দোঁহা

একা গানের তরী: নিঃসঙ্গ সম্রাট অতুলপ্রসাদ


অরুন্ধতী দাস

সময়টা উনিশ শতকের নয়ের দশক। ভেনিস থেকে জাহাজ পাড়ি জমাচ্ছে দূর বিদেশের ডাকে। পাশেই, একটু তফাত রেখে ইতিউতি ভাসছে কখানি গন্ডোলা। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া সুরের মায়া হাওয়া বেয়ে পৌঁছে যাচ্ছে জাহাজের নির্জন ডেকে, চুপ করে বসে থাকা এক বিদেশি যুবার কানে। সুরের নেশায় বুঁদ হয়ে অন্ধকার জলের ওঠাপড়া দেখতে দেখতে তার দুচোখ যেন অশ্রুজলের নদী! সেই কবে ফেলে আসা ঢাকার কথা, অভিমানে দূরে ঠেলে দেওয়া মায়ের কথা, কলকাতায় মামারবাড়িতে বড়ো হয়ে ওঠার দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর। সেই সঙ্গে মনের মধ্যে মুচড়ে উঠছে পরাধীন দেশের মাটিটুকু ছুঁতে চাওয়ার প্রাণপণ আকুলতা... কবে আবার স্বপ্নের দেশ জেগে উঠবে মূর্ছা ভুলে? অচিরেই সেই গন্ডোলাবাহকের সুরে সুর মিলিয়ে আনমনে গেয়ে উঠলেন তিনি "জননী গো লহ তুলে বক্ষে, সান্ত্বনবাস দেহো তুলে চক্ষে, কাঁদিছে তব চরণতলে,  ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো!"

গানের কলিটি পড়েই নিশ্চয় পাঠকরা বুঝে ফেলেছেন, আমি এতক্ষণ কার কথা বলছিলাম? হ্যাঁ, তিনি অতুলপ্রসাদ সেন। গত কুড়ি অক্টোবর পূর্ণ হল তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ।

গানের জগতের এক আশ্চর্য নিঃসঙ্গ সম্রাট বলা যায় তাঁকে। রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুলগীতির সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা গানের জগতে অন্যতম শক্তিশালী যে তিন গীতিকারের ত্রিমুখী ধারা, তাঁরা অবশ্যই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন এবং অতুলপ্রসাদ সেন।

সংগীতপ্রিয় বাঙালির কাছে অতুলপ্রসাদের গান তার নিজস্ব ঐশ্বর্য নিয়ে ফিরে এসেছে বারবার। তাঁর গান শুধু নয়, তাঁর 'উত্তরা' পত্রিকা, রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে গড়ে তোলা 'খামখেয়ালি সভা'র অসামান্য সৃষ্টি— এই সব নিয়েই তিনি খ্যাতির শীর্ষ ছুঁয়ে থেকেছেন। কিন্তু এর অন্তরালে রয়ে গেছেন যিনি, তাঁর জীবন কিন্তু বিতর্কের বহুভারে অবনতপ্রায়। লখনউয়ের রাতে মেহফিলও শান্তি দিতে পারেনি এই চির অশান্ত, ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষটিকে।

শৈশব থেকেই কিন্তু বিতর্ক তাঁর সঙ্গী। বাবা রামপ্রসাদ সেন ছিলেন ঢাকার মনোচিকিৎসক। চাকরি করতেন পাগলাগারদের ডাক্তার হিসেবে। কিন্তু পাগলের ডাক্তার নয়, বরং পাগল ডাক্তার হিসেবেই প্রতিবেশী মহলে তাঁর পরিচিতি ছিল বেশি। আর সেই সূত্রে ছেলে অতুলপ্রসাদ ছিলেন পাগল ডাক্তারের পাগল ছেলে। ব্রাহ্ম রামপ্রসাদ বিবাহ করেছিলেন ব্রাহ্ম আচার্য কালীনারায়ণ গুপ্তর কন্যা হেমন্তশশীকে। পিতা এবং মাতামহর কল্যাণে, একেবারে ছেলেবেলা থেকেই ব্রাহ্মমুহূর্তে ব্রহ্মসংগীত গাওয়ার রীতিটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে অতুলপ্রসাদের।কিন্তু পিতার অকালমৃত্যু অচিরেই তাঁর বদলে দেয় তাঁর শৈশবের দৃশ্যপট। তিন দিদি হিরণ্ময়ী, কিরণময়ী, প্রভাবতীর সঙ্গে কলকাতায় মামারবাড়িতে থাকাকালীন তাঁর মায়ের সঙ্গে পরিচয় হয় কলকাতার এক প্রগতিশীল আইনজীবী, দুর্গামোহন দাসের। দুর্গামোহনের স্ত্রী প্রয়াত, পুত্রকন্যারাও প্রতিষ্ঠিত এবং নিজের নিজের সংসারে নিমজ্জিত। দুর্গামোহন কলকাতার রক্ষণশীল সমাজে ইতিমধ্যেই একবার যথেষ্ট আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন তাঁর বিধবা বিমাতার পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা করে। এরপর সমাজের সঙ্গে প্রতিকূল আর-এক যুদ্ধে তিনি সঙ্গী করে নিলেন অতুলপ্রসাদের মা হেমন্তশশীকে, শর্ত একটাই, নাবালক পুত্রকন্যাদের প্রতিপালন। এই দুর্গামোহনেরই ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। তৎকালীন সমাজে দাঁড়িয়ে এই দুঃসাহসী বিবাহ করার ফল হিসেবে এই দম্পতিকে যে কী পরিমাণ নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল, তার সামান্য বর্ণনা অবশ্য পাওয়া যায় শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' গ্রন্থে।

একটি বিবাহ নিয়ে প্রায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাওয়া সামাজিক টানাপোড়েনের জের অতি স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে অতুলপ্রসাদের এতদিনের শান্ত, নিস্তরঙ্গ পরিবারজীবনেও। মায়ের ওপরে খানিক অভিমানবশেই কিশোর অতুলপ্রসাদ থেকে যান মামাদের কাছে।

অথচ জীবন কী আশ্চর্য মধুর এক প্রতিশোধ নিল উলটো পথে। সমাজবিরুদ্ধ যে বিবাহ করার কারণে একদিন তাঁর অবুঝ মন বিরূপ হয়ে উঠেছিল তাঁর এত আদরের মায়ের প্রতি, সেই একই রকম সমাজনিষিদ্ধ বিবাহের সন্ধিতে বাঁধা পড়ল অতুলপ্রসাদের নিজের জীবনও। উচ্চশিক্ষার শেষ ধাপে এসে, ব্যারিস্টার হবেন বলে যখন বিলেতে বড়োমামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তর কাছে থেকে পড়াশোনা করছেন অতুলপ্রসাদ, তখন মামাতো বোন হেমকুসুমের সঙ্গে প্রেমের কারণে আরও একবার ভয়াবহ সামাজিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন তিনি। বিলেত থেকে ফিরে কলকাতার নামজাদা ব্যারিস্টার সত্যপ্রসন্ন সিংহের সহকারী হিসেবে সদ্য নিজের পসার জমাতে চাইছেন, যদিও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও তখন তাঁর খুব একটা অনুকূলে নয়। চারদিকে এইরকম বিরূপ পরিস্থিতিতে জর্জরিত অতুলপ্রসাদ শেষপর্যন্ত তাঁর হিতৈষী সত্যেন্দ্রপ্রসন্নর পরামর্শেই হেমকুসুমকে নিয়ে চলে গেলেন স্কটল্যান্ডের গ্রেটনা গ্রিনে। এদেশের আইনে অসিদ্ধ বিবাহকেও আইনত সিদ্ধ পরিণয়ের তকমা দিতে। কিন্তু এত শ্রম আর লড়াই করেও শেষপর্যন্ত তাঁর দাম্পত্যপ্রেম নিষ্কণ্টক হয়নি।

বিয়ের পরে কলকাতায় ফিরে এসেও আইনব্যাবসায় সুদক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি অতুলপ্রসাদ। দুই যমজ পুত্র দিলীপকুমার নিলীপকুমার এবং স্ত্রী হেমকুসুমকে নিয়ে সুখী গৃহকোণের মায়াস্বপ্নটি ভাগ্যের তাড়নায় অধরাই রয়ে গেল তাঁর। উপরন্তু, তাঁর সংগীতময় আত্মগত জীবনটিকে যথার্থ উপলব্ধি করাও সম্ভব ছিল না বাইরের কারোর পক্ষে। সংসারের আগল তিনি সেধে দুহাতে তুলে নিয়েছেন, কিন্তু সেখানে বদ্ধ হয়ে থাকার প্রাণ তো তাঁর নয়! পদে পদে তাঁকে ভুল বুঝতে থাকল পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন। শৈশব থেকেই পিতার পেশার সূত্রে 'পাগল' অপবাদ মাথায় করে নিয়েছিলেন, এখন তাঁর খেয়ালি মনের অশান্ত প্রকাশকে কেউ ভাবল বাউন্ডুলেপনা, কেউ মনে করল একগুঁয়ের জেদ!

একে একে মুখ ফিরিয়ে নিল সবাই। অর্থকষ্টে পড়ে পথ্য জোগাড় করতে না পারায় সামান্য জ্বরে হারালেন কোলের ছেলে নিলীপকুমারকে। ভগ্ন মনে, তুমুল অভিমান সঙ্গী করে চলে এলেন লখনউতে, বন্ধু মমতাজ হোসেনের পরামর্শে।

এক সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকায় এইবার দেখা গেল অতুলপ্রসাদকে। আইনি কাজের সুবিধার্থে উর্দু শিখলেন তিনি, শহরের বিদ্বজ্জনদের সঙ্গেও পরিচপ্য হল। একের পর এক মামলায় অভাবনীয় সাফল্য তাঁকে খ্যাতি তো এনে দিলই, সেই সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন নানান লোকহিতকর কাজে। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা থামানো, গোমতী নদীর বন্যায় দুর্গতদের জন্য গান গেয়ে ত্রাণসংগ্রহ, হরিজন সমাজের উন্নয়নে কাজ, কাশীতে বিধবা আশ্রম প্রতিষ্ঠা—কী না করেছেন তিনি! তাঁর চেম্বার নিত্যদিন ভরে থাকত সহায়প্রার্থী, আশ্রয়প্রার্থী মানুষের ভিড়ে, বিমুখ হয়ে যেত না কেউই। ক্রমশ লখনই শহরের শ্রেষ্ঠ ব্যারিস্টার হয়ে উঠলেন জনপ্রিয় 'সেনসাহেব'! জীবিতাবস্থাতেই তাঁর নামে নামাঙ্কিত রাস্তা তৈরি হল, এমন জীবন্ত কিংবদন্তি ছিলেন তিনি! ভাগ্য পরীক্ষার এই দ্বিতীয় পর্ব অর্থনীতির দফতরে সফল হলেও এই পর্বেই সবচেয়ে বেশি ছিন্নভিন্ন হয়েছে অতুলপ্রসাদের ব্যক্তিজীবন। মাতৃস্নেহপিপাসু অতুলপ্রসাদ লখনউতে মাকে নিজের কাছে এনে রাখতে চাওয়ায় এই সময়ে জোরালো সংঘাত তৈরি হয় দুই প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী নারী হেমন্তশশী এবং হেমকুসুমের মধ্যে। এমনকি,  যে প্রেমের জন্য প্রতিকূলতার শিখর পর্যন্ত ছুঁতে দ্বিধা করেননি, সেই স্ত্রীর সঙ্গেও চিরতরে বিচ্ছেদ হয় অতুলপ্রসাদের। ক্রমশ নিজেকে ডুবিয়ে দেন সুরের সাধনায়... দিনের আইনি হইহট্টগোল মিটতে না মিটতেই রাতের মজলিশ আর মেহফিলের আলো জ্বলে ওঠে। নবাব আলি মহম্মদ খলিফ খাঁ, বরকৎ উল্লাহ, ছোটে মুন্নে খাঁ, তবলিয়া বীরু মিশ্র ...  কে নেই সেখানে?
শুধু শেষরাত্রে আকুল হৃদয়ের একাকীত্বকে সঙ্গী করে চলে একের পর এক বুক নিংড়োনো গানের সাধনা...নীরব মনের নিভৃত উচ্চারণ... পাগলা মনটারে তুই বাঁধ।


কিন্তু এই পরিশ্রম আর অত্যাচার শরীর সইবে কেন? অচিরেই আক্রান্ত হলেন উচ্চ রক্তচাপজনিত অসুখে। তখনও পর্যন্ত এ রোগের চিকিৎসা এদেশে বিরল। পাহাড়ে, সমুদ্রে বারবার জলবায়ু পরিবর্তন করলেন তিনি। তবু শান্তি পেলেন না, স্বাস্থ্যোন্নতিও হল না তাঁর। এ যেন তাঁর মনের কথা, "যাব না যাব না যাব না ঘরে, বাহির করেছে পাগল মোরে"। শেষে মাত্র তেষট্টি বছর বয়সে আগস্ট মাসের এক মধ্যরাতে লখনউতেই জীবনাবসান হল তাঁর।

বাংলা গানের মুকুটহীন এই নিঃসঙ্গ সম্রাটের কাহিনি মনে করে কোনো বাংলাভাষী মরমি মানুষের মনে যদি এতটুকুও বেদনা জেগে ওঠে, সারাজীবন শান্তির খোঁজে পাগলপারা হয়ে ছুটে বেড়ানো অতুলপ্রসাদের জন্য যদি দু-ফোঁটা অশ্রু কখনও আনমনেই ঝরে পড়ে, তবে আজও হয়তো শুনতে পাওয়া যাবে সেই গান— কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে, হৃদি মোর উঠল কাঁপি চরণের সেই রণনে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন