দোঁহা

আত্রেয়ী চক্রবর্তীর কবিতা


উদ্বাহ

তোমাকে উজাড়ে উজাড়ে দেব কুয়াশাচিহ্ন ও যতি
গচ্ছিত সব ভ্রাম্যমাণ সোনালিবেলা
দিয়ে যাব কুবোপাখির হাপরটানা বুক, কামগন্ধী ইত্তরনাম

তোমারই হাতে মানান দিয়ে বিদ্যাপতিগান
'বিরহে তন্ময়তা'-র অকালবোধন ডাক দিয়ে যাব স্থির—
বালিকাবেলার অপাপস্মৃতি, বিলুব্ধচিত্ত যত
ক্ষণজন্মা অভিমান পরশ তাও দেব, জিভে দেব মধু ও মদ

আমাদের হ্যাঁ-ব্যাধি, না-ব্যাধি, আঃ-ব্যাধির পাশে
দাঁড়িয়ে যে সানাইবাদক
বিসমিল্লাহ্ বলে আকাশে ছুঁড়ে দিচ্ছে
নক্ষত্রের পরমান্নস্বাদ
সে-স্বাদ ও বারি রেখে যাব নবকলেবরে

আমি শুধু সেঁওতিঘ্রাণ, সালংকারা নাভিকূপ —
গ্রহণে সক্ষম হও তবে
গ্রহণে ও-উৎসর্গের পাতা…



রাগপ্রধান

বিষাদের বাঁকে বেড়ে ওঠা গাছটির নাম সোহাগলতা। গতরাতের বৃষ্টি তার কয়েকখানা ফুলপাতার বাহার ঘুচিয়েছে। অমন মরণআখ্যানের পাশে বসে অস্ফুটে ডাক দিই —'প্রেম'...

ঠিক এমন মুহূর্তে ভোর ভেঙে, তোমার ঠোঁটে কেউ বুলিয়ে দিচ্ছে বিলাসখানি টোড়ির প্রলেপ। ভূ-জগতের গূঢ় সত্যটি অনাহূত ঘটনার মতো সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তুমি, তোমার অন্তরজল নিস্তরঙ্গ। ঘুমের পাশে ভবিষ্যৎ নামের বীজ ধারণ করতে চেয়ে যতটুকু জরায়ুস্পর্শ রেখেছিলে, তা এই তীব্র আলোয় অভিমান হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে কাঁচভাঙা আকাশে।
হরিৎবনে শান্তিকুসুম থাকে, সে তো জানা কথা। গাছে গাছে পাখিদের চুক্কুরডাক, হাওয়ার শিস! এমনই খরাবোনা মাটিতে কোন এক পাখি বুঝি লালরঙা ফলের বীজ ছড়িয়েছে; দিয়েছে জল, বাতাস, কিছুটা রোদ্দুরও। অতএব ধরে নিচ্ছি, মোহনীয় পুরুষটি কৃষিকাজে মগ্ন। ছেনে-ছেঁচে ফসল ফলাবে বুঝি! আর তুমি-উর্বরা, সমস্ত 'ধী' জড়ো করে ব্রহ্মাণ্ডের আঁচল ভরে তুলছ, সযত্নে। আহা স্তন্যস্বাদ, আহা মায়াজোছনা!
ভোরের জল ভেঙে সকালে গড়িয়ে যাচ্ছে। গড়াতে গড়াতে মিশে গেল নদের কিনারে; ঠিক যেন একই প্রাসাদে থাকা দুয়োরানি ও সুয়োরানির রাধিকে আলাপ। সে আলাপে বিলম্বিত নেই, দ্রুত ও ঝালা প্রকট। অনেকদূর থেকে প্রভা আটরে ভেসে আসছেন, "কউন গলি গ্যয়ো শ্যাম…"

এতক্ষণে সেই নৃত্যরত পাখিটি স্রষ্টার আসনে বসে সোহাগলতার বাকল খসাচ্ছে। নামেই লতা, স্বভাবে প্রাচীন শিলা! কিন্তু সে পাখি বড় সুনিপুণ জাদুকর। মন্ত্র গেয়ে কিঙ্কিণী ঠোঁটে তুলেছে কেমন, দ্যাখো! সোহাগলতা দাঁড়িয়ে ঠায়, শুধু বান ডেকেছে ভিতরগাঙে। এই অবলোকনের সাক্ষী হয়ে তুমি পায়ের পাতায় ইশারা শিখছ। তোমার পুরুষটিকে ডাক দিচ্ছ দাঁতে কেটে বিষ তোলার জন্য। বিষ কি নেই গাঙপানির বুকেও? জিভের আগায় ছোবল শিখে সেও তো জাত কেউটে! গাঙপানি, গাঙপানি—সর্পদোষে শরীর জেরবার। সে দোষ, সে মেঘ ভাঙার দায় নেবে কে!
উর্বর জমি, তোমার অন্তহীন পরাবর্ত শীৎকারে মাতবে বলে, পৃথিবীর পাপ এসে লাগছে তোমারই গায়ে। তুমি নাইতে নেমেছ জবাকুসুম আকাশকে সাক্ষী রেখে, পাপের দায় হাতে নিয়ে মুখ ডুবিয়েছ দারুচিনি বনে। এবার তবে জন্ম নিক শস্যভাগ, নব্যমুকুল, মিছরিমিঠা ডালের দানা। আশ্লেষভরে সেও তো বলুক সোহাগ, সোহাগ…

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন