দোঁহা

স্বজন বিয়োগ



সায়নী ভট্টাচার্য

বড় রাস্তার ওপর থেকেই গোটা-দশেক সিঁড়ি সোজা নেমে গেছে জলের গভীরে। শেষ ধাপটায়, যেখানে ছোট ছোট ঢেউ এসে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে, ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা জলে পায়ের পাতা দুখানি ডুবিয়ে একলা বসে আছে রাকা। গায়ে ফিনফিনে সিল্কের কামিজের ওপর পশমিনা কাজের কালো শাল। কনকনে উত্তরের হাওয়ায় শাল উড়ছে পতপত। রাস্তা থেকে হ্যালোজেনের হলুদ আলো তেরছা হয়ে পড়েছে পিঠময়, ঘাড়ের কাছে ছোট করে কাটা চুলে। সেই আলোয় স্পষ্ট দেখা যায়, শীর্ণকায় শরীরটা যেন তিরতির করে কেঁপে উঠল বার-দুয়েক। দু-হাতে নিজেকে জড়িয়েছে রাকা- যেমন করে মানুষ জড়ায় মানুষকে স্নেহের দৃঢ় আলিঙ্গনে, কিংবা উষ্ণতার খোঁজে। কোলের ওপর ফোনটা নিঃশব্দে বেজে বেজে থেমে যায়- এই নিয়ে তিন বার। বাজুক। আজ রাতে সে নিয়ম-নিষেধের পরোয়া করে না। আজ রাতে, এই মুহূর্তটুকুতে শুধু নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি চায় রাকা। কাছের মানুষের উদ্বিগ্ন গলার স্বর নয়, অধিকার বোধের জোরজুলুমও নয়। শুধু শান্তি। অন্ধকারের মধ্যে, নৈশব্দের গভীরে যে শান্তি মিশে থাকে…

ঘড়িতে এগারোটা বেজে দশ। তার ওপর শীতের রাত। বাগবাজারের গঙ্গার ঘাট জনহীন। বড় রাস্তার ওপর দিয়ে মাঝে-সাঝে হুস করে বেড়িয়ে যাওয়া দু-একটা গাড়ির যান্ত্রিক শব্দটুকু বাদ দিলে দূর থেকে হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসা মানুষের টুকরো টুকরো কথা কখনো, কখনো ট্রেনের চাকার ঝমঝম। ঝোপঝাড়ে হাওয়া খেলে শনশন শব্দ হয়, নদীর জল পাড়ে এসে ছলাৎ করে। এই শব্দগুলো গানের কথার পেছনে সুরের মতো। শান্তির বিঘ্ন ঘটায় না। বরং এদের ক্রমাগত অস্তিত্বে এরা নৈশব্দেরই আত্মজ হয়ে ওঠে, পূর্ণতা দেয়। 

বছর দশেক আগে এক পড়ন্ত বিকেলে জিয়া-ভারেলির পাড়ে এমনই একলা বসেছিল রাকা। সে নদী তখনও তার যৌবনে। পাহাড়ি উদ্দামতায় বিশাল-বিশাল পাথরে শত-বিভক্ত হয়েও তার গতি হারায়নি। জিয়া-ভারেলির পাড়ের পাথুরে জমিতে বসে নদীর জলে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে সেদিন যেন জীবন দর্শন হয়েছিল রাকার। মনে হয়েছিল, জীবনের পথচলা হুবহু নদীর গতিপথের মতো। তাতে ওঠাপড়া আছে, বাধা সংকীর্ণ পথ পেরোনো আছে, দ্বিধা-বিভক্ত হওয়া আছে, আবার অজস্র শাখা-প্রশাখার মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়াও আছে। নেই শুধু থেমে যাওয়া। তবে সে গেল নদীর যৌবনের কথা। কলকাতার গঙ্গায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছে তার বার্ধক্য। নদী তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। প্রস্থে বেড়েছে যতখানি, ততখানিই স্তিমিত হয়েছে গতি। যেন জীবন-সায়াহ্নে উদ্দেশ্যহীন বার্ধক্য। অন্ধকার নদীর বুকে মায়ের বৃদ্ধ মুখ দেখে রাকা। যেমনটা মা কে দেখাচ্ছিল আজ সকালে- অপরিচিত, দূরবর্তী, ক্ষীণ। 
বাবার সকালের চা, পাশে টেবিলে দু-ভাঁজ করা আনকোরা ইংরেজি খবরের কাগজ, গরম গরম প্রাতরাশ, অফিসের টিফিন, হাতের কাছে ইস্ত্রি করা প্যান্টশার্ট, রুমাল, বাবার অফিস বেরোনোর আগে দরজার গোড়ায় রাখা পালিশ করা জুতোজোড়া- এরাই সুদীর্ঘ সময় জুড়ে মায়ের জীবনের এক ঘেয়েমি সকালগুলোয় নিজেদের অধিকার কায়েম করে ছিল। নিজের বলতে যে সংসারকে আঁকড়ে ধরেছিল মা, অকস্মাৎ বিনা নোটিশে সেই সংসার ছুটি দিয়েছে আজ মা কে। এখন অন্তহীন সময় হাতে। একেবারে নিজের জন্য।

ছোটবেলায় রাকার গানের স্কুলে একবার হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়েছিল মা, আজও মনে আছে রাকার। সেদিন ক্ষণিকের প্রশ্রয়ে চোরা স্রোতের মতো আগল ভাঙা স্বপ্ন মায়ের মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছিল-‘পিয়ানো, একটিবার পিয়ানো শেখার খুব ইচ্ছে হয়।’ আজ বছর পঁচিশ পর, মায়ের অখণ্ড অবসরের শব্দহীনতা যখন কানে বেজেছিল রাকার, বসার ঘরের বিস্তৃত শূন্যতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয় জাঁকিয়ে বসেছিল, মনে হয়েছিল বুঝি ঘরের মাঝ বরাবর একটা প্রকাণ্ড পিয়ানো থাকলে আর হারানোর ভয় থাকবে না। অথচ আজ পিয়ানোর কথা পাড়তেই এমন অবাক চোখে মা রাকার দিকে তাকিয়েছিল যেন বাবার পদোন্নতি, রাকার ভবিষ্যত চিন্তার বাইরে এমন কোন ইচ্ছের কথা মায়ের মনেই পড়ে না। বাবার কথায় নিজের পছন্দের কালো রঙের পোশাক বর্জন করেছিল মা একদিন। আজ আলমারি খুলে সহস্তে নিজের পছন্দের গাঢ় রঙের শাড়িগুলো আত্মীয়াদের মধ্যে নির্দ্বিধায় বিলিয়ে দিতে দেখে অবাক হয়েছিল রাকা। বাধা দিতে গিয়েও নিবৃত্ত করেছিল নিজেকে। স্ব-ইচ্ছার পরিহার-এই কি সম্পর্কের দাবি? তাই কি মা গান গায় নি আর কোনদিন? তাই কি বাবার চলে যাওয়ার সাথে ফুরিয়েছে মায়ের জীবনের সকল উদ্দেশ্য? সে জীবন যেন তার সমস্ত গতি হারিয়ে নিস্পলক দেখছে তার স্বপ্নের হারিয়ে যাওয়া। যেমন দোতলার ঝুল বারান্দা থেকে রাকার মা দেখছিল চুপচাপ-সবল স্বজনের কাঁধে চেপে স্বামীর নিষ্প্রাণ শরীরের ম্যাটাডোরে ওঠা, তারপর সস্তা ধুপের জোরালো গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে বাজারের ভিড় ঠেলে, পথচলতি মানুষের হেনস্থা করে বড় রাস্তায় গাড়ির ভিড়ে মিলিয়ে যাওয়া। 
দূরাভাষেই বাবার চলে যাওয়ার খবর পেয়েছিল রাকা। স্কুল বাস তখন লেক-টাউনের মনসা মন্দির ছাড়িয়ে অল্পই এগিয়েছে। হাতে ঘড়ি ছিল না ঠিকই, তবে দীর্ঘদিন একই রাস্তায় সময় মেপে ছোটার অভ্যেস বলে দিয়েছিল, সকাল ন’টা বেজে দশ। ফোনের পর্দায় ছোড়দার নম্বর দেখে ধনুকের মতো ভুরুযুগল অপেক্ষাকৃত ঘন হয়ে এসেছিল রাকার। বিজয়া দশমী, ভাইফোঁটা, রাখি কিংবা জন্মদিন ছাড়া যে নম্বর কল লিস্টের নিচে হারিয়ে যায়, যেন সরীসৃপের শীতঘুম, সেই নম্বর থেকে কাজের দিন সাতসকালে ফোন পেয়ে বিস্ময়ের থেকেও ভয় হয়েছিল বেশি। তবে কি…

কি তা ভাবতে ভাবতেই খবরটা জানা হয়ে গিয়েছিল রাকার। সংক্ষিপ্ত, সহসা, আচম্বিত-যেন রোদ্দুর আকাশে ঝমঝম বৃষ্টি। মুখ থেকে একটা শব্দও বের হয়নি রাকার। এক মুহূর্তের জন্যও শ্বাস দ্রুত হয়নি। চোখ দিয়ে জল হয়ে গড়িয়ে পড়েনি কান্নাও। শুধু অপলক দৃষ্টিতে পথচলতি মানুষ, গাড়ি, সাইকেল, রিক্সা ভেদ করে শূন্য দেখতে দেখতে গলার কাছে এসে আটকে যাওয়া একদলা শূন্যতাকে ঢোঁক গিলে শরীরের ভেতর চালান করেছিল। আজ আর স্কুল যাওয়া হয়নি। বাড়ি ফিরে এসেছিল রাকা। ফুল-মালা, ধুপ-ধুনো, অবিরাম ফোনালাপের কর্তব্যে আপাদমস্তক জড়িয়ে ফেলেছিল নিজেকে। তবে সব কিছুর মাঝেও অনুভব করেছিল সেই সদ্য পরিচিত শূন্যতা শরীরের ভেতর যা নানান অঙ্গে প্রতিফলিত হয়ে, বেরনোর পথ না পেয়ে ক্রমশই ফুলে ফেঁপে উঠেছিল।  

এখন চোখ বুজে বাবার মুখটা ভাবে রাকা। সকালের নিদ্রামগ্ন মুখটা না, চনমনে, উৎফুল্ল, সহাস্য মুখ। পরীক্ষায় ফুল-মার্কস আনলেই বাবার অট্টহাস্য। অফিস ফেরতা বই-পাড়া থেকে আনা সারপ্রাইজ গিফট। জন্মদিনে ধর্মতলা চষে কেনা পুতুলের একপাটি চটি। সমস্ত বিপদে আগলে দাঁড়ানো বাবা। বন্ধ চোখে বিশ্বাস করা যায় যাকে, সেই বাবা। জ্বর হলে মায়ের ওপর দেখাশোনার সব ভার চাপিয়ে দরজার আড়াল থেকে চোখের জল ফেলা বাবা। নিজের যন্ত্রণা লুকিয়ে রাকার মুখে হাসি ফোটানো বাবা। আমিনার গফুর মিয়াঁ। 

সেই বাবার শায়িত শরীরটার পাশে আত্মীয়-অনাত্মীয়ের কান্নার শব্দটা মৃদু গুঞ্জনের মতো এখনও কানে লেগে আছে রাকার। কারা কষ্ট পেল বেশি? যারা সুর তুলে কাঁদল, মায়ের মাথায় পিঠে হাত বোলাল, তারপর বিকেল হতে যে যার মতো ফিরে গেল নিজ নিজ জীবনে? আর যারা কাঁদতে পারল না?

আজ বাবাকে কত নতুন নতুন পরিচয়ে চিনল রাকা। বাবার সহকর্মীরা বলল, বাবা নাকি ভারী কাজ-পাগল। ছাত্র-ছাত্রীরা বলল, স্যার বড্ড কড়া। সন্ধের মুখে একলা বাড়িতে মা কে আলমারি ঝেড়ে পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে দেখে মায়ের পাশে গিয়ে নিঃশব্দে বসেছিল রাকা। মায়ের সাথে যে বাবাকে কোনদিন আবশ্যক সাংসারিক কথাবার্তার বাইরে আলাপচারিতায় মত্ত হতে দেখেনি রাকা, সেই বাবার হাতের লেখায় প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে মায়ের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে চিরকালের মেঘমালাকে ‘আমার প্রিয়তমা মেঘু…’ হতে দেখল। মানুষের চলে যাওয়া বড় নির্মম। মুহূর্তে তার আজন্মকাল ধরে বিন্দু বিন্দু করে গড়ে তোলা গোপনীয়তার সিন্ধুতে ভাটা হয়ে নেমে আসে। মুখের আড়ালে লুকোনো আরও মুখগুলো একত্রিত স্মৃতিচারণে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। অবাক করে। যন্ত্রণা দেয়। এমনকি সন্দিগ্ধ করে তোলে- যাকে চিনতাম, তাকে সত্যিই চিনতাম কি?

রাকা কি পেরেছে চিনতে? বাবাকে কিংবা অবনীকে? অগ্নিশপথ করে যে পাশে থাকতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল, আজ সে কোথায়? এয়ারপোর্টে? চেক-ইন শেষ তার? সকাল থেকে অবনীকে বাবার চলে যাওয়ার খবরটা দেওয়া হয়নি রাকার। রোজকার মতো স্কুল বাসে উঠে মেসেজ লিখেছিল, ‘তোমার ব্রেকফাস্ট টেবিলে রাখা। অফিসের টিফিন মাইক্রো-ওভেনে। ঘুম থেকে উঠে গরম করে নিতে ভুলো না। দিল্লিতে এ সময়টায় ঠাণ্ডা বেশি। তোমার ট্রলিতে নতুন পুলওভারটা রেখেছি। তাড়াতাড়ি ফিরব।’

ফোনটা ব্যাগে রেখে মুচকি হেসেছিল রাকা। ভালবাসা কি শুধুই অভ্যেস! বছর খানেক আগে অব্দিও অবনীর থেকে দূরত্বে বুক কাঁপত রাকার। অভ্যেসের গর্ভে বুঝি ঔদাসীন্যের জন্ম হয়। রাকার আজ তাড়াতাড়ি ফেরা হয়নি। স্কুল থেকে ফেরার সময়টা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ- যেন অনেকগুলো মুহূর্ত, অনেকগুলো বছর। যেন ক্রমবর্ধমান উদাসীন সেই মুহূর্ত জুড়ে পাঁচিল তুলেছে কেউ। তা না হলে, এখনও ভাবে রাকা, হয়তো অবনী একবার জানতে চাইত রাকার কথা।

‘তোমার দেরি হবে হয়তো। দরজার পাশে ফুলের টবে চাবি রইল,’ বলে বেরিয়ে পড়ত না। স্বজন বিয়োগ…

চমকে ওঠে রাকা। পাশে এসে বসেছে কেউ। মুখ ফিরিয়ে দেখে রাকা। চিন্ময়। অবনীর ড্রাইভার। রাকার ফোন পেয়ে আজ বিকেলেই গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিল রাকার বাপের বাড়িতে। গাড়ির সামনে বসে চিন্ময়, ড্রাইভিং সীটে। রাকা পেছনে। নিজেদের চারদিকে আঁকা গণ্ডির মধ্যেই থাকে ওরা। সমাজ ওদের কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তাই নৈশব্দের অজানা ভাষায় কথা বলে দু’জন। অবনীকে আজ যা যা বলা হয়নি রাকার- সবকিছু। একটা হাত ধরে আরেকটা। শরীরের কোষে কোষে জমে থাকা কষ্টগুলো হঠাৎ তীক্ষ্ণ ফলায় ক্ষত-বিক্ষত করে তুলছে রাকার সমস্ত আবরণ। ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন সেই সব ফাঁকফোকর দিয়ে কনকনে উত্তরের হাওয়ার মতই হু-হু করে বেরিয়ে পড়ছে। আজ সারাদিনে প্রথমবার কাঁদবে রাকা। শক্ত হাতে চিন্ময়ের হাত ধরে। চোখের জলেরও হয়তো বা কাঁধ চাই, যন্ত্রনার চাই আশ্রয়। একটা কাঁধ, একটা আশ্রয়-এর থেকে বেশি ভালবাসা কবে কি চেয়েছে? 
মানুষের চলে যাওয়া সত্যিই বড় নির্মম। মুহূর্তে তার আজন্মকাল ধরে বিন্দু বিন্দু করে গড়ে তোলা গোপনীয়তার সিন্ধুতে ভাটা হয়ে নেমে আসে। অস্বীকৃতকে অনাড়ম্বরে স্বীকৃতি দেয়। অবাক করে- যাকে চিনি, তাকে সত্যিই চিনি কি?

আকাশে প্লেন উড়েছে অবনীর। কানের হেড-ফোনে গান, চোখে তার আকাশময় তারা। নিচে নদীর পাড়ে দু’জোড়া কান্নাভেজা চোখ-ব্যথিত আর সমব্যথী। তাদের শুভদৃষ্টি হয় না কোনদিন। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানের লাল-সবুজ আলো দেখে তারা পাশাপাশি, একত্রে। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন