শুভা মিত্র
ছোটোবেলা থেকে বারান্দার প্রতি আমার এক অদ্ভুত ভালোবাসা। বিশেষত সেটা যদি কোনো আদ্যিকালের বাড়ির দোতলার জাফরিকাটা বারান্দা হয়। আমাদের বাড়িটা আদ্যিকালের হলেও অমন একটা বারান্দা ছিল না বলে আপসোসের শেষ ছিল না। মাঝেমধ্যে বিকেলবেলা পাশের পাড়াতে ঠাকুরদার মামাবাড়িতে বেড়াতে যেতাম। লাফিয়ে দোতলায় চলে যেতাম বারান্দাটায়, আর আমাদের বাড়িটা দেখার চেষ্টা করতাম। কখনো কখনো ওই বাড়ির দুই তরফের মানুষজনেরা কোলে তুলে নিত, যাতে দেখাটা আরো ভালো হয়।
আমাদের বাড়ির বারান্দাটা ছিল কিছুটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে, ওই একরকমের দেড়তলায়, ঠাকুরঘরের পাশে। অমন সুন্দর না হলেও আমার বড়ো ভালোবাসার জায়গা ছিল সেটা। শীতের বেলায় স্কুল থেকে ফিরে ওখানে বসে প্রতিদিন সংসার পাততাম। মায়ের ওড়না জড়িয়ে শাড়ি, ঠাম্মার গামছা দিয়ে চুল, আর লাল কাচের চুড়ি দিয়ে শাঁখা-পলা। বাসন কয়েকটা জোগাড় করতাম নিরামিষ রান্নাঘরের তাক থেকে, ঠাম্মার নজর এড়িয়ে। তারপর আমি, আমার তিন পুতুল মেয়ে - মিতালি, নীলিমা, আর লম্বিপিসি ও একমাত্র কোলপোছা ছেলে গামা - এই পাঁচজনের সুখের সংসার খুশিতে ভরে উঠত।
তখনো হয়তো জানতাম না, কৈশোরের স্পর্শকাতর মনটা রাতের পর রাত এই একফালি বারান্দাতেই আশ্রয় পাবে।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল মনের মতো করে একটা বারান্দার ছবি আঁকব। আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ-পনেরো বছর আগে মা আমায় নিয়ে সারা সপ্তাহের পর শনিবারের বিকেলে হঠাৎ বেরিয়ে পড়ত। বাড়ির সামনে দিয়ে ৩বি বাস যেত, তাতেই গিয়ে উঠতাম। নামতাম ঠিক যখন কন্ডাকটর কাকু চেঁচিয়ে উঠতেন, 'এক্সাইড... এক্সাইড... এক্সাইড...'
রাস্তা পেরিয়ে নন্দন চত্বর৷ আমার শৈশবের স্বপ্নের দেশ। কতরকমের প্রদর্শনী হত তখন, এখনকার মতো সরকারী ব্যানারে না হলেও, রঙিন হয়ে থাকত চারিদিক। আমরা গিয়ে ঢুকতাম একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে। সেখানে তখন থেকেই প্রথম ছবি দেখতে শিখেছি। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করতাম ছবিগুলির, কী বুঝতাম জানিনা... কখনো কখনো সেখানে সেই ছবির স্রষ্টা স্বয়ং উপস্থিত থাকলে খুব করে আমার গাল টিপে দিতেন। একদিন নর্থ গ্যালারিতে অমনি এক শনিবারের বিকেলে এক অদ্ভুত ছবি দেখেছিলাম। সম্ভবত তেল-রঙের ছবি। এক মেয়ে, বাঙালি অবিবাহিতা মেয়ে... বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে। দাদুর মামাবাড়ির মতো সেই সুন্দর এক বারান্দা। মেয়েটির মুখে এক অদ্ভুত মায়া... চোখদুটো ক্লান্ত.... ঠোঁটের কোণে আলগা হাসি... এলোচুল ছড়িয়ে আছে কাঁধে.... খয়েরী রঙের ঢিলেঢালা ব্লাউজের ওপর চন্দন-রঙা শাড়িটা নেহাতই আলগোছে জড়ানো। মেয়েটির পেছনে আমাদের বাড়ির সেই খড়খড়ি দেওয়া জানালা। তার বাইরে একফালি গঙ্গার ঘাট। ঘাটে নৌকো বাঁধা। বারান্দা থেকে মেয়েটি কী দেখছে বোঝা যাচ্ছে না। কোনো দৃশ্য.... নাকি কোনো চেনা মানুষ?
ছবিটা ভুলতে পারিনি। মনের কোন এক নিভৃত কোণে পড়েছিল ধুলো মেখে; আরো পাঁচ বছর পর যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, আমাদের স্কুলের দ্বিবার্ষিক চিত্র প্রদর্শনীর জন্য যখন ছবি চাওয়া হল... সেটি বেরিয়ে এল। একটা বারান্দা আঁকলাম। কিন্তু তখন ওই একাকিনী মেয়ের একলা দাঁড়িয়ে থাকাটা কেমন অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল। আঁকলাম তিনজনকে, মা ও তার দুই মেয়ে। ছোটো মেয়েটি মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে... আর বড়ো মেয়েটি কিছুটা দূরে। মা ও ছোটো বোনের থেকে ওর গায়ের রঙ সামান্য চাপা। তারা কী দেখছে, সেটা রহস্যই রয়ে গেল। পরেরদিন জমা দেওয়ার জন্য ভালো করে খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে গেলাম। অন্য সহপাঠীরাও তাদের আঁকা এনেছে। দেখে খুব লজ্জা পেলাম। ওরা প্রায় সকলেই তখন জলরঙ পারে। আর আমি... ভালো করে রঙও চিনিনা, কোনোরকমে রঙ পেন্সিল কাগজে ঘষে ছবি দাঁড় করাই। লজ্জাও পেলাম, ছবিটা মনের মতো হয়নি বলে কষ্টও হল। প্রদর্শনীর দুদিন যে ঘরে আমার আঁকা টাঙানো হয়েছিল, মা অনেক চেষ্টা করেও আমাকে সেই ঘরে ঢোকাতে পারেনি।
বহু বছর পর উত্তর কলকাতায় কলেজজীবন কাটাতে এসে, আমি যেন এক অদ্ভুত মুক্তি পাই। ক্লাসের ফাঁকে ট্রাম ধরে চলে যাই আরো উত্তরে, হাতিবাগান নেমে কোনো এক অজানা গলির পথে। আবার কখনো বইপাড়া ছাড়িয়ে বড়ো রাস্তার ফুটপাথ ধরে আমহার্স্ট স্ট্রিট, শ্রদ্ধানন্দ পার্কের দিকে। বাড়িগুলো দেখি, তার চেয়েও বেশি করে দেখি দোতলার বারান্দাগুলো।
দেখা ও অদেখার মাঝখানে পরিণত মন মনে করিয়ে দেয়, কেবল বারান্দা আছে বলেই মানুষ এখনো নিজেকে এই সৃষ্টির অংশ বলে মানতে পারে। আকাশ দেখে, আলো পায়। নয়তো কবেই জগতের থেকে পৃথক হয়ে সব দেওয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়তো...
জানি, একদিন একটা ছবি এঁকে ফেলব ঠিক।