দোঁহা

হুসেনি ব্রাহ্মণ, কারবালা ও পরবর্তী


অভিষেক চট্টোপাধ্যায়

বৃদ্ধ আব্বুজি, আসল নামটা ঢাকা পড়ে গিয়েছে পরিচিতদের অনন্ত ভালোবাসায়।সৈয়দ আব্দুল্লাহ রিজভী, পেশায় অমৃতসরের শতাব্দী প্রাচীন ইমামবারার তত্বাবধানের কাজে নিযুক্ত বৃদ্ধ আব্বুজির ঘোলাটে দু'চোখ আজও খুঁজে ফেরে সেই চিহ্ন!বৃদ্ধ চোখের চালশের আড়াল ঠেলে গলার কাছে থাকা দাগটা খুঁজে ফেরার মধ্যে রয়েছে এক ঐতিহ্যর সন্ধান। যে ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। যে ঐতিহ্য কথা বলে যায় উপমহাদেশের এক মহান আত্মত্যাগের কাহিনি, লোকগাথার পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া যে ঘটনা জন্ম দিয়েছিল ধর্মীয় সমন্বয়ের এক মহান ইতিহাসের, কালের নিয়মে আর রাজনীতির কারবারিদের অঙ্গুলিহেলনে যে ঐতিহ্য আজ শুধু ক্ষয়িষ্ণুই নয়, রীতিমতো বিপন্ন। যে ঐতিহ্য হতে পারতো আজকের ধর্মীয় হানাহানি, বিভেদের সময় সমন্বয়ের উদাহরণ, সেই পরিচয়ই হয়ে দাঁড়াল কিছু মানুষের ভিটে ছাড়া হওয়ার কারণ। আশ্চর্য হলেও, এটাই সত্যি মহান আদর্শের ধারক এই মানুষগুলোর জন্য বিভাজনের রেখার দু'পাশের কোনো ভুখন্ডই এনে দিতে পারেনি নিশ্চিন্ত আশ্রয়। বরং সেই ঐতিহ্য আর পরিচয় লুকিয়ে কোনোক্রমে টিঁকে আছে, আজকের হুসেনি ব্রাহ্মণরা।
হুসেনি ব্রাহ্মণ...হিন্দুস্তান আর পাকিস্তানের সীমান্তের বিভাজন , র্্যাডক্লিফ রেখার সুক্ষ অন্তরায় আজ তাদের নিজস্ব ভূমি থেকে তাদের বিতাড়িত করলেও কোনোভাবেই ইতিহাস তাদের থেকে কেড়ে নিতে পারবে না মহান আত্মত্যাগের গরিমা যা আজও ভেসে থাকে আজমিরের হুসেনি ব্রাহ্মণ বা শিয়া ব্রাহ্মণদের তাজিয়ায়...“বাহ্ দত্ত সুলতান, হিন্দু কা ধরম মুসলমান কা ইমান, আধা হিন্দু আধা মুসলমান। "
অর্ধেক হিন্দু অর্ধেক মুসলমান, আজকের হানাহানির যুগে দাঁড়িয়ে কতটা অসম্ভব তা বোধহয় বলে বোঝানোর অপেক্ষা রাখেনা, আর এখানেই বোধহয় সবথেকে আশ্চর্যের!শিয়া ব্রাহ্মণ!কী অদ্ভুত শব্দবন্ধ!ইতিহাস কিন্তু সেই সাক্ষ্যই দিয়ে চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
কারবালার  ধু-ধু মরু প্রান্তর।যুদ্ধক্ষেত্রে প্রস্তুত দুই যুযুধান বাহিনী।বিপক্ষে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকলেও একের সাথে অপরের শক্তির কোনো তুলনাই বোধহয় করা সম্ভব নয়।ঠিক যেমনটা সম্ভব ছিল না মহাভারতের যুদ্ধে। একদিকে ভীষ্ম পিতামহ, আচার্য দ্রোণের সাথে লক্ষ-লক্ষ কৌরব সেনানীর মিলিত আক্রমণ অন্যদিকে পান্ডবদের সামান্য লোকলস্কর, সেনাবাহিনী। এককথায় অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ঠিক একই রকম ভাবে কারবালা মরুপ্রান্তরে  শক্তিশালী ইয়াজিদের বিরুদ্ধে হুসেনের সেদিনকার যুদ্ধ নিঃসন্দেহে সেই অসম লড়াইয়েরই নামান্তর। যুদ্ধের ফলাফল জানা থাকা সত্ত্বেও এই যুদ্ধকে ন্যায় আর অন্যায়ের লড়াই বলেই মনে করেছিলেন কয়েকজন। আর স্বাভাবিকভাবেই তারা চেয়েছিলেন সেই যুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে যোগদান করতে। পরিণতি বোঝার মত অবুঝ, অদূরদর্শী তারা ছিলেননা,তাদের সেই চিন্তা ঠিক কী ভুল তা বলা সম্ভব নয়,কিন্তু আবেগ আর সত্যনিষ্ঠার প্রতি সততা প্রদর্শনকারী সেই সমস্ত মানুষেরা আজও বেঁচে আছেন লোককাহিনি আর সঙ্গীতের মাধ্যমে... রাহিব  সিধ দত্ত।ইতিহাসের এক প্রায় ভুলে যাওয়া চরিত্র, যার চরিত্রের দৃঢ়তা সেদিন নিয়ে এসেছিল সৌভ্রাতৃত্ত্বের সুদৃঢ় বন্ধন, ইতিহাসের অমোঘ গতিপথে আজ তার স্বজাতীয়রাই বঞ্চিত একটুকরো স্বাধীন,নিরাপদ বাসভূমির আশ্বাস থেকে।
 ঐতিহাসিকদের মতে কারবালার যুদ্ধের সময় ইরাকে সম্ভবত দু'জন ব্রাহ্মণ ছিলেন, যাদের একজন রাহিব দত্ত। রাহিব দত্ত বা মতান্তরে রাহব দত্ত সম্পর্কে আরও বেশ কিছু মতও অবশ্য পাওয়া যায়, যার একটি হল রাহব দত্ত সম্ভবত ব্যবসা সূত্রে ইরাকবাসী ছিলেন।অপর একটি মত বলে, সমসাময়িক ইরাকের কাছাকাছি  বর্তমান সিন্ধ প্রদেশের রাজা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত বলে এক ভারতীয়।আর সেই রাজার দরবারের কোনো বিশিষ্ট পদে আসীন ছিলেন রাহিব দত্ত। ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু প্রমাণ না পাওয়া গেলেও সিন্ধ প্রদেশে যে হিন্দু রাজত্ব বজায় ছিল তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। লোককাহিনির বিভিন্ন আঙ্গিক থাকে, সেখানে কাহিনির বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটার মধ্যে কোনো অস্বভাবিকতা থাকার কথা নয়। বহুক্ষেত্রেই সেই আচ্ছাদন সরালেই পাওয়া যায় প্রকৃত সত্যের সন্ধান। যে সত্য জানাতে পারে বিজ্ঞান, গবেষণা। নৃতাত্বিক গবেষক T. P. Russel Stracey প্রকৃত অর্থে প্রথমবার হুসেনি ব্রাহ্মণদের কোনো একসময় আরবে বসবাসের স্বপক্ষে জোর সওয়াল করেন।
 রাহিব দত্ত, ঠিক কে ছিলেন তা নিয়ে সংশয়ের কিছু অবকাশ থাকলেও, যা নিয়ে  হয়তো সন্দেহের  স্থান নেই তা হল কারবালার যুদ্ধে ইয়াজিদএর বিরুদ্ধে তার অস্ত্রধারনের ইতিহাস নিয়ে। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বীরসুলভ লড়াই পৌঁছে দিয়েছিলেন বিপক্ষ শিবিরে, হৃৎকম্প ধরাতে পেরেছিলেন কিনা জানা যায়না কিন্তু একে একে সাত পুত্রকে হারানোর পরেও পিছু হটেননি রাহিব। মরুভূমির তপ্ত বালু একে একে সাত পুত্রের কর্তিত মস্তক গ্রহণ করলেও একফোঁটা অশ্রুবিন্দু পড়েনি সেদিন যুদ্ধক্ষেত্রে। কারণ সত্যের পথে যে লড়াই সে লড়াই যে বহু বলিদান, আত্মত্যাগ দাবি করে তা অজানা ছিলনা এই ব্রাহ্মণ সন্তানের। আজও লোকসঙ্গীতে বেঁচে রয়েছে সেই যুদ্ধের স্মৃতি, আর রয়েছে আব্বুজির মত মানুষদের বিশ্বাসে, গলার কাছে আত্মত্যাগের সেই ক্ষতচিহ্ন নিয়ে আজও রয়েছেন হুসেনি ব্রাহ্মণ বা রাহিব দত্তের বংশজরা ...
 
 “লারিও দত্ত দাল খেত জি তিন লোক সাকা পারহিও
 চারহিও দত্ত দাল গহ জি গড় কুফা জা লুটিও।
 বাজে ভিড় কো চোট ফতেহ ময়দান জো পায়ী
 বদলা লিয়া হুসেন,ধন ধন করে লুকাই।
 রাহিব কী যো যাদ নসল হুসেন যো আয়ি
 দিয়ে সাত ফারজাদ ভাই কুবুল কামাই।
 যো হুসেন কী যাদ হ্যায় দত্ত নাম সব ধ্যায়ও
 আরব সহর কে বিচ মে রাহিব তখত বানায়ো।"
 
 লোক সঙ্গীতের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে রাহিব দত্তের বলিদান আর বীরত্বের কাহিনি, আর সেই সঙ্গে এক অসামান্য সম্মান প্রদর্শন তার হুসেনের পক্ষে যোগদানের জন্য। সেই একই সম্মান তিঁনি  লাভ করেছিলেন স্বয়ং হুসেনের কাছ থেকেও। সেই সঙ্গে পেয়েছিলেন সুলতান উপাধি। এছাড়াও এক মহামূল্যবান উপহার এই পবিত্র যুদ্ধে যোগদানের প্রতীক রূপে পেয়েছিলেন তিনি। কথিত যে,উপহার হিসেবে পাওয়া স্বয়ং হজরত মহম্মদের সেই পবিত্র কেশগুচ্ছ এসেছিল ভারতবর্ষের পুন্যভূমিতে,যা সুরক্ষিত রাখা হয়েছিল কাশ্মীরের পবিত্র হজরতবাল মসজিদে।
 যুদ্ধে হুসেন এবং তার সমস্ত পরিজনের মৃত্যু ঘটলেও লড়াই কিন্তু সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি।১০মহরম ৬১হিজরীতে সংঘটিত কারবালার যুদ্ধের পরেও হুসেনি ব্রাহ্মণরা সেই লড়াই চালিয়ে যান। ইমাম হুসেনের অনুগামী এই হুসেনি ব্রাহ্মণরা যুক্ত হন আমির আল মুখতারের নেতৃত্বে। সেখান থেকে তারা কুফার দুর্গ আক্রমণ করে জয় করেন, কিন্তু সাতপুত্রকে হারানোর শোক রাহিব দত্তকে রীতিমতো পীড়া দেওয়ার কারণে সেখান থেকে চলে আসেন আফগানিস্তান।বাকিরাও ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন স্থানে।
 লোকগাথার আড়ালে থাকা ইতিহাসটিও কিন্তু কম আকর্ষক নয়। হুসেনি ব্রাহ্মণদের প্রকৃত সন্ধান খুঁজতে গিয়ে যাদের কথা জানা যায় তারা হলেন মহিয়াল ব্রাহ্মণ। তাদের উৎস, আদি অবস্থান খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টায় সবথেকে বড় অন্তরায় হল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে উপমহাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখায় ব্যাপক পরিবর্তন। মহিয়াল ব্রাহ্মণদের আদি বাসস্থান ছিল সরস্বতী নদী অববাহিকায়। সরস্বতী নদী, হিন্দুদের প্রাচীনতম পবিত্র নদীর উৎস গান্ধার রাজ্যের(আফগানিস্তান )হিন্দুকুশ পর্বতমালা। সেখান থেকে পাকিস্তান হয়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করা এই নদী তীরবর্তী অঞ্চলই ছিল মহিয়াল ব্রাহ্মণদের আদি বাস।প্রথাগতভাবে সমস্ত ব্রাহ্মণদের যে জীবিকা অর্থাৎ পৌরহিত্য এবং অধ্যাপনার থেকে বহুদূরে থাকা এই সব ব্রাহ্মণরা আদতে যোদ্ধা জাত। ক্ষত্রিয় পেশার সাথে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই ব্রাহ্মণদের থেকে দত্ত বা হুসেনিরা কিছুটা আড়াআড়ি বিভাজিত। ঠিক একই রকম ভাবে মুসলিমদের সাথে ঘনিষ্ঠতা তাদের ভাগ্যে নিয়ে আসে আরও বড় বিপর্যয়।সেই বিপর্যয় ডেকে এনেছিল সাতচল্লিশের দেশভাগ।দেশভাগের আগে পর্যন্ত হুসেনি ব্রাহ্মণদের নিজস্ব ধর্মাচরণে কোনো বাধা কখনও আসেনি। কিন্তু একথা ভাবলে ভুল হবে যে বেশ কিছু রীতি পালন করলেও তারা সম্পূর্ণ ভাবে মুসলিম ধর্মের অনুগামী হয়ে পড়েছিল বরং মনে করা যেতে পারে যে হিন্দুত্ব বজায় রেখেই বেশ কিছু মুসলিম রীতি তারা পালনে অভ্যস্ত ছিল। ঠিক যেন দুই সম্প্রদায়ের মাঝে যোগাযোগ রক্ষার এক আশ্চর্য মিসিং লিংক ছিল এই সম্প্রদায়।বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ মুজিব হোসেনি ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে তার লেখায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা উল্লেখ করেছেন -“They(Hussain brahmin )were not really converts to islam,but adopted such islamic beleifs and practices as were not deemed contrary to hindu faith."
 এই সমস্ত ছকভাঙা, প্রথাবিরুদ্ধ রীতির বেশ কিছু আজও অনুসরণ করে চলেছেন মুষ্টিমেয় কিছু হোসেনি ব্রাহ্মণ। আজও হুসেনি ব্রাহ্মণ পরিবারের পুত্র সন্তানের মুন্ডন অনুষ্ঠানে ইমাম হোসেনের নাম উচ্চারণ করে সঙ্গীত  সমগ্র অনুষ্ঠানের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ঠিক একই রকমভাবে পরিবারে কারও বিবাহ অনুষ্ঠানে ইমাম হোসেনের স্মরণে পরিবেশিত হয় হালুয়া। আজকের সাম্প্রদায়িক হানাহানির যুগে যা ভেবে দেখা বা করা রীতিমতো আশ্চর্যজনক বললেও কম বলা হয়।
 রাহিব দত্তের আফগানিস্তানে ফিরে আসার পর থেকে হুসেনি ব্রাহ্মণদের একটা বড় অংশ ছড়িয়ে পড়েছিল শিয়ালকোট এবং রাজস্থানের পুস্কর অঞ্চলে। কিন্তু সেখানেও সম্পূর্ণ থিতু হতে না পেরে সেখান থেকে ধীরে ধীরে ছড়াতে ছড়াতে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে, বিশেষত মহারাষ্ট্র, গুজরাট এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে ক্রমশ অভিবাসন ঘটতে থাকে হুসেনিদের।
 দেশভাগ অসংখ্য মানুষের মধ্যে যে বিরহ, বিপন্নতা ডেকে এনেছিল তার থেকে বেশি বই কম হয়নি অগুনতি হুসেনি ব্রাহ্মণদের কাছে।বাকি সকলের থেকেও তাদের দুর্দশার একটা বড় কারণ হয়ে উঠেছিল তাদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। স্বাভাবিকভাবেই দেশভাগ তাদের দ্বিধাবিভক্ত করে দেয় এক লহমায়। একদল যারা পাকিস্তানের ভুখন্ডে ছিল তারা স্বাভাবিক ভাবেই সেখানকার নাগরিক হিসেবে জীবন কাটিয়ে দেওয়াকেই মনস্থ করে, অন্যদিকে যারা হিন্দুস্তানে ছিল তারা আজন্ম সেই ভুখন্ডকেই নিজের মাতৃভূমির মর্যাদায় বসিয়েছিল।তাদের পক্ষে সেদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ল। কিন্তু সমস্যার মূলগত প্রভেদ দুদেশের হুসেনি ব্রাহ্মণদের কাছে খুব বেশি ছিলনা। পাকিস্তান ভুখন্ডে বসবাসকারী মুসলিম জনগণের কাছে হুসেনি ব্রাহ্মণরা অমুসলিম হিসেবে যেমন অত্যাচারের শিকার হয়েছিল, ঠিক একই ভূমিকা নিয়েছিল এদেশের সাম্প্রদায়িক বিষ বাষ্প নিঃসরণকারী হিন্দু সম্প্রদায়ও। স্বাধীন ভারতবর্ষ বা আজাদ পাকিস্তান কোথাও সে অর্থে স্থান হল না হুসেনি ব্রাহ্মণদের কারও। যদিও স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান এই ভেদাভেদ হুসেনিদের স্বাধীন ধর্মাচরণে সে-রকম কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি, কিন্তু স্বাধীনতা এবং সেই সঙ্গে দেশভাগের অভিজ্ঞতা সবকিছুর পরিবর্তন করে অনেকটা। হুসেনি ব্রাহ্মণদের আদি বাসস্থানগুলি সিন্ধ, বালুচিস্তান,বোখারা, কুফা প্রভৃতি অঞ্চল ছাড়িয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে পাঞ্জাব, গুজরাট, মহারাষ্ট্রের দিকে। দেশভাগের আগুনে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলির মধ্যে পাঞ্জাব ছিল অন্যতম,আর সেখানে সীমান্তের দুপ্রান্তে পাঞ্জাবে রয়ে গিয়েছিল এক বিপুল পরিমান হুসেনি ব্রাহ্মণদের ঢল। ব্রাহ্মণ হিসেবে তাদের এমনিতেই সেই মর্যাদা ছিলনা তাদের মুসলিম আচার ব্যবহারের কারণে আবার সীমান্তের অপরদিকে তারা ছিল সংখ্যালঘু। অথচ স্বাধীনতার আগে অমৃতসরে হুসেনি ব্রাহ্মণদের সবথেকে বড় যে তাজিয়া তা বেরোতো বেশ জাঁকজমক করেই। ইয়া হাসান ইয়া হুসেন শব্দব্রহ্ম রীতিমতো অনুরণিত হত হুসেনি ব্রাহ্মণদের কণ্ঠস্বরে।ঐতিহাসিক এবং একজন হুসেনি ব্রাহ্মণ বংশজ ননিকা দত্তের সাক্ষাৎকার থেকে উঠে আসা এক অভূতপূর্ব তথ্য চমকিত করে যখন তিনি দুই বন্ধুর কিছু বিস্মৃত কথোপকথন তুলে ধরেন -
 ১৯৪২, স্বাধীনতা আসতে তখনও বাকি বেশ কয়েক বছর।ডাঃ গোলাম নবী ছিলেন অমৃতসরের বিখ্যাত দন্ত চিকিৎসক।ফরিদ চকের কাটরা শের সিং -এ ননিকা দত্তের বাড়ির কাছেই ছিল তার আবাস। ননিকা দত্ত পরিষ্কার স্মৃতিচারণ করেছেন একটি দিনের কথা... মহরম। ব্যস্ত মানুষ গোলাম নবী দ্রুত ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছলেন।“দত্ত সাহেব হাম ইন্তেজার কর রহে হ্যায়,আপ কন্ধা দেঙ্গে তব তাজিয়া উঠেঙ্গে। "-একজন অমুসলিম মানুষ তাজিয়া বহনের দায়িত্বই শুধুমাত্র পাচ্ছেননা, বরং মুখ্য দায়িত্বে তিঁনিই থাকছেন এবং বাকি সমস্ত মুসলিম সাথীরা তার জন্য অপেক্ষা করছেন, এটাই তো শাশ্বত ভারতবর্ষ, যেখানে ধর্মের নামে কোনো ভেদাভেদ নেই, বিভাজন কখনও মনুষ্যত্বের উপর দিয়ে যেতে পারেনা। এই সংস্কৃতি যুগযুগ ধরে চলে এসেছে ভারত তীর্থভূমে।শুধুমাত্র অমৃতসর বা পাঞ্জাবই নয় আজমীরের বেশকিছু অঞ্চলেও হুসেনি ব্রাহ্মণদের মহরমের সময় তাজিয়া বেরোনোর চল ছিল, সেই সাথে“বাহ্ দত্ত সুলতান, হিন্দু কা ধরম, মুসলমান কা ইমান আধা হিন্দু আধা মুসলমান "শব্দবন্ধে চারিদিক মুখরিত করে তোলা সেই পদযাত্রা ছিল দেখার মত। এইসব অর্ধ-মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে হঠাৎ কালোমেঘের সঞ্চার হয় দেশভাগের প্রাক্কালে। এমনিতেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূল ছিলনা, তার উপর কোনো সম্প্রদায়ই সম্পূর্ণভাবে নিজেদের বলে মনে করেনি এই মানুষগুলোকে। বিভিন্ন লেখায় কিংবা সাক্ষাৎকারে সেই অত্যাচার এবং অরাজক অবস্থার বেশ কিছু চিত্র ফুটে উঠেছে বিস্থাপিত হুসেনি ব্রাহ্মণ বা শিয়া ব্রাহ্মণদের পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের স্মৃতিচারণে। সৌভ্রাতৃত্ত্বের উদাহরণ দেওয়া হয়েছিল যে অমৃতসরের, সেই শহরেরই ফরিদ চকের কাটরা শের সিংহ এলাকায় ব্রহ্মনাথ দত্ত কাশিরের বাড়ির ঘটনা। একদল ধর্মান্ধ হিন্দু অগ্নিসংযোগ করে বাড়িটিকে ভস্মীভূত করে দেয় সম্পূর্ণভাবে।যে ফরিদ চক ছিল হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিশেষ স্থান, যেখানে তাজিয়া মিছিলের প্রধান উদ্যোক্তারা ছিলেন দত্ত-ব্রাহ্মণ বা হুসেনিরা, সেখানে কিছুদিনের অরাজক পরিস্থিতি সবকিছু ওলোটপালোট করে দিয়ে চলে গেল।ধর্ম যখন মানুষের মানবিক সত্বার উপর স্থান পায় তখন তার যে করুণ পরিণতি হয়,তা বোধহয় সকল সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই সত্য। ভারতের সীমান্ত প্রদেশগুলিতে হুসেনিদের উপর হিন্দুদের দ্বারা যে অত্যাচার হয়েছিল, তা একই রকম ছিল সীমান্তের অন্যদিকেও।সিন্ধ, পশ্চিম পাঞ্জাব, গিলগিট, শিয়ালকোটে আজ হয়তো খুঁজলে আর একটাও হুসেনি ব্রাহ্মণ পরিবার জীবিত পাওয়া যাবে না। কারবালা প্রান্তরে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া রাহিব দত্তর বংশজরা মুসলমানদের কাছেও স্বজাতির মর্যাদা লাভ করেননি, ফলে বাধ্য হয়ে হিন্দুস্তানের দিকেই ফিরে আসতে হয় তাদের। বর্তমানে তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে... কিন্তু বহুক্ষেত্রেই তারা তাদের হুসেনি ব্রাহ্মণের পরিচয় গোপন করে নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দেওয়াকেই সহজ আত্মগোপনের পন্থা হিসেবে স্থির করেছেন। একমাত্র বিখ্যাত হুসেনি ব্রাহ্মণরাই বোধহয় তাদের পরিচয়টাকে সামনে আনার সাহস দেখাতে পেরেছেন।সাম্প্রদায়িক হিন্দু দলগুলির ‘ঘর-বাপসি'রাজনীতির কথা সামনে এলেই সবথেকে প্রথমে হুসেনি ব্রাহ্মণদের কথা সামনে আসে।স্বাভাবিকভাবেই সেই আক্রমণাত্মক রাজনীতির শিকারও হন তারাই।অমৃতসরেরই এক ইমামবাড়া যেখানে দেশভাগের কিছুদিন আগে পর্যন্তও মহরমের আসুরা পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালিত হত হুসেনি ব্রাহ্মণদের দ্বারা সেখানে কয়েক বছরের মধ্যেই পরিস্থিতির এমন পরিবর্তন হয় যে সেই আচার বদ্ধ দ্বারে পালন করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়। এমন অবস্থা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয় যাতে কোনো হুসেনি ব্রাহ্মণ সাহসের সাথে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় বলার ক্ষমতা হারায়। সেই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় অমৃতসরের জনৈক অমিত মালঙের কথায় -“অব কিসি হুসেনি ব্রাহ্মণ কি হিম্মত হ্যায় কে ওহ হাত খড়া করে!"ইতিহাসবিদ ননিকা দত্তের কথায় কিছুটা আভাস পাওয়া যায় -“The reality is that the community,Whose ancestors are believed to have sacrificed Seven sons for Imam Hussain has migrated to the different parts of the world as global citizens . Many has simply discarded their HUssaini Brahmin identity and started to represent themselves as Brahmins... "
 ননিকা দত্ত প্রচেষ্টা করেছিলেন ইতিহাসের উজান পথে পৌঁছে যেতে আসুরায়, হুসেনি ব্রাহ্মণদের তাজিয়া নিয়ে বেরোনো শোভাযাত্রার অংশীদার হওয়ার আশায় জল ঢেলে দেন অমৃতসরের ইমামবারার কেয়ারটেকার সেই বৃদ্ধ আব্বুজি, যার কথা প্রবন্ধের শুরুতেই বলা হয়েছিল -“অব কোই জুলুস নেহি নিকালতা",জুলুস -এ -আসুরা ইমামবাড়ার চার দেওয়ালের ভিতরেই অনুষ্ঠিত হয় ।বা বলা ভাল বাইরে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চাপে এমন একটি বিশেষ ঐতিহ্যমন্ডিত অনুষ্ঠান চার দেওয়ালের ভিতরে আবদ্ধ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা।কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনার উল্লেখও পাওয়া যায় যা দেশভাগের সময়কার সম্প্রদায়গত হিংসার অনেক অনেক উর্দ্ধে ব্যক্তিগত সম্পর্কের, ভালোবাসার, শ্রদ্ধার, বন্ধুত্বের জয়গান গেয়ে চলে। বিখ্যাত হুসেনি ব্রাহ্মণ চিত্র তারকা সঞ্জয় দত্তের স্বনামধন্য পিতৃদেব সুনীল দত্তের স্মৃতিচারণায় সেরকমই একটি গল্প উঠে আসে।
কাহিনির শুরু আরও কিছুটা আগে, সুনীল দত্তের জ্যাঠামশাই তায়োজিকে নিয়ে । আদি বাস ঝিলম শহরের কাছে খুর্দ নামের একটি গ্রাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক অপরূপ সমন্বয় খুর্দকে আরও অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। সেই ছোট্ট ছবির মত জনপদটির জমিদার ছিলেন তায়োজি।সুনীল তার কাছেই প্রতিপালিত। সকলের প্রিয় তায়োজির প্রভাব এলাকায় নেহাত কম নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিবেশ  বিষাক্ত হতে শুরু করল। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার অমুসলিম জমিদার তায়োজি আক্রমণের শিকার হলেন। সেনাবাহিনীর সহায়তায় ধীরে ধীরে হিন্দুদের সরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলতে শুরু করলেও নিজের ভিটে ছাড়তে অস্বীকার করেন তিনি। কিন্তু শেষে বেগতিক দেখে কাছেই নাওয়ানকোটে চলে যান যেখানে সুনীল দত্তের বাবার বিশেষ বন্ধু ইয়াকুবের বাড়ি ছিল। কিন্তু বেঁকে বসেন স্থানীয় মৌলবী। তিনি ফতোয়া জারি করেন যে কোনোভাবেই কোনো অমুসলিমকে নোয়ানকোটে ঢুকতে দেওয়া যাবেনা। জনতা উত্তেজিত হয়। বেশ কয়েকজন একত্রে আক্রমণ করে বসে বাড়িটিতে। কিন্তু বিক্ষোভকারী উত্তেজিত জনতার সামনে ঢালের মত দাঁড়ান সুনীল সাবের পিতৃ-বন্ধু ইয়াকুব ও তার ভাইয়েরা। বন্দুক হাতে উত্তেজিত জনতার সামনে থেকে রক্ষা করে তাদেরকে মধ্যরাতে ঝিলমের রিফুজি ক্যাম্পে পৌঁছে দেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই ঘটনার উল্লেখ করে যান। ঠিক একই রকমভাবে সুনীল দত্ত লাহোরের শাওকত খানুম হাসপাতালে অর্থ দান করে তার পূর্বপুরুষদের হুসেনি ব্রাহ্মণদের সাথে যোগাযোগের কথা স্বীকার করেন -“For Lahore like my elders, I will shed every drop of blood and give any donation asked for, just as my ancestors did when they laid down their lives in Karbala for Hazrat Imam Hussain. "
উপমহাদেশের ইতিহাস নানা কিংবদন্তীতে মোড়া। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসেনের সমর্থনে হিন্দু ব্রাহ্মণ রাহিব দত্তের সহযোগিতার হাত বাড়ানো এবং সাত পুত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে বলিপ্রদান কতটা সত্যনিষ্ঠ, ঐতিহাসিক তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ একটা থেকেই যায় কারণ শিয়া ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসেবে ইরানের শিয়া মুভমেন্টের ইতিহাসকে যদি স্বীকার করা হয় তবে সেখানে হুসেনের সমর্থনে হিন্দু ব্রাহ্মণ রাহিব দত্তের যোগদানের উল্লেখ পাওয়া যায়না। সেই মত এটি আদৌ লোককাহিনি নাকী বাস্তব যা ইতিহাসের অন্তরালে চলে গিয়েছে সেটা তর্কের বিষয়।এমনও হতে পারে পরবর্তীকালে এই কাহিনিগুলি যুক্ত হয়েছে।পক্ষে বিপক্ষে দু'দিকেই অসংখ্য বিশ্বাসী এবং মতের সমাহার!কিন্তু সবকিছু ছেড়েও একথা অনস্বীকার্য আজকের অতি সাম্প্রদায়িক উগ্র রাজনীতির সময় হুসেনি ব্রাহ্মণরা নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অসাধারণ উদাহরণ।


*তথ্যসূত্র:

1.The Forgotten History of Hussaini Brahmins and Muhharam in Amritsar, the wire -Nonika Dutta -30th September, 2019

2. In Good faith -the Hindus with Hussain: Indianexpress. com:21st September 2018

3. Battle for truth-the news international :www.thenews.com.pk:28th August, 2020

4. হুসেনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মিথ ও বাস্তবতা-blog muktomona.com

5.দেশভাগ বিরোধী মুসলিম জনমত -শামসুল ইসলাম -কে. পি. বাগচী, কলকাতা
চিত্রঋণ :ইন্টারনেট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন