ডরোথি পাল
[সংগ্রাহকের তরফে কিছু কথাঃ এই স্মৃতিচারণার সময়কাল আনুমানিক ১৯৬৪-৬৫ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭৫এর প্রথম ভাগ অবধি। ৭৫এর স্বাধীনতা আর ৭২এর প্রজাতন্ত্র পেরিয়ে আমাদের দেশ যখন অঙ্কের হিসেবে বয়সের দিক থেকে প্রৌঢ়ত্ব পেতে চলেছে, তখন চারপাশে তাকিয়ে আমরা কেবল দেখছি আধুনিকতার গাড়ি চলেছে গড়গড়িয়ে খুব। এখন কেবল ছোটারই নিয়ম। প্রতিদিন প্রতিক্ষণেই যেন বা পিছন ফেলে আসা সময়কে আরও বেশি করে টপকিয়ে যেতে হবে। যা কিছু পাবার, সেসব কিছুকে তো এক্ষুণি করে পেতে হবেই – উপরন্তু আরও কি কি পাওয়া উচিত ছিল, না পেলে মোটেও চলছে না, এক্ষুণিই তা পাওয়া দরকার, তারও লিস্টি বানিয়ে রাখতে হবে। জগৎ যেন এক খুড়োর কলে পরিণত হয়েছে। সুকুমার রায়ের ভাষায় “সামনে তাহার খাদ্য ঝোলে যার যেরকম রুচি, মণ্ডা মিঠাই চপ্ কাট্লেট্ খাজা কিংবা লুচি। মন বলে তায় ‘খাব খাব’, মুখ চলে তায় খেতে; মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে।” এমনি করে যে কেবল দশবিশ ক্রোশ পথই নয়, প্রজন্মের পরে প্রজন্মের শৈশব, কৈশোর, যৌবন নির্বিবাদে এই ছোটার দেবতার পায়ে বলি হয়ে চলেছে – সেই নিয়ে হুঁশ থাকছে না কারোর। আমাদের ছোটবেলায় ডায়েরি লেখা শেখানো হতো। হয়তো বা এখনও হয়। কিন্তু পুরনো সেই ডায়েরিগুলোর হলুদ হয়ে যাওয়া, ভাঁজ পড়ে যাওয়া পুরনো পাতাগুলোকেই আবার করে শীতদুপুরের রোদে খুলে দেখতে যা সুখ, তার জুড়ি মিলত না। নীচের পাতাগুলোও এমনই ডায়েরি থেকে কুড়িয়ে আনা পাতা। তাতে যিনি লিখেছেন তাঁর নিজের কথা আছে, তাঁর চারপাশেকার মানুষদের কথা আছে। পাহাড়ের কথা আছে, সুখ-দুঃখের কথা আছে। চিরকালীন সাহিত্য হয়তো নয়। কিন্তু এ লেখা পড়লে পরে ৭৫ বা ৭২ পেরিয়ে আসা আমাদের যে দেশ, তারই ফেলে আসা দিনগুলির এক খণ্ডচিত্রকে দেখতে পাই। মনে হয় পাকদণ্ডী বেয়ে, কুয়াশা গায়ে মেখে সেই অতীতেরই রোদ সেঁকে আসি কিছুক্ষণ। এই সংগ্রহকে সাজিয়ে দেওয়া সেই উদ্দেশ্য থেকেই। ছবিগুলি লেখিকার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে নেয়া।]
…কার্শিয়াং ছিল বাবা মা আর আমাদের প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়ার জায়গা। অপরিসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এক ছোট্ট শহর। বাবা বাড়িটি করার সময় যে জায়গাটি পছন্দ করেছিলেন তাতে বুঝতে পারা যায় বাবার সৌন্দর্যপ্রিয়তা কতটা ছিল। বিলেত থেকে ডাক্তারি পড়া শেষ করে কলকাতায় ফিরে আসার পর কবে যে বাবার এই জায়গাটা বেছে নিয়ে নিজেদের মতো করে একটা আস্তানা করার কথা মনে হয়েছিল আমার জানা নেই। ভাইবোনেদের মধ্যে আমি সবার ছোট, আর বাবাকে পেয়েওছি কম দিনের জন্য - এটুকুই মনে আছে কেবল যে বাবা প্রায়ই বলতেন, এই আমার সুইজারল্যান্ড।
তখন অনেক সম্ভ্রান্ত বাঙালিদেরই গ্রীষ্মকালের ঠিকানা ছিল এই শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিঙের পাহাড়। বাবা ছিলেন অন্যরকমের মানুষ। অত্যন্ত সৎ, সাহসী আর পরিশ্রমী-কোনোদিন প্র্যাকটিসের প্রয়োজনে অর্থের তোয়াক্কা মাত্র করেননি, সেবা করেছেন যথাসাধ্য। অদ্ভুৎ এক মমতা ছিল সরল পাহাড়ি মানুষদের উপর। ১৯৫০এ কত কষ্টে যে জায়গা কিনে ওখানে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি করেছিলেন জানিনা কিন্তু বাড়িটি ছিল বাবার প্রাণ। বাড়িটির অবস্থান দেখে নাকি এক সাহেবের তাক লেগে গিয়েছিলো। তিনিই পরামর্শ দিয়েছিলেন নাম দিতে 'ঈগল ভিউ'। বাড়িটা ছিল দো’তলা-একতলায় ভাড়াটেরা থাকতো আর দোতলায় আমরা। দোতলায় যে গোলবারান্দা ছিল তাতে বসেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেত। বাড়ির ডানদিকে ডাউহিল ও স্যানাটোরিয়াম, বাড়ির নিচে রেডিওস্টেশন পাঙ্খাবাড়ির রোডের উপর। আরো নীচে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে মকাইবাড়ি টি এস্টেট হয়ে শিলিগুড়ি চলে গেছে। পাঙ্খাবাড়ির রাস্তা দিয়ে শিলিগুড়ি যেতে সময় লাগতো এক ঘন্টার কিছু বেশি। এই রাস্তাটা কেবল মিলিটারিরাই ব্যবহার করতো। হিলকার্ট রোড ধরে কার্শিয়াং আসতে সময় লাগতো আড়াই ঘন্টা।
সমস্ত ভাইবোনে মিলে, আত্মীয়স্বজন সমেত আমরা কার্শিয়াং পৌঁছাতাম ট্রেনে-সেকালের ট্রেন জার্নিও ছিল এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। দার্জিলিং মেলে ফারাক্কা পৌঁছে সেখান থেকে স্টীমারে গঙ্গা পেরিয়ে মনিহারি ঘাট। সেখান থেকে মালপত্র নিয়ে আবার ট্রেনে উঠে দার্জিলিঙের দিকে আসতে হতো। কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিংয়ের লাইনে শিলিগুড়ি, সুকনা, রংটং, তিনধারিয়া, গয়াবাড়ি, মহানদী হয়ে কার্শিয়াঙে ঢুকতে হতো। কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিং মাত্র ৪টি স্টেশন। কার্শিয়াঙের পরে টুং, সোনাদা, ঘুম, আর তারপরেই দার্জিলিং। রংটং আর গয়াবাড়ির মাঝে ছিল পাগলাঝোরা ঝর্ণার উপস্থিতি। সেই ঝর্ণায় এতো বেশি জল ছিল যে ট্রেনের জানলা দিয়ে জল ঢুকে আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে যেতো। কার্শিয়াং স্টেশনে ঢোকবার আগেই পথে পড়তো ধোবিখোলা নামে আরেকটা ঝর্ণা। তখন পাহাড় ছিল ফাঁকা, সন্ধের পর বাড়ি থেকে ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে সঙ্গে সেই ধোবিখোলারও জলের ঝমঝম আওয়াজ পাওয়া যেত।
কলকাতায় আমাদের বাড়ি ছিল মৌলালির এস যেন ব্যানার্জি রোডে, বড় রাস্তার ওপর। ছোট থেকে আমরা কোনো গাছপালা কিছুই দেখিনি। ছাদ থেকে দূরে এক-আধটা গাছ কখনো দেখতাম। কার্শিয়াঙের প্রধান আকর্ষণ ছিল তাই নৈসর্গিক। মধ্য কলকাতায় বড় রাস্তার পাশে তৈরি সেই বাড়িতে বড় হতে গিয়ে একটু সবুজের জন্য মনটা আনচান করে উঠতো। কার্শিয়াঙের গাঢ় সবুজ পাইনের জঙ্গলে, হালকা ঠান্ডা হাওয়ার সেই অনুভূতি আর দিনের বিভিন্ন সময়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমুগ্ধকর রূপের আকর্ষণে মনটা নেচে উঠতে চাইতো। ছোটবেলায় অবশ্য ছুটি আর অবাধ খেলাধুলোর হাতছানি ছিল আমাদের বড় আকর্ষণ। আমাদের সাথে ভাইবোনেদেরই যথেষ্ট বড় দল তৈরি হতো। সঙ্গে থাকতো পাশের বাড়িরই শানু, বেদকুমারী, দুর্গা, আর অশোক, এরা সবাই।
বাড়ির পাশেই অনেকটা জায়গা নিয়ে ছিল বর্ধমান মহারাজার শিবমন্দির। শ্বেত পাথরের বড় বিগ্রহ, আর দুপাশে দুটো ছোট-ছোট মন্দির। একপাশের মন্দিরে পার্বতী, অন্যপাশের মন্দিরে হরপার্বতীর কোলে সিদ্ধিবিনায়ক গণেশের অবস্থান। মন্দিরের অন্যকোণে নারায়ণশিলা। বেশ কয়েকটিই শিলা ছিল সেখানে, তবে কোনটিতে নারায়ণের কি লক্ষণ আছে তা ছোটবেলায় কখনও জানার চেষ্টা করিনি। মহারাজার মন্দিরে দামোদর শিলাটি ছিল বেশ বড়রকমের। মন্দিরের যিনি পূজারী পুরোহিত তিনি পাঞ্জাবি ব্রাহ্মণ। সুপুরুষ ও নিষ্ঠাবান। ওনার স্ত্রী ছিলেন অপরূপা সুন্দরী ও মিষ্টভাষী। আমার মায়ের সাথে ওনার খুব ভাব ছিল। ওনাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের দাদা দিদিদের মতো মনে হতো। ওখানে গেলেই আমরা সবাই বেশ এক পরিবারের সদস্যের মতো থাকতাম। মন্দিরের একদিকে ভুট্টা চাষ করার জন্য ছোট্ট জমি ছিল। এছাড়াও ওদের বেশ কয়েকটা গরু আর বাজারে একটা ছোট্ট দোকানও ছিল। সব মিলিয়ে কষ্টের মধ্যেও এক আনন্দের সংসার। বড় সংসারে দোকানের দায়িত্ব ছিল বড় ছেলেদের উপর। তাদের দেখাশোনায়, কাজের দক্ষতায় ছোট্ট শহরে দোকানটা পরে বেশ চালু হয়েছিল। পরের দিকে সংসারের স্বচ্ছল অবস্থাও এসেছিলো। ছোট ছেলেমেয়েরা আমাদের খেলার সাথী ছিল। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন বেদকুমারী ও দুর্গার মা আমাদেরকে পা ধুইয়ে লুচি, সুজি আর গরুর দুধের চা খাওয়াতেন। পরে লাল রঙের ফিতে আর রুমাল হাতে দিতেন।
কার্শিয়াঙে সিনেমাহল পর্যন্ত মোটামুটি জমজমাট ছিল তখন, তারপরেই সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। থাকার মধ্যে ছিল কেবল বেশ কিছু পুরোনো মিশনারিদের স্কুল ও চার্চ, তারপরেই কার্শিয়াং কলেজ। গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে আমরা বিকেলবেলা হোসেনখোলা বলে একটা ঝর্ণা অব্দি হাঁটতাম। ঝর্ণাটা বেশ বড় মনে আছে, জলও থাকতো খুব। দুর্গাপুজোর সময় ঝর্ণাতে বড় বড় পাথর ফেলে জল আটকানো হতো ঠাকুর বিসর্জন দেওয়ার জন্য। সেই এক অসম্ভব অন্যরকমের অভিজ্ঞতা। দশমীর দিন স্থানীয় কুলিরা বড় বড় বোল্ডার ফেলে জল আটকাত। হোসেনখোলার যে জায়গাটা হিলকার্ট রোডের নীচ দিয়ে বয়ে যেত, সেই জায়গাটা একটা বড় (প্রায় ৮ ফুট বাই ১০ ফুট) ঘরের মতো ছিল। ওই জায়গাটাতেই বড় বোল্ডার ফেলে জল আটকানো হতো। একটা চৌবাচ্চার মতো হয়ে এলে পরে সেই ঝর্ণার দুরন্ত জলেই অতি সতর্কতার সাথে দশমীর দিনে হতো প্রতিমা নিরঞ্জন। আমাদের বাড়ির নিচে পাঙ্খাবাড়ি রোডে কার্শিয়াং রেডিও স্টেশন ছিল একেবারে ছবির মতো সাজানো। বাড়ির একতলায় দুজন রেডিও স্টেশনের ডিউটি অফিসার ভাড়া থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের আপনজনের মতো সম্পর্ক ছিল। ওনাদের জন্য আমাদের রেডিও স্টেশনের ভিতর অবধি দেখার সুযোগ হয়েছিল। বাড়ির ছাদের বাইরে উঁচু পাথুরে ঢিবিতে উঠলে পরে নীচের স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে কিনা দেখা যেত। সাধারণত দুপুরের দিকে এনজেপি থেকে ট্রেন কার্শিয়াঙে এসে পৌঁছতো, দার্জিলিঙে ট্রেন পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে যেত। দাদারা ট্রেনের আওয়াজ শুনলেই পাশের ঢিবিটাতে উঠে দেখতো, ৪টে টয়ট্রেনের মধ্যে কোনটাতেই বা মেলগাড়ির লাল বগিটা আছে। সেই ট্রেন দেখেই ওরা স্টেশনে ছুটে যেত কলকাতা থেকে চিঠি এসেছে কিনা দেখার জন্য। কত সালে সেটা মনে নেই, একবার চিঠি এলো কলকাতা থেকে।আমার বড়পিসিমার মৃত্যুসংবাদ নিয়ে। বাড়িতে একটা ইজিচেয়ার ছিল, বাবা দুপুরে ওটায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। খবরটা শুনে বাবা খুব কেঁদেছিলেন। বাবা খুব শক্ত মানুষ ছিলেন। আমি মাত্র ৩ বার তাঁকে কাঁদতে দেখেছিলাম।
পুজোর ছুটির সময় যখন কার্শিয়াং যেতাম তখন আমরা ছোটরা বাবা-মায়ের সাথে যেতাম। বড় দাদা-দিদিরা কলকাতায় থাকতো। মহালয়ার ভোরে, অন্ধকার থাকতে বাবা ধোবিখোলার উপরে গিয়ে তর্পন করতেন। দাদু ঠাকুমাকে খুব ভক্তি করতেন তিনি। বিশ্বাস করতেন বিপদে ওনারাই পথ দেখিয়ে দেবেন। এই বিষয়টা আমাদের মনেও ঢুকে গিয়েছিল। বাড়ির যে কেউই কোনো ভালো কাজে যাওয়ার আগে ঠাকুমার ছবিতে প্রণাম করে যেত। বাবা কার্শিয়াঙে তাঁর বাড়ির সামনে কসমস, গাঁদা, গোলাপ লাগাতেন। কদিনেই বেশ ফুল এসে যেত। বিশেষত কসমসের কথা খুব মনে পরে - হালকা বেগুনি রঙের ফুল ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটতো আর হাওয়ায় দুলতো। আমরা কার্শিয়াং থেকে চলে এলে ভাড়াটেরা লাউ আর কুমড়োর গাছ লাগিয়ে দিত, আর গ্রীষ্মে আমরা কার্শিয়াঙে ফিরে গিয়ে দেখতাম কসমস আর একটাও নেই। বাবা রেগে যেতেন। বলতেন এরা লাউ কুমড়ো ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। পুজোর সময় কার্শিয়াঙে থাকাকালীন বাবা মাঝে মধ্যেই একটা গান গাইতেন। কথাগুলো ছিল, “ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা …” বড় চেনা গান বোধহয় সকলেরই। বাবা বারবার করে গাইতেন “ভায়ের মায়ের এতো স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ,” এই লাইনটাই সবচেয়ে প্রিয় ছিল তাঁর কাছে। বাবা ভালো চা খেতে ভালোবাসতেন। ভোর থাকতে উঠে স্টোভে পাম্প করে চা করতেন। বাড়ির নীচেই একজনের বাড়িতে পাউরুটি তৈরী হতো। সেখান থেকে সকাল সকাল বান-পাউরুটি কিনে আনা হতো। সাথে থাকতো বাজার থেকে কিনে আনা ঘরে তৈরী মাখন। বড় বড় কুমড়ো পাতার মতো স্কোয়াশ পাতাতে করে বাবা সেই মাখন নিয়ে আসতেন। আমরা সকলে মিলে চা, বান-পাউরুটি আর মাখন খেয়ে পড়তে বসে যেতাম। দশটা বেজে গেলে তখন আর একটুও পড়তে ইচ্ছে করতো না। কোনো কোনো দিন বাবার সাথে বাজারে চলে যেতাম। নাহলে বাইরে এসে গাছের পাতা আর ধুলো-বালি দিয়ে পানসাজা খেলতাম। যোগ দিতো আমাদের পাশের বাড়ির বন্ধুরাও। বাড়ির সামনের ঢিবিটা যথেষ্ট খাড়া ছিল। তাই আমি মাঝে মধ্যেই দৌড়োতে গিয়ে পড়ে পা কেটে ফেলতাম। কলকাতায় ফিরলে তবে ওই কাটা জায়গাটা শুকোতো।
বেশিরভাগ আত্মীয়স্বজনরা আমাদের সাথে বেড়াতে আসতেন গ্রীষ্মকালে। এই এতো লোকের এতো আতিথেয়তা সামলাতো আমার সেজদিদি। রান্না করা, ঘর গোছানো, কোনো এমন কাজ নেই যা ও পারতো না। ভগবান যেন ওর উপরে ভর করতেন তখন। একা হাতে দশভুজার মতো সামলাতো সবকিছুই। মা কার্শিয়াঙে এলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচতেন, পুজো নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন মোটামুটি। শিবমন্দির গেলে অনেকক্ষণ পরে ফিরতেন। বড়দিও খড়্গপুর থেকে বাপের বাড়ি আসতেন। তারপর আমাদের কাছে চলে আসতেন দুই মেয়েকে নিয়ে। জামাইবাবু শেষের দিকে আসতেন একসপ্তাহের জন্য। ১৯৭২-৭৫এ কার্শিয়াঙে প্রতিটি ঝর্ণায় ভালো জল ছিল। কিন্তু শহরের জনসংখ্যার তুলনায় ছিল কম। সেই কারণে প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম জল আসত। বাবা-মা’ই শিখিয়েছিলেন চাল-ডাল ধোয়ার জল দিয়ে ঘরমোছা ও সেই ঘর-মোছারই জল পরে বাগানের গাছে দিতে। আমরা ভাইবোনেরা সকলেই বাবা-মায়ের শিক্ষায় পরিশ্রমী আর অল্পেতেই সন্তুষ্ট থাকতে শিখেছি। এরকম কিছু কিছু ব্যবস্থা সত্ত্বেও বাড়িতে জলের অসুবিধা হতো। গ্রীষ্মকালে সেই কারণে জামাকাপড় কাচা, স্নান করা ইত্যাদিতে বেশ অসুবিধে হতো। শিবমন্দির যেহেতু রাজবাড়ীর, সেহেতু ওদের আলাদা জলের লাইন ছিল। সারাদিন জল থাকতো সেখানে। আমরা কখনও কখনও কয়জন মিলে আমাদের সেই খেলার সাথীদের বাড়িতে গিয়ে জামাকাপড় কেচে নিয়ে আসতাম। বৃষ্টির সময় কার্শিয়াং এক অন্য রূপ নিতো। আমরা কখনওই বর্ষাকালে ওখানে যেতাম না। কিন্তু গ্রীষ্মের শেষদিকেও একেকসময় বৃষ্টি পড়তে শুরু করত। বৃষ্টি শুরু হলে ৬-৭ দিন অবধিও চলতো। চারিদিক কুয়াশায় ঘেরা থাকত তখন। অল্প আলো-আঁধারিতে দিন কেটে যেত, সাথে প্রচন্ড হাওয়ার দাপট। ঠাণ্ডার চোটে মনে হতো এইবারে কলকাতা ফিরে যাই। একেক সময়ে এত ঘন কুয়াশা হতো যে পাশের মানুষকে অবধি দেখা যেত না। এই অবস্থায় পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি নিয়ে চলা খুবই বিপজ্জনক ছিল। গাড়িরা দেখতাম সবসময় তখন হলুদ আর্গন লাইট জ্বালিয়ে চলেছে।
কার্শিয়াঙের বাড়িতে দোতলায় আমাদের দুটো বড় ঘর ছিল। ঘরের মেঝে কাঠের, শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য। বাড়ির সামনের দিকের ঘরটাতে খাওয়া দাওয়া করা হতো। একটা বড় গোল ডাইনিং টেবিল ও চারটে চেয়ার ছিল। ঘরের সামনের দেওয়ালটায় একটা বড় কাঁচের জানালা। সকাল বিকেল যে কোনও সময়ে বসেই আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেত! এ এক অপূর্ব সুখস্মৃতি - পাহাড়ের প্রতি আমার ভালোবাসা, আর কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রতি আমার আজীবন আকর্ষণ এই ঘরে বসেই তৈরী হয়েছিল। এই ঘরটার বাইরের দিকে একটা ছোট্ট বারান্দা ছিল। পাঙ্খাবাড়ির দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটা এইখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখা যেত। কখনো কোনও ল্যান্ডরোভার গাড়ি ওই রাস্তায় নিচে নামত আর আমরা উপর থেকে দাঁড়িয়ে গাড়িটার ছোট হতে হতে মিলিয়ে যাওয়া অবধি দেখতে পেতাম। বড় ঘরের পাশেই দুটো ছোট ঘর - এই ঘরগুলোতে আমরা পড়াশুনো থেকে শুরু করে খেলাধুলো অবধি সবই করতাম। গ্রীষ্মকালে গরমের ছুটিতে দল বেশ বড় হতো সেজন্য সুবিধে অসুবিধে দুটোই হতো কিন্তু খুব আনন্দও হতো। ওখানকার জল-হাওয়া এতটাই ভালো ছিল যে আমাদের খুব খিদে পেতো। আমরা ছোটরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম। কিন্তু মা দিদিরা রান্নাবান্না নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতো যে আমরা কিছু বলতে পারতাম না। বাবা আমাদের সব সময়ে বলতেন আস্তে চলা ফেরা করতে যাতে একতলায় কারোর অসুবিধে না হয়। আমার দিদির ছোট মেয়ে ছটফটে। বাবা যত খাট থেকে ওকে আসতে নামতে বলতেন, ও ততই লাফিয়ে লাফিয়ে নামত। সেই কারণে দাদুর কাছে বকুনিও খেত। পিয়ন এসে চিঠি দিলে নিজের বাবার (জামাইবাবুর) চিঠিটা সে নিয়ে নিতো আর পিয়নকে বাবার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলতো, ডাঃ জি সি নিয়োগীর চিঠিটা ওকে দাও। বাবা ওর কান্ড দেখে হাসতেন। দিদির বড় মেয়ে ছিল একেবারেই উল্টোধাঁচের। আমরা ১০টা বাজলেই বই ফেলে দে’ছুট, অথচ ওর পড়া আর কিছুতেই শেষ হতো না। আমরা ভাবতাম কি এতো পড়ে রে বাবা! বড় হয়ে সেই মেয়েই যখন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেলো তখন বুঝলাম কি মেয়ে ছিল সে।
কার্শিয়াঙের দিনগুলো ছিল নানারকম নাম জানা, অথবা না জানা জায়গায় পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর দিন। আমরা ছোটরা একবার সবাই মিলে স্যানাটোরিয়ামে গিয়েছিলাম আর সেখান থেকে ডাউহিল। কার্শিয়াং স্টেশন থেকে ডাউহিল হেঁটে যেতে ফিরতে সকালে বেরিয়ে ফিরতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। কত রাস্তা যে হেঁটে যেতে পারতাম, এখন ভাবলে অবাক লাগে। দাদারা একবার আমভুটিয়া গিয়েছিলো, ওখানে ছিল কমলালেবুর বাগান। পাঙ্খাবাড়ি থেকে নেমে ওই গ্রাম অবধি যেতে গেলে অনেকটা হাঁটতে হতো তাই আমরা কখনও যাইনি। পাঙ্খাবাড়ি রোড যেটা শিলিগুড়ি অবধি চলে গেছে, সেই রাস্তাতেই মকাইবাড়ি টি এস্টেট। দাদা-দিদিদের সাথে ওখানে গিয়ে একবার ওদের বিশাল কর্মকাণ্ড দেখার সুযোগ হয়েছিল। চা-বাগান থেকে মহিলারা বড়বড় ঝুড়িতে চা পাতা তুলে আনছে, আর সেই চা পাতা বিরাট বিরাট ট্রেতে ঢালছে। ট্রে’গুলোর তলায় জাল দেওয়া। তারপর ওই ট্রে বেল্টের সাহায্যে এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পরের ধাপ অবধি। তলা থেকে একটা হিটারের মতো জিনিস থেকে ক্রমাগত তাপ দেওয়া হচ্ছে। পাতাগুলো অল্পঅল্প কুঁকড়ে যাচ্ছে আর এইভাবে পর পর আরও এগিয়ে যাচ্ছে। বেশি সুগন্ধযুক্ত চায়ের পাতা চটপট তুলে নিয়ে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে, সে এক দেখবার মতো জিনিস। কত ছোটবেলায় দেখেছি তাই কটা ধাপ আজ আর মনে নেই শেষ পর্যন্ত। মোটকথা, যতগুলো ধাপ এগোয়, চায়ের বিশেষত্ব ততই প্রকাশ পায়।
শিবমন্দিরের আশেপাশে প্রচুর ফুলের গাছ ছিল। ওই ঠান্ডায় গন্ধরাজ খুব হতো, গাঁদা, গোলাপ, পাহাড়ি ফুল তো আছেই। স্কোয়াশ গাছ ছিল বেড়ার ধারে ধারে, কোনো যত্নের দরকার হতো না - প্রচুর স্কোয়াশ হতো। বাড়ির পাশে যে একটু উঁচু মতো ফাঁকা জায়গাটা ছিল ওখানে উঠে দাঁড়িয়ে আমরা অনেক সময় কাটাতাম। বিশেষত দুপুরের সময় ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধোবিখোলার ঝর্ণা দেখা হতো, এক এক করে নিচের স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কমলা লেবু খাচ্ছি। তখন কতটা আনন্দ হতো এখন আর মনে পড়েনা। কিন্তু এই ছবিগুলো এখন ভাবতে খুব ভালো লাগে। পুজোর সময় বেলা ছোট হতো তাই আমরা বিকেলে সেরকম বেরোতাম না। আমাদের শোওয়ার ঘরের জানলা দিয়ে রেডিওস্টেশনের ট্রান্সমিটার দেখা যেত - পশ্চিমের আকাশ লাল করে সূর্য অস্ত যেত আর তার নিচে পাঙ্খাবাড়ির রাস্তাটা এঁকে বেঁকে নেবে নেবে চোখের আড়াল হয়ে যেত। সারাটা বিকেল ধরে পাহাড়, রাস্তা আর আকাশ দেখতাম, সে ছবি এখনো চোখে ভাসে খুব স্পষ্টভাবে।
বাবা কার্শিয়াঙে বেশ কয়েকবার বিলেতে ওনার নিজের দেখা ভূতের গল্প বলেছিলেন। ওখানে বাবা যে হাসপাতালে পড়াশোনা করে কাজ করতে শুরু করেছিলেন সেই জায়গাটা ছিল একটা পাহাড়ের উপর। একদিন কাজ করে বেরোতে অনেক রাত হয়ে গিয়ে ছিল ফলে হেঁটেই ফিরছিলেন হোস্টেলে। পথে একটি গোরস্থান পড়তো। সেই সন্ধেবেলা বাবা হঠাৎ দেখেন কবরস্থানের ভেতর থেকে একটা টুপি মাথায় লোক গেটের কাছে আসছে। বাবা খুব সাহসী ছিলেন, কিছুই মনে করেননি। তিনি নিজের রাস্তায় হাঁটতে থাকলেন। পাহাড়ি পথ, হাঁটতে হাঁটতে বাবা খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন অনেকটা হাঁটার পর কেমন করে যেন আবারও সেই কবরস্থানের কাছেই এসে পড়েছেন। ভাবছেন কি করে রোজকার চলার পথ এমনি করে ভুল হয়ে যায়, এরকম ভাবতে ভাবতে দেখছেন যে আবারও ওই একই রাস্তায় পাক খাচ্ছেন! এবারে বাবার একটু একটু করে ভয় করতে শুরু করেছে - ততক্ষণে গেটের ভিতর দিক এগিয়ে আসা লোকটা আরো খানিকটা সামনের দিকে এসে গেছে। এই সময়ে রাস্তায় একটা মোটরগাড়ি যাচ্ছিলো - বাবা হাত দেখিয়ে তাঁদের দাঁড়াতে অনুরোধ করেন, এবং বলেন পাহাড়ের উপরে ওনার হোস্টেল অবধি পৌঁছে দিতে। তারা রাজি হওয়ায় বাবা ওই গাড়িতে উঠে পড়েন। কিছুক্ষণ পরে নাকি ওই গাড়িটাও একই রকমের একটা পাকের মধ্যে পড়ে যায়। গাড়ির চালক সাহেব ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী কিছুই বুঝতে পারছেন না। এটা কেমন করে হলো। বাবা তখন একটু আগের ঘটনা ওনাদের বলেন। ভেতরের টুপি পরা লোকটা তখনও প্রায় গেটের সামনে অবধি এসে গিয়ে টুপি দুলিয়ে ওঁদের সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে! এবারে এঁরা সকলে মিলে ঠিক করেন যে, সকলেই একসাথে মনের জোর করে এই অবস্থা থেকে বেরোতে হবে। পাহাড়ের যে রাস্তাটায় ওরা পাক খাচ্ছেন তার থেকে একটুখানি এগোলেই একটা জায়গায় রাস্তাটা দুভাগ হয়ে যায়। একটা রাস্তা উপরের দিকে উঠে যায়, আর অন্যটা নীচের দিকে চলে আসে। রাস্তার এই সংযোগটায় এসেই - তিনজনে একমনে খুব সজাগ হয়ে উপরের দিকের রাস্তাটায় উঠে পড়ে সেই যাত্রায় ভূতের হাত থেকে রক্ষা পান! রাত্রে ঘর অন্ধকার করে সবাই মিলে শুয়ে পড়তাম যখন, এই গল্প বাবা আমাদেরকে সেই সময় বহুবার শুনিয়েছেন। আমরা ভয়ে একেবারে গুটিয়ে থাকতাম। একবার বাবা আমাকে আর বয়সের দিক থেকে আমার ঠিক উপরকার দিদিকে সঙ্গে নিয়ে পাঙ্খাবাড়ির দিকে হাঁটতে গিয়েছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে পাঙ্খাবাড়ির রাস্তায় যেখানে কবর দেওয়া হতো সেইদিকে যেতে যেতে এই গল্পটা বাবা আবারও বলেছিলেন। আমাদের দুই বোনেরই এতো ভয় করেছিল যে আমরা দুজনে মিলে বাবার কোটের দুদিকে দুটো করে হাত ঢুকিয়ে চলেছিলাম - পাছে ভূত এসে ফস করে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে যায়! বাবা এদিকে আর হাঁটতে পারছেন না, সেদিকে তখন আমাদের থোড়াই কেয়ার।
আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ। পুজোর সময় ওখানে ছোট করে দুর্গাপুজোও হতো। দার্জিলিং, কার্শিয়াং আর শিলিগুড়ির তিনটে মঠ ছিল বেদান্ত মঠের অধীনে। কার্শিয়াঙে ৩জন মহারাজ থাকতেন। বড় মহারাজের নাম ভুবন মহারাজ, উনি ৩টে মঠেরই দেখাশোনা করতেন। ডাক্তার মহারাজ হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিতেন। কার্শিয়াঙের অনেক লোক ওনার কাছে এসে ওষুধ নিয়ে যেত, আমরাও ছোটোখাটো কোনো অসুখে ওনার ওষুধ খেয়েছি; আর ছিলেন ভক্ত মহারাজ, খুব শান্ত, মুখে সব সময় হাসি। খুব নিষ্ঠা করে পুজো করতেন। মঠে মহারাজেরা নিজেরাই ঠাকুর বানাতেন আর আমাদের দাদাদের কখনও-সখনও সুযোগ দিতেন রং তুলি এগিয়ে দেওয়ার। ওরা ঘন্টার পর ঘন্টা গিয়ে বসে থাকতো ঠাকুর রং করা দেখতে। স্টেশনের আগে ধোবিখোলায় ঝঁর্ণার জলে কলাবৌ স্নান করিয়ে নিয়ে আসা হতো। পুজোর দিনে মা গিয়ে পুজোর জোগাড় করে দিয়ে আসতেন। কার্শিয়াং মঠে রামকৃষ্ণদেবের যে ছবি ছিল সেটা ফ্রাঙ্ক ডোরাকের আঁকা প্রতিকৃতি। কলকাতায় বেদান্ত মঠে আমি ফ্রাঙ্ক ডোরাকের স্বহস্তে আঁকা ঠাকুর ও মায়ের দুটি পোর্ট্রেট দেখেছি বড় হয়ে। মঠের লাগোয়া মিশনের স্কুল। ক্লাস ফোর পর্যন্ত ছেলে মেয়ে উভয়েরই আর ক্লাস টেন অবধি কেবল মেয়েদের স্কুল। ভুবন মহারাজ স্কুলে আসতেন দেখাশোনা করতে - সোজা, চটপটে, দৃঢ় পায়ে হেঁটে যেতেন। ১৯৭৮ বা ’৭৯ সালে মা’কে নিয়ে কলকাতার বেদান্ত মঠে গেছি, হঠাৎ দেখি ভুবন মহারাজ! উনি দেখা মাত্র চিনতে পেরে জিগ্যেস করেছেন আমার বড় আর মেজদিদির কথা। মা হঠাৎ ওনাকে দেখে পাথর - আনন্দে কথা বলতে পারছেন না। শুধু প্রণাম করলাম, কিছুই দেওয়া হয়নি সেদিন, দেওয়ার কথা মনেও পড়েনি। একবার ফেরার আগে মা ও বাবা মঠের মহারাজদের দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছিলেন। মহারাজদের জন্য রান্না হচ্ছে, আমার সেজদাদা কাঁচের বাসনপত্রের বড় ঝুড়ি উপর থেকে নামাতে গিয়ে বাসনপত্র সমেত মই থেকে পড়ে গেলো। সব বাসনপত্র ভাঙলো, পাশে উনোনে রানা হচ্ছিল। সে এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। কার্শিয়াঙেই আমার সেজদাদার আরেকবার ভয়ঙ্কর ফাঁড়া গেছে - দড়িতে লেপ কম্বল রোদে দিতে গিয়ে লেপসুদ্ধ একতলায় পড়ে গেছিলো! বাঁ হাতের ছোট আঙ্গুলটা এমন চোট লেগেছিলো, এখনো আঙ্গুলটা বাঁকা।
পুজোর সময় একবছর উত্তরবঙ্গে অসম্ভব ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল ৭দিন ধরে। আমাদের বাড়িটার যেহেতু আশেপাশে কোনো বাড়ি ছিল না সেই কারণে ঝড়বৃষ্টি যেন বাড়িটার উপরে আছড়ে পড়েছিল। বাবা ঘুমোতে পারতেন না, শুধু পায়চারি করতেন আর মহাদেব-নারায়ণকে ডাকতেন। ৭দিন পর যেদিন অল্প রোদ উঠলো আমরা ঘরের বাইরে এলাম, চারপাশে তাকিয়ে দেখছি সারাটা পাহাড়ের গায়ে কে যেন আঁচড় কেটে দিয়েছে। হিলকার্ট রোডেই এতো ধস নেমেছিল যে যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। শিলিগুড়ি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, ফলে বাজারেও খুব সামান্য জিনিস আর চড়া দাম। বাবা খুবই চিন্তায় ছিলেন আমরা কিভাবে নামবো। শেষ পর্যন্ত আমরা একটা লরিতে চেপে নেমেছিলাম। সারা রাস্তায় প্রকৃতির তাণ্ডব দেখতে দেখতে মন খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গয়াবাড়ির কাছে একটা বাড়ি দেখেছিলাম, ঠিক যেন দেশলাইয়ের বাক্স। বাড়িটার বাইরের দেওয়ালগুলো লেগে আছে পাহাড়ের গাঁটে, নিচের তলাটা পুরো ধসে নেমে গেছে – হয়তো বা বাড়ির লোকেরাও ঘুমন্ত অবস্থায় তলিয়ে গেছে খাদে! অনেক বছর পর কেদারনাথের ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার পর এই পুরোনো স্মৃতি আমার বারবার মনে পড়ছিলো।
বাবা যখন কার্শিয়াং থেকে ফিরতেন, ট্রেন থেকে যতদূর পর্যন্ত বাড়িটা দেখা যায়- একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতেন আর বর্ধমান মহারাজার শিবমন্দিরের মহাদেবকে ডাকতেন বাড়িটাকে রক্ষা করার জন্য। কলকাতায় চলে এলে ঘরের চাবি থাকতো অন্নদা চক্রবর্তী নামে এক বয়স্ক মানুষের কাছে। আমরাও অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করতাম আরেকটা দারুণ ছুটির। কলকাতায় বাড়ির বাধানিষেধ পার করে, নির্মল প্রকৃতির মাঝখানে, বন্ধুদের সাথে লম্বা চড়ুইভাতির মতো আরো কয়েকটা রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের। সেই সব দিনের কথাই মনে পড়ছে আজ।
সবশেষে লিখব আমাদের জীবনে সব থেকে বড় আঘাতের কথা। বাবা আমার মেজদিদির একটি অপারেশনের পর তাকে নিয়ে কার্শিয়াঙে গিয়েছিলেন। আমি দাদাদের সাথে শিয়ালদায় দার্জিলিং মেলে বাবাকে আর দিদিকে তুলতে গিয়েছিলাম। মনে পড়ে বাবা উপরের বার্থে বসে, দিদি নীচে। বাবা দিনে দু’চারটি করে পান খেতেন। সেই কারণে একটা পানের কৌটোতে দু’চারটি করে বাড়িতে সাজা পান সবসময় রাখা থাকত। বাবা দিদির কাছে উপরের বার্থ থেকে হাত নামিয়ে একটা পান চেয়ে মুখে দিয়ে দাদাদের বললেন, “তোদের আর চিন্তা নেই। আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিস, আমি এন জে পিতে নেমে গাড়ি করে কার্শিয়াং চলে যাব।” কারণ ১৯৭৫ সালে তখন ফরাক্কা ব্যারাজ হয়ে গিয়েছে। বাবা প্রথম ফরাক্কা সেতুর উপর দিয়ে গেলেন, চিরকালের জন্য সেই যাত্রা। ১৯৭৫ সালের ৭ই বৈশাখ ভোরে বাবার হঠাৎ হার্ট এ্যাটাক হয়। দিদিকে নাকি বলেছিলেন, আমাকে এই ওষুধ দে, কোরামিন দে, গন্ধক গরম কর ইত্যাদি; আরও বলেছিলেন, আমি যদি চলে যাই আমাকে তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাস। সকাল ৭টা ১৫মিনিটে বাবা চলে গেলেন। পাঙ্খাবাড়ি চার্চ থেকে বাবার শরীরের আকারে কফিন বাক্স তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। কার্শিয়াং স্টেশনে যখন বাবার দেহ নিয়ে জিপগাড়ি এসে দাঁড়ায় তখন বাজারের সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে সমস্ত সাধারণ মানুষ ছোট ছোট সিল্কের কাপড় দিয়ে বাবাকে তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। রাত আড়াইটেয় কলকাতার তালতলার বাড়িতে যখন বাবার দেহ এসে পৌঁছল, অবাক চোখে দেখেছিলাম সমস্ত জিপ ভরে রয়েছে সেই দুই হাত মাপের ছোট ছোট সাদা সিল্কের কাপড়।
[সংগ্রাহকের কার্টেন কলঃ এই লেখার প্রথাগত শুরু বা প্রথাগত শেষ নেই। এই লেখা আদতে ক্যালাইডোস্কোপ। রঙিন কাচের জাফরিতে আলো ফেলে যাওয়া নকশা-কাটা পুরনো দিনের হদিশ। যে সময়ে পাহাড়, কুয়াশা, প্রতিবেশী বন্ধুরা, অথবা সবুজ ঘন পাইনবন – কেবলই স্মার্টদুনিয়ার দেওয়ালচিত্র হয়ে পড়তে পারেনি। বাস্তবেও তার অস্তিত্ব ছিল। অনুভব করা যেত সেগুলিকে তখন। এই সব ছবি, গল্প, গান আর সুরেলা বিকেল ডায়েরির পাতা বেয়েই যখন উঠে আসতে চায় সেগুলিকে সংগ্রহ করে নিতে হবে। কুড়িয়ে রাখতে হবে সেই অল্প সেঁকে নেওয়া সুগন্ধি চায়ের পাতাগুলিরই মতো করে, পরম আদরে, রোদ্দুরের ভাঁজগুলোয়। আজ যখন বিনাশের দাপটে দেবভূমির যোশীমঠে অন্তিম বিপর্যয় নেমে এসেছে, এই লেখা পড়ে আমরা যেন সেই সবুজাভ কার্শিয়াংকে অনুভব করতে পারি। বুঝতে পারি গাছেরাও সেখানে কথা বলছে। মাটিকে মাটিরই মতো থাকতে দেওয়া উচিত। স্পর্শ করলে তারও বোধ করি প্রাণের অস্তিত্ব টের পাওয়া চলে… নীরব হয়ে থাকি তখন।]