রঞ্জনা ভট্টাচার্য্য
কবি জুয়েল মাজহারের মেধাবী কবিতায় শিল্প জিজ্ঞাসার সাথে ভাস্বর হয়ে রয়েছে সৃজনশীল মননপ্রক্রিয়া, আত্মবোধের পরিশীলিত প্রকাশ। মগ্ন চৈতন্যের খেলায় নতুন শব্দ-বন্ধের জাগরণ অনুভবের শ্রাবণ-সন্ধ্যাকে ছড়িয়ে দিয়েছে।
স্ফিংক্সের মৃত্যু
নৈঃশব্দ্য পাথর যেন। স্ফিংক্স দ্যায় একাই পাহারা/নিজের নিষেধ ভেঙে সে হঠাৎ কথা বলে ওঠে/
এরপর একটা স্তব্ধতা, দুটো স্পেস। পাঠক ভাবতে শুরু করেন 'কী বলে ওঠে' আর জন পৌলের কথামতো লেখক ও পাঠকের মধ্যে গড়ে ওঠে 'community feeling'.
কবি তারপর শুরু করলেন,
'নিজের ধাঁধার অর্থ-শেষবার-শোনায় নিজেকে /কথা তার ছুরি হয়ে নিজে থেকে পিঠে গেঁথে যায়'
আবার দুটি একক স্পেসের নৈঃশব্দ্য। প্রকরণ ও চৈতন্যের সংশ্লেষণ চলে এই গভীর তম স্পেসে। উঠে আসে লেখকের মনোভূমি বিমূর্তের আরাধনায়-
'তারপর মৃত্যু জ্বলে। সেদিকেই ছুটে চলে ধাঁধা'
এই কবিতাটি পাঠ করতে করতে দার্শনিক মোরিস মের্লো-পঁতির মন্তব্য ভেসে ওঠে:
'The writer's thought does not control his language from without; the writer is himself a kind of new idiom constructing itself'.
কবি জুয়েল মাজহারের কবিতা রূপান্তর ধর্মী, যা কবির কথোপকথনকে রূপান্তরিত করেছে কখনও শ্লেষাত্মক, কখনও শানিত, কখনও বা চেতনা উদ্দীপিত কাহন খেলায়। যাঁরা মন ও কবিতা বোঝার কবিতায় মাততে চান, তাঁদের ধানের খেতে বেগুন খোঁজার পণ্ডশ্রম মনে হবে কবি জুয়েলের কবিতা, যাঁরা মুক্ত আত্মার লীলা খুঁজবেন, তাঁরা কবির কবিতায় শিল্পের যন্ত্রণা ও সন্ত্রাস খুঁজে পাবেন।
যেমন:
'না-দেখা পাহাড়ে ওই
জ্বলে হাহ্-হা, জ্বলে চৈত্রদিন
ওঁ অনেক অবিমৃষ্যকারিতার হাহ্-হা
ওঁ অনেক লাল ঝুঁটির হাহ্-হা
ওঁ অনেক লাল মোরগের হাহ্-হা
ওঁ অনেক ডাগর চোখের হাহ্-হা
ওঁ কুঁকড়োর প্রত্যঙ্গ সটান-হাহ্-হা
রতিকলস্বরা মুরগিদের দিকেই তারা ক্রমধাবনশীর-হাহ্-হা/রতিপটু মুরগিদের ভণিতাময় দৌড়ে-পালানোর হাহ্-হা'(বিকেলের লাল বাকবাকুম)
এতো প্রকট ও প্রচ্ছন্নের খেলা, তীব্র ও তীক্ষ্ণতার এমন অসাধারণ কবিতা কেলি পাঠকের অন্যত্র চোখে পড়বে কিনা সন্দেহ। হাহ্-হা র বিদ্রুপে তাপ্পিমারা সমাজ ও ধর্মীয় বুজরুকির আত্মাহুতি (স্বাহা)
প্রত্ন পাখির চঞ্চুতে কবি গেঁথে দিয়েছেন তাঁর কবিতা। অনেক অদেখা স্রোত দেখতে শিখিয়েছেন :
'তাদের দাঁত এখন কামড় বসাচ্ছে গাছের কোমরে/অসতর্ক সরল মেঘেদের ও লেহনে উদ্যত তারা'(অক্ষরের কালো বড়ি গিলে)
অথবা
'গ্রন্থপাঠ শেষ করে চশমা নিভিয়ে দেখি, এ কী!
জ্ঞানমলে মাখামাখি নগ্ন-বিশীর্ণ-শৌচহীন/শুয়ে রয়েছেন আমাদের সকলের নিধিরাম পরম প্রপিতা;/তার দুই অণ্ড ঘিরে ভনভন করছে মাছিরা/
শিয়রে তখনও খোলা রয়েছে পুস্তক'(অক্ষরের কালো বড়ি গিলে)
প্রকৃতির রাজ্যপাট দেখা হলো না। একটা ঘু ঘু পাখি, তার বুকে ও গলায় ক্ষত নিরাময়ের প্রত্যাশা নিয়ে ফিরে গেল বিফল, আর আমরা প্রকৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে অক্ষরের বড়ি গিলে ডিকোড করে চলেছি আসলে 'জ্ঞানমল'।
জীবনের গভীর সত্যকে কবি দেখেছেন'কূর্মের বেদনা' রূপে ।
'আমি এক শক্তখোল কূর্মের ভিতরে সুকোমল/'হৃদয় লইয়া থাকি' কর্দমাক্ত আবছা জলাশয়ে/
শ্যাওলা ঢাকা খর্ব দেহ। যেন এক কিম্ভুত সসার/বিকল এঞ্জিনসহ মুখ থুবড়ে পড়েছি ডাঙায়/
-আদিম জলার পাশে। সঙ্গীহীন। একা নিঃসহায়!'(কূর্মের বেদনা)
জীবন কী শুধু এক তছনছ খোঁজ? অব্যক্ত বহুমুখী শরীরের অশরীরী খোঁজে কালো রঙের সাপ এঁকেবেঁকে অক্ষর ওগরায় প্রবল আশ্লেষে, অক্ষর গিলে ফেলে আহত হয় হাঁসফাঁসে।
শূন্যতার মধ্যে নেতির উপস্থিতি, নেগেটিভ ইলেকট্রন কণার ছোটোছুটি অকপটে তরঙ্গায়িত হয় কবি জুয়েল মাজহারের 'নিরালাপ' কবিতায়।
'পাঁচটি 'আমি'-কে আমি বয়ে চলি শরীরে আমার/জিভে স্বাদ, কানে বাক্য, ত্বকে ত্র্যহস্পর্শ, শিহরণ/শরীরী গন্ধক চায়, আর চায় মুখ দরশন/
পায় না কিছুই তবু। ভাণ্ড-ভাণ্ড না-পাওয়াকে পায়'
'অভ্যাসের তাঁত থেকে মুক্তি চায় মাকু/তুমিও তো তা-ই চাইছ, রাধে! '(অতি-অভ্যাসের তাঁত)
যে যৌনতা থেকে বসন্তের রোমাঞ্চ চলে গেছে, সেখানে 'মুখ হীন অখিল শূন্যতা!’
আত্মারামকে জানতে হলে সহজ সন্ধ্যা তারার দিকে 'মাকু' শুদ্ধ 'আমি' কে লাফ দিতে হয়, এই গুহ্য কথায় সহজিয়া সাধনার সুর।
'সংসারে লোকের ভাবাভাবিকে মূল্য দিয়া চলিতে হয়। আমাকে এবং-যিনি বুঝিয়াও না বুঝিবার ভান করিয়া খোঁপা বাঁধিবার ছলে কুচযুগ আন্দোলিত করিয়া আড়চোখে আমাপানে চাহেন-তাঁহাকেও। ইহাই রীতি। এই অতিশিষ্ট অণ্ডহীন-যোনিহীন মনুষ্যজঙ্গলে এইমত বিধান। এমত বিধানে যদিও এক মুষ্ঠি ধান্য ফলিবে না।'(ছাগাসুর)
সংসারের 'ভাবাভাবি' গুঢ়ৈষণার পথে বাঁধা। সহজ মিলন, সহজ ফসলের অন্তরায়। কবি মাজহারের কবিতায় যুগপৎ শৃঙ্খলা ও ধ্বংস পরিলক্ষিত হয়। এক অর্জিত অনুভূতির মধ্যে অনর্জিত উপলব্ধি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে, এক রহস্যময় সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে পাঠক যেতে যেতে আবিষ্কার করে দৃশ্য-অদৃশ্য, জগৎ-পরাজগৎ, পাঠকৃতি-পরাপাঠের অনির্বচনীয় সুষমা।
'There is a live cat, and there is a dead cat; but they are located in different worlds. It is not that the radioactive atom inside the box either did or didn't decay, but it did both. Faced with a decision, the whole world-the universe-split into two versions of itself, identical in all respects except that in one version the atom decayed and the cat died, while in the other the atom did not decay and the cat lived...'(In search of schrodinger's cat-John Gribbin)
কবি যখন লেখেন,
'পাঁঠাটির প্রতি আমার গোপন ঈর্ষা হইল। এমন সময় প্রতিবেশীর ট্রেসপাসার নচ্ছার হুলোবিড়ালটি কোথা হইতে আসিয়া আমার দিকে 'আইবল টু আইবল' তাকাইয়া কহিল' ম্যাঁও'।
তখন মনে হয় ঈর্ষা সেই রেডিও অ্যাকটিভ রে আর যৌনতা সেই পয়জন বক্স। 'প্রতিবেশীর ট্রেসপাসার নচ্ছার হুলোবিড়ালটি' শ্রয়ডিংগার'স ক্যাট, যে তার মৃত্যুর বিস্তার আর জীবনের ক্ষয়ের মাঝে ডেকে উঠলো, 'ম্যাঁও'কবির দিকে' আইবল টু আইবল' তাকিয়ে বলে উঠলো
রোমাঞ্চের জন্ম ও বোধ নিয়ে আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব।
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশক :আদম
প্রথম প্রকাশ : ২০২২, কলকাতা বইমেলা