দোঁহা

আমার রিয়াজ, আমার সাধনা



জয় গোস্বামীর মুখোমুখি অভিরূপ মুখোপাধ্যায় 

অভিরূপ:  ৬ নভেম্বর ১৯৮৯, ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’। আজ প্রায় ৩১ বছর হল। এই কবিতাটির উৎস কী? এবং কবিতাটি বেরোনোর পর পাঠকসমাজে কীরকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?

জয়:   কৈশোর বয়সে রানাঘাটে, আমি একজন তরুণীকে চিনতাম। খুব বেশি লেখাপড়া করেননি। কিন্তু সেলাইয়ের কাজ জানতেন। তাঁর জীবনে কলকাতা শহর থেকে আসা এক যুবক পদার্পণ করেছিলেন। তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে মাঝেমাঝে চূর্ণী নদীর ধারে ঘুরতে দেখা যেত। তারপর সেই যুবকটি একসময় তরুণীর কাছে আসা বন্ধ করে দেন। এই তরুণীও আর তরুণী থাকেন না। দিনেদিনে তাঁর বয়স বাড়ে। তিনি দুপুরবেলা একটি ছোটো ছাতা হাতে হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন পাড়ার গৃহবধুদের সেলাই শেখাতেন। তাঁর একজন বোন ছিলেন। সেই বোন অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। নিজের মাকে নিয়ে এই মহিলা জীবনযাপন করতেন। সেই মহিলার জীবন হয়তো ছায়া ফেলেছিল এই কবিতায়।  
কবিতাটি মানুষের কাছে পরিচিত হওয়ার পিছনে অন্য অনেকের বড়ো ভূমিকা আছে। অপর্ণা সেন এই কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। আবৃত্তি করেছিলেন বারবার ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়। লোপামুদ্রা মিত্র মঞ্চে মঞ্চে কবিতাটিকে গান হিসেবে পরিবেশন করেন। তারফলে, কবিতাটি পরিচিতি পেয়েছিল। 

অভিরূপ:  ‘উন্মাদের পাঠক্রম’-এর প্রকাশেরও সদ্যই ৩৫ বছর পার হয়ে গেল। ‘উন্মাদ’ অর্থাৎ বাঁধনহীন। আর, ‘পাঠক্রম’ মানেই শৃঙ্খলা। একজন উন্মাদের, পাঠক্রম কীভাবে থাকতে পারে? বইটির নামকরণ সম্পর্কে একটু বলুন?

জয়:   অসাধারণ বলেছ তো! একজন উন্মাদ যে বাঁধনহীন আর তার পাঠক্রম মানেই শৃঙ্খলা, এ-দুটো শব্দকে পাশাপাশি রাখা হয়েছে, সেটা তো আমি এতদিন খেয়াল করিনি! এ-প্রশ্নটি আমাকে মনে করিয়ে দিল তখন আমার জীবিকা ছিল গরুর দুধ বিক্রি করা। ঘুঁটে বিক্রি করা। বিচালি এবং খড় এনে গরুদের খাওয়ানো। সেই অবস্থায় কবিতা লেখার মতন সময় থাকত না। কবিতাগুলি লিখতাম আমি মনে-মনে। তারপর কোনো একদিন দুপুরবেলায় বসে একসঙ্গে ৫টি বা ৬টি কবিতা খাতায় কপি করে নিতাম। বইটির নামকরণ সম্পর্কে শুধু এটুকুই বলতে পারি, তখন সে-কবিতাগুলি লিখে চলেছিলাম একটা ঝড়ের মধ্যে। হয়তো সে-কারণেই উন্মাদ-এর অনুষঙ্গ এসেছে। 
 

 অভিরূপ:  ‘আলেয়া হ্রদ’-এর দ্বিতীয় মুদ্রণের সময়ে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘কোনো কোনো কবির জীবনে বা কবিতায় একটা দিব্যোন্মাদ-পর্ব থাকে। ‘আলেয়া হ্রদ’ থেকে ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ পর্যন্ত সেরকম একটা পর্বের মধ্যে—একটা ঘোরের মধ্যে—কেটেছে জয়ের জীবন আর কবিতা। অতলতা আর সুদূরতা, ভয়ালতা আর মাধুর্যকে একমুঠোয় ধরে সে যেন তখন পালটে দিচ্ছিল বাংলা কবিতার চেহারা। সেই সৃষ্টির সময়টাকে খুব কাছের থেকে দেখতে পেয়েছিলাম বলে আজও আমার গর্ববোধ হয়।’ ভয়ালতা আর মাধুর্যের সেই সম্মিলন-মুহূর্তটি কীভাবে ঘটেছিল তখন?

জয়:  শঙ্খ ঘোষের মতন অত বড়ো কবি যে আমার কবিতা সম্পর্কে এমন অনুভূতির কথা লিখেছেন তা আমার কাছে পরম সম্পদ। ওঁর এই কথা যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ। অবশ্য এটা ঠিক, কবিতা রচনাকালে তার প্রক্রিয়াটি আমার কাছে অজানা থাকে। মাধুর্যের প্রসঙ্গে বলা যায়, তখন আমার পূর্ণ যৌবন। যৌবনের একটা মাধুর্য থাকে। আর, ভয়ালতার প্রসঙ্গে বলা যায় ঠিক তার আগেই দু-বার আমার হাসপাতাল-যাত্রা ঘটেছিল। অস্ত্রোপচারও হয়। তাতে আমি খুবই শারীরিক কষ্ট পাই। পাশাপাশি ঘটে আমার মায়ের মৃত্যু। এই মৃত্যুশোকের সঙ্গে এসে যোগ দেয় এক ভয়ঙ্কর দারিদ্র। এইসব মিলিয়ে হয়তো ভয়ালতার চেহারাটা এসেছিল কবিতায়। 

অভিরূপ:  ‘পাগলী, তোমার সঙ্গে’ বইয়ের একটি দীর্ঘকবিতা ‘সবচেয়ে উঁচু তারাকে আমি বলি’। এই কবিতাটি কীভাবে লেখা হয়েছিল?

জয়:  এ-কবিতাটিও লেখা হয়েছিল মাথায়-মাথায়। কবিতাটি আমি কাবেরীকে একটি পার্কে বসে পুরোটা মুখস্থ বলে গিয়েছিলাম। সেই মুখস্থ বলার সময় আমি বুঝতে পারি কবিতাটির রচনা সম্পূর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ কবিতাটি আমার মাথায় টুকরো-টুকরোভাবে ঘুরছিল, কাগজে কোথাও লেখা হচ্ছিল না। কাবেরীকে বলবার সময়ই আমি কবিতাটির পুরো চেহারাটা দেখতে পাই। তারপর এক সময় আমি কাগজ-কলম নিয়ে বসে কবিতাটি লিখি। 
   
অভিরূপ:  আমরা ভাবি, ‘মৌতাত মহেশ্বর’ থেকেই বুঝি বাচ্যার্থকে পেরিয়ে গেল আপনার কবিতা। কিন্তু ‘সূর্য পোড়া ছাই’-এও রয়েছে ‘আমার বিদ্যুৎমাত্র আশা’ বা ‘ঘরে রাধাবিনোদ আকাশ’—এমন আপাত অর্থহীন আশ্চর্য সব লাইন। এ-সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়?

জয়:  যেকোনো শব্দ তো একটি বিশেষ অর্থের বৃত্ত দ্বারা ঘেরা থাকে। সেই বৃত্তকে অতিক্রম করে গেলেই বাচ্যার্থকে অতিক্রম করা যায়। আমার লেখায় সেইরকম কখনো কখনো ঘটেছে। এখানে যেমন। 
 
অভিরূপ:  ২০১৭ সালের একটি সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, ‘এখন আমার মন ওই নৃত্যপর ছন্দের চাঞ্চল্যকে নিজের ভেতরে নেয় না।’ অথচ তার দু-বছর পরেই আপনার সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ ‘দৈব’ স্বরবৃত্ত-ছন্দে পরিপূর্ণ। এ-প্রসঙ্গে কিছু বলুন।

জয়:  ওই কবিতাগুলি লেখার সময়ে হয়তো মনের মধ্যে কোনো আনন্দ কাজ করেছিল। সেই আনন্দ-ই স্বরবৃত্ত ছন্দের রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসে। তবে, যৌবনের চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আমার ভেতর থেকে নৃত্যপর ছন্দের চাঞ্চল্য চলে গিয়েছে বলে আমার মনে হয়। অথচ এই বইটির লেখাগুলি ঘটে যায় আকস্মিকভাবে।

অভিরূপ:  কিন্তু আপনার ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘ফুল গাছে কী ধুলো!’-য় স্বরবৃত্তের কবিতা আছে। ২০১৩-র ‘বিষ’ বইটি প্রায় সম্পূর্ণ মাত্রাবৃত্তে লেখা। ৭ মাত্রাই বেশি। সেক্ষেত্রে আপনি কী বলবেন?

জয়:  তুমি ঠিকই বলেছ। এই কথাটা জীবনে বারবারই বুঝেছি, আমি কবিতায় যা লিখি সেটা আমি খুব সচেতনভাবে লিখি না। এই যে আমি বললাম, যৌবনের চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আমার ভেতর থেকে নৃত্যপর ছন্দের চাঞ্চল্য চলে গিয়েছে, তৎক্ষণাৎ তুমি প্রমাণ করে দিলে যে আমার নিকট-অতীতে প্রকাশিত দুটি বইতেই নৃত্যপর ছন্দ রয়েছে। ফলে, ঠিকঠিক যে আমি আমার কবিতা বুঝতে পারি তা কিন্তু নয়। সবটাই একটা অজানার ভেতর থেকে আসে, অজানার মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে। এবং অজানা কোনো এক গন্তব্যেই গিয়ে পৌঁছোয় শেষ পর্যন্ত। 

অভিরূপ:  একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক সদ্য পেরিয়ে এলাম আমরা। এই দশকে আপনি লিখেছেন সতেরোটি কবিতার বই, সাতটি উপন্যাস, তিন খণ্ড ‘গোঁসাইবাগান’, ‘রানাঘাট লোকাল’, ‘কবির মৃত্যু ও অন্যান্য গদ্য’ ‘জলঝারি’, ‘গানের হৃদয়’, এবং ‘একলা কান্নার স্নানঘর’—এতগুলি গদ্যের বই। সেইঅর্থে এই দশককেই আপনার জীবনের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল সময়-পর্ব বলে মনে হয়। তাই নয় কি?

জয়:  হ্যাঁ, তুমি এখন বলছ বলে মনে হচ্ছে, সত্যিই তো গত দশকে আমি অনেক লেখাই লিখেছি! এ-কথা তথ্যের দিক দিয়ে ঠিকই বলছ তুমি। আমি আর কোনো দশকে এত বেশি লেখা লিখে উঠতে পারিনি। কিন্তু ভালো লেখা লিখেছি কি? যা লিখেছি তা কি কিছু হয়েছে? ঠিক বুঝতে পারি না।
 

 অভিরূপ:  বিগত দশকে আপনি একাধিক সম্মানও পেয়েছেন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি.লিট। মুম্বাইয়ের লিট-ফেস্টের ‘পোয়েট লরিয়েট’ সম্মান। বঙ্গভূষণ ও বঙ্গ বিভূষণ। শরৎ পুরস্কার। সেরা বাঙালি সম্মান। ভারতীয় জ্ঞানপীঠ প্রদত্ত ‘মূর্তিদেবী পুরস্কার’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড। ভারতীয় ভাষা পরিসদের ‘রচনাসমগ্র’ পুরস্কার। এত পুরস্কৃত কবি হিসেবে আপনার নিজেকে কী মনে হয়?

জয়:  যখনই কোনো পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠেছি, তখন সে-মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছে আমার পূর্বে প্রাপ্ত সকল অপমানের কথা। ফলে, পরিপূর্ণভাবে প্রাণ-মন দিয়ে আমি আমার কোনো পুরস্কারকেই গ্রহণ করতে পারিনি। আমার এবং আমার প্রাপ্ত সকল পুরস্কারের মধ্যে সবসময়ই একটি দূরত্ব অবস্থান করেছে।

অভিরূপ:  আজ সাতাশ বছর ধরে আপনি কবিতা সম্পর্কে লিখছেন। আপনার দুই প্রজন্ম পরের কবিকে নিয়েও আপনি একটি পূর্ণাঙ্গ বই লিখেছেন: ‘কবিতা যশোধরা’। এই দীর্ঘ কার্যপ্রণালীর পিছনে আপনার মনের সক্রিয় চিন্তাবিন্দুটি কী?

জয়:  আমি প্রথমে লিখেছি অগ্রজ কবিদের বিষয়ে। সমসাময়িক কবিদের বিষয়ে। সম্প্রতি লিখতে শুরু করেছি প্রধানত যাঁরা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে কবিতা লিখছেন তাঁদের লেখা নিয়ে। তাঁদের সঙ্গে আমার ব্যবধান প্রায় চার দশকের। কিন্তু আমার থেকে চল্লিশ বছরের ছোটো বলেই একজন কবির অন্তর্জগৎ আমি পুরো বুঝে যাব, এমন ধারণা আমি করি না। আমি মনোসংযোগ করি। বোঝার চেষ্টা করি সেই কবির ওই বিশেষ কবিতার মন কী বলতে চাইছে। গাছ থেকে একটা ফল পড়ল। একজন লোক চিন্তা করলেন, গাছ থেকে ফলটা মাটিতে কেন পড়ল? এবং এরপরেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথা আমরা জানতে পারলাম। কিন্তু গাছ থেকে ফলটা কেন মাটিতে পড়ল? আকাশে কেন উড়ে গেল না? এই কথা ভাববার মতো তখন ওই একটি লোকই ছিলেন। তখন কি নিউটনের চেয়ে বয়সে এবং প্রতিষ্ঠায় বড়ো অন্য বিজ্ঞানীরা ছিলেন না? কিন্তু কই তারা তো কেউই এই জিনিসটা নিয়ে চিন্তা করেননি! ফলে, এমন নতুন কোনো কবিও থাকতে পারেন যাঁর চিন্তাজগৎ আমার ধারণার মধ্যে নেই। আমাকে চেষ্টা করতে হবে তাঁদের অনুধাবন করার। সেই চেষ্টাই আমি করে চলেছি। 

অভিরূপ:  আপনি সংবাদপত্রের জগতে কাজ করেছেন আঠাশ বছর। বহু খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গ-সান্নিধ্যলাভে সমৃদ্ধ হয়েছেন। সে-বিষয়ে কিছু বলুন।

জয়:  আমার পড়া এক উপন্যাসের একটি অংশ মনে পড়ছে। ঘরোয়া পার্টিতে গান গাইছে এক শখের গায়ক। সবাই শুনছে। সে যখন গান গেয়ে নেমে এল তখন সেই গায়কের এক দূরসম্পর্কের বোন একজন অভিজাত মহিলার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল তাকে। বলল: ‘This is Georgette Cilke, who chairs the campaign against the death penalty।’ তখন সেই মহিলা, Georgette, উক্ত গায়ককে খুব প্রশংসা করে বললেন: ‘you remind me of a young Frank Sinatra।’ Frank Sinatra একজন হলিউডের নামকরা গায়ক। গায়কটি উৎফুল্ল হয়ে উঠল। বলল: ‘Thank you! He is my hero. I know his entire catalogue of songs by heart।’ Georgette বললেন: ‘I like his music, but I don’t like the way he treats people।’ তখন একটু থেমে গায়কটি উত্তরে বলল: ‘yes, but we must separate the artist from the man।’
এই ‘artist’ থেকে ‘man’-কে separate করাটা শিখতে আমাকে ষাট বছর বয়স পর্যন্ত পৌঁছোতে হয়েছে। পিকাসোর জীবনের ওপরে একটি ফিল্ম দেখেছিলাম যেখানে অ্যান্টোনি হপকিনস্‌ পিকাসোর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ফিল্মে দেখা যায়, বিরাট একটি হলঘরে উঁচু বাঁশের মাচা বানিয়ে সেই মাচায় দাঁড়িয়ে প্রশস্ত একটি ক্যানভাসে ছবি আঁকছেন পিকাসো। বাঁশের তৈরি একটি ছোটো মই লাগানো রয়েছে মাচাটিতে উঠবার জন্যে। মাচার একধারে ছোটো চেয়ার। চিত্রকর মাঝেমাঝে বিশ্রাম নেবেন। সেই হলঘরের মেঝেতে তখন দুই নারী কলহে আবদ্ধ। একজন পিকাসোর প্রাক্তন প্রেমিকা। অন্যজন সাম্প্রতিক প্রণয়িনী। এবার দুজন নারী হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়লেন।
পিকাসো কী করলেন? ফিল্মে দেখা যায়, উঁচু থেকে পিকাসোরূপী অ্যান্টোনি হপকিনস্‌ একবার মাত্র ঘাড় ঘুরিয়ে দুই মহিলার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন নীচে। পরক্ষণে নির্বিকারভাবে আবার ছবি আঁকায় নিমগ্ন হলেন। we must separate the artist from the man।

অভিরূপ:  সম্প্রতি একটি লেখায় আপনি বিলায়েত খাঁ-র সংগীত সম্পর্কে বলা: ‘রিয়াজ রিয়াজ রিয়াজ, সাধ্‌না সাধ্‌না সাধ্‌না’—কথাটির উল্লেখ করেছিলেন। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে ‘রিয়াজ’ বা ‘সাধ্‌না’ আসলে কী?

জয়:  মনের অনুশীলন করে যাওয়া। আমি অন্য কোনো কবি বা কবিদের সম্পর্কে প্রতিযোগিতা বোধ করছি কি? করলে কেন করছি? এসব থেকে তো মনকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখা দরকার। আমার শুধু একটাই কাজ, নিজেকে নিজের অবচেতনের মধ্যে ঠেলে দেওয়া। আমার যে-অবচেতন তাকে তো আমি দেখতে পাচ্ছি না। ফলে, একটা অন্ধকার অনিশ্চয়তার মধ্যে নিজেকে ছেড়ে দিতে হবে, যেখান থেকে আমার অবচেতনের উদ্ভাসন ঘটবে, শব্দের মধ্যে দিয়ে। এরজন্যে মনকে পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার। আমি যে-কবিতা লিখছি তা কোথা থেকে আসছে তা তো আমি বুঝতে পারছি না, তা তো আমাকে না-জানিয়ে আসছে। যে আমাকে না-জানিয়ে আসছে তার জন্য আমি যেন প্রস্তুত থাকতে পারি। তাকে যেন গ্রহণ করতে পারি আমার সীমাবদ্ধ শব্দের ভাণ্ডার দিয়ে। এই-ই আমার রিয়াজ, আমার সাধনা এই।
 

 অভিরূপ:  কোনো কিছুকে ভয় হয় আপনার?

জয়:  হ্যাঁ, আমার অনেকগুলি ভয় আছে। আমার প্রথম ভয় হল শারীরিক-যন্ত্রণার ভয়। 
আমার দ্বিতীয় ভয়টি হল, আমার যারা প্রিয়জন তাদের যেন কোনো গুরুতর অসুস্থতা গ্রাস না করে। তারা যেন সুস্থ থাকে। আমি একবার এক জায়গা থেকে ফিরছি বুকুনের ফোন এল: ‘মা-কে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।’ কাবেরীকে ২০১৫ সাল থেকে পরপর তিনবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। 
আমার তৃতীয় ভয় হচ্ছে আর্থিক অনটনের ভয়। আমি একসময় প্রবল দারিদ্রের মুখোমুখি হয়েছি। অনাহারেও থেকেছি। এরকম জীবনও আমার গেছে ১৯৮৪-’৮৫ সালে। আর্থিক যে-অনিশ্চয়তা তা আজও আমার পিছু ছাড়েনি।
আমার পরবর্তী ভয়, অসম্মানের ভয়। কেউ আমাকে অপমান করবে না তো! এই ভয়ে আমি সবসময়ে আতঙ্কিত হয়ে থাকি। আর, আমার যা শেষ ভয় তার সঙ্গে আমার প্রথম ভয়টির মিল আছে। সেই ভয় হল মৃত্যু-যন্ত্রণার ভয়। আমি দৈবের কাছে প্রার্থনা করি আমার মৃত্যু-যন্ত্রণা যেন দীর্ঘ না হয়। 

অভিরূপ: আপনি কি দৈবে বিশ্বাস করেন?

জয়: আমার পুরো জীবন এবং লেখালিখি দৈব-নির্ধারিত বলে আমার বিশ্বাস।

অভিরূপ: তাহলে কি আপনি পুরুষকারে বিশ্বাস করেন না?

জয়:  হ্যাঁ নিশ্চয়ই করি। যাঁর শক্তি আছে তিনি নিজ পুরুষকার দ্বারা চালিত হন। আমার শক্তি নেই তাই আমি দৈব-নির্ভর।

অভিরূপ:  আপনার দেখা পুরুষকার-সম্পন্ন কোনো মানুষের একটি দৃষ্টান্ত দেবেন?

জয়:  হ্যাঁ। তেমন কোনো কোনো মানুষ নিশ্চয়ই দেখেছি যাঁদের জীবন তাঁরা পুরুষকার দ্বারা চালনা করেছেন। যেমন, মহাশ্বেতা দেবী।

[জয় গোস্বামীর এই সাক্ষাৎকারটি পূর্বপ্রকাশিত, দৈনিক 'আজকাল' পত্রিকায় ৭ মার্চ, ২০২১ সালে এটি প্রকাশিত হয়। লেখকের সম্মতিতে সাক্ষাৎকারটি দোঁহায় পুনঃপ্রকাশিত হল।]


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন