ময়ূরীকা মুখোপাধ্যায়
“আমি যদি লিখিতে পারতাম, কবি হইতাম, চিত্রকর হইতাম, হয়তো এইগুলা হইতে জারাইয়া লইয়া বাড়িতে পারিতাম। কিন্তু আমি যে ছবি তুলি। আমার মত আর কেহ হারায় নাই। যাহা দেখিতেছি, তাহা দেখাইতে পারিতেছি না।"
কিভাবে ঠিক শুরু করা উচিত, জানি না। এ লেখা প্রথমেই যখন হাতে এসেছিল শুরুতেই খুব উত্তেজিত এবং উদগ্রীব হয়েছিলাম। পূর্বে এই ধরণের লেখা লেখার খুবই সামান্যতম অভিজ্ঞতাকে হাতিয়ার করে ভেবেছিলাম, ঠিক সবটা গুছিয়ে নিতে পারবো। ভেবেছিলাম, প্রস্তুতি পর্বে অনুচ্ছেদের আদলে মাথার মধ্যে ছক কেটে হয়তো কিছু প্রকোষ্ঠ তৈরী হয়ে যাবে। খাতায় লেখা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু যে মানুষকে নিয়ে আজ লিখতে বসা, তাঁর ক্ষেত্রে বোধহয় কোনও ছক, কোনও নিয়মই চলে না। স্বঘোষিত ভাবে তিনি ব্যতিক্রমী না হলেও তিনি পৃথক। সে ভাবে কোনও তত্ত্ব বা তথ্য কোনও কিছুই বোধহয় তাঁকে বিশ্লেষণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁকে শুধুই, বাড়ি থেকে পালিয়ে তিতাসের পাড়ে বসে মেঘে ঢাকা তারা'দের দিকে তাকিয়ে অনুভব করে যেতে হয়। তাতেই তাঁর সার্থকতা।
পাঠকর বোধহয় আর বুঝতে অসুবিধে নেই আজকের মানুষটির সম্পর্কে। আর চারটে নভেম্বর পেরলেই যিনি পৌঁছে যাবেন শতবর্ষের দোরগোড়ায়। ১৯২৫এ অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার মিঁয়াপাড়ায় শুরু হয়েছিল এক রূপকথার। যে রূপকথার নাম ঋত্বিক ঘটক। ‘রূপকথা’ শব্দের ব্যবহার কিছুটা অতিরঞ্জিত লাগতে পারে, কিন্ত স্বয়ং মানুষটির কাছে, তাঁর শৈশব রূপকথার চেয়ে কিছু কম ছিল না। আর সেই কারণেই হয়তো বা জীবন-এর প্রতিটা মুহূর্তে বার বার ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর বেড়ে ওঠা।
ঋত্বিক ঘটক আর দেশভাগ... প্রকৃতপক্ষেই, মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। অন্যরকম ভাবে কিছু করার নেশায়, ভেবেছিলাম দেশভাগ ছাড়া আরও অন্য কিছুকে আতস কাঁচের তলায় ফেলে দেখব। কিন্তু এ বড় কঠিন কাজ। সতেরো বছরের যে কিশোরকে নিজের মাটি থেকে আলাদা হতে হয়েছিল, ছিন্নমূলের সেই চিড় খাওয়ার দাগ আসলে সে বয়ে বেড়িয়েছিল সারাটা জীবন। অবশ্য বয়ে বেড়ানো শব্দটির প্রয়োগ এখানে উচিত নয়। বরং বলা ভালো তিনি সেই অভিজ্ঞতাকে যাপন করেছিলেন, সারাজীবন।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা নিয়ে কাটা ছেঁড়া করবার কোনও ধৃষ্টতা আমার নেই। এবং তার থেকেও বড় কথা, তাঁর সিনেমা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য, একবার দেখাই যথেষ্ট নয়। যে বিশাল কর্মকাণ্ড মিলেমিশে প্রকৃত অর্থে সিনেমা হয়ে ওঠে, তার সব কটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ধরতে গেলে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানসিক অবস্থায় সেগুলোকে দেখার প্রয়োজন। বিশেষত তাঁর সিনেমা, যেখানে অনেক সময়েই 'ফিল্মি' ব্যাকরণ ভেঙে নতুন ব্যাকরণ তৈরী হয়েছে। তাঁর জন্মদিন পরবর্তী সময়ে লিখিত এই প্রবন্ধে তাই জীবন এবং সিনেমা সংক্রান্ত তাঁর যাপনকেই চেষ্টা করবো আলোচনার মাধ্যমে তুলে করার। আশা করা যায় এর মাধ্যমেই উদযাপিত হবেন মানুষ ঋত্বিক ঘটক।
আমার প্রস্তুতি পর্বে ঋত্বিককে জানতে জানতে একখানা প্রচলিত প্রবাদ এর কথা বড় মনে হচ্ছিল সোনা পুড়লে তবেই নাকি খাঁটি হয়। একথা অবিশ্যি আঠেরো উনিশ বছরে প্রথম ছ্যাঁকা খেয়ে প্রথম প্রথম কবিতা লেখার সময় বিশ্বাস করতাম বটে, কিন্তু পরে মনে হয়েছিল সবটাই আসলে অভ্যাস, অনুশীলন, চর্চা। তবে ইদানীং সময়ে এসে মনে হল, আসলে সবটাই যাপন।
একথা মোটামুটি সকলেরই জানা ঋত্বিক ঘটকের জীবনকালের প্রায় পুরো সময়টাই বিভিন্ন রকমের ওঠা পড়ার মধ্যে দিয়ে গেছেন। 'প্রাইম টাইম' সে অর্থে নেই। আর, জীবনের এই তাপ উত্তাপগুলোকে নিজের মধ্যে ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গে যাপনও করেছেন অনেকখানি। আর এই একটি জিনিসই মনে হয় তাঁর সমসাময়িক অনেকের থেকেই তাঁকে অনেক বেশী আলাদা করে রেখেছে।
সম্প্রতি গোদার সম্পর্কিত একটি লেখা পড়তে পড়তে একটি জিনিস অনুভব করলাম। যাঁরা সত্যিকারেরই শিল্পী হন, তাঁদের নিজস্ব, একেবারে একান্ত নিজের কিছু অনুভূতি খুব সুন্দর ভাবে তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে মিলেমিশে যায়। নারকেল নাড়ুর মধ্যে থেকে যেমন ভাবে গুড়কে আলাদা করা যায় না, অনেকটা সেইরকম।
আর খুব কম স্রষ্টার সৃষ্টিই সেরকম হতে পারে। এবং ঋত্বিক ঘটক নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর জীবন, যাপন, মনন এই সবকিছুই নিঃশব্দে ঠাঁই করে নিয়েছে তাঁরই সৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজে। সেই উপস্থিতি হয়তো প্রকট, অথচ সূক্ষ্ম। এবং তাঁর থেকেও বড় কথা, সেই সমস্ত সৃষ্টি কখনই তাঁর ব্যক্তিগত শোকের উদযাপন বলে মনে হয় না। আপামর দর্শকের একাত্ম হওয়ার সবরকমের উপাদান সেখানে বিদ্যমান।
মানুষের কাছে পৌঁছনোর, দর্শকমনে ঠাঁই করে নেবার তাগিদ সবসময়ই অনুভব করতেন তিনি। সেই তাগিদ থেকেই শিল্পমাধ্যমে বদল ঘটিয়ে থিয়েটারের কালো পর্দা ছাপিয়ে এক ছুটে চলে গেছেন ক্যামেরার ঠিক পেছনটায়। অবশ্য ক্যামেরার সামনেও তাঁর ভূমিকা কম কিছু নয়।
১৯৫৩ থেকে ১৯৭৪ এই দীর্ঘ একুশ বছরে নির্মিত ছবির সংখ্যা সাত। এই দীর্ঘ সময়ের অসংখ্য ঘাত প্রতিঘাত সত্ত্বেও, স্রোতের উল্টো পথে হেঁটে যাওয়াটা প্রায় একরকমের অভ্যাসেই পরিণত করে ফেলেছিলেন তিনি। ছন্নছাড়া, খামখেয়ালি হয়েও, চেয়েছিলেন গুছিয়ে নিতে। খুঁজেছিলেন শক্তপোক্ত অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। সেই সুবাদেই আরব সাগর পাড়ি দিয়ে বোম্বে এবং ফিল্মিস্থানের কর্মজীবন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা মোটামুটি ভাবে তাঁর মজ্জাগত ছিল। তাই পথ অনুসন্ধান করলেও সে পথে চলা হয়নি। ফলস্বরূপ বিভিন্ন সময়ে, স্টুডিওর টেকনিশিয়ানদের ন্যায্য বেতনের দাবিতে গলা তুলতে দেখা গেছে তাঁকে। শক্তিশালী হয়েছে তাঁর কলম।
ফিরে আসতে হয়েছে, তবুও তাঁর ফেরা হয়নি। ফেরা হয়নি পদ্মাপাড়ের ছেলেবেলার কাছে।
নিজের শেকড় নিয়ে এত যত্নবান ছিলেন বলেই বোধহয়, তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র বিদেশী প্রভাব মুক্ত। তাই তাঁর সিনেমায় ফ্রেম থেকে ফ্রেমে বিরাজ করে শুধুই মাটির কথা, মানুষের কথা, জীবনের কথা, সংগ্রাম এর কথা।
ক্যামেরার বিজ্ঞান, শট ডিভিশনের প্রযুক্তি, ছবি তৈরীর অ-আ-ক-খ এই সবকিছুকে ছাপিয়ে ঋত্বিক ঘটকের যেটা সবচেয়ে বেশী করে উঠে এসেছে তা হল তাঁর এক অসম্ভব সংবেদনশীল মন। মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি তাঁর সেই সংবেদনশীল মনের বিচরণ সর্বত্র। ঋত্বিক ঘটককে জানতে চাইলে আসলে তাঁর মনকে প্রত্যক্ষ করতে হয়।
ঋত্বিক ঘটক তাঁর সমসাময়িক কালের বিস্তারে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে না পারলেও, তাঁর নির্মাণ শৈলী তাঁকে বেশীদিন শুধুমাত্র এই বাংলাদেশের গন্ডিটুকুর মধ্যে আটকে রাখেনি।
ঋত্বিক ঘটক আসলে এক চর্চার নাম। যাঁকে রীতিমতো অনুশীলন করতে হয়, যে ভাবায়, যে অনুভব করায়। এত কিছুর পরেও যে অনায়াসে বলতে পারে "সিনেমার প্রেমে আমি পড়িনি", তাই তো তিনি শাশ্বত, চিরকালীন। বাঙালি মনন তাঁর বিস্তারে হয়তো কিছুটা দিকভ্রান্ত হয় ঠিকই, কিন্তু কালক্রমে সেই বিস্তার থেকেই শাখা প্রশাখার মতোই ছড়িয়ে পড়বে হরেক রকমের পথ। অবশেষে যে পথেই হবে আমাদের সম্বল, সেই পথেই হবে আমাদের সমৃদ্ধি।
“ভাবো ভাবো ভাবা প্র্যাকটিস করো”–র চারচৌকো ফ্রেমের সীমানাটুকু টপকে, ঋত্বিক আমাদের মননে উদযাপিত হোন। মিলে মিশে থাকুন আমাদের চিন্তনে, আমাদের মেধায়, আমাদের দর্শনে… এতেই তাঁর সার্থকতা…