:হিরণ মিত্র
Tags:
পাঠ পরিক্রমা