অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
“বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভালো, ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়”–
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পূর্ব পাকিস্তান। সাল ১৯৫২। ওপারের মালদা জেলা থেকে এপারে ঢুকে এসে মহানন্দা নদীর জল ফুলে উঠে বয়ে গিয়েছে এই শহরের ধার ঘেঁষেই। তখন ফেব্রুয়ারির বিকেল। অল্প অল্প গরম পড়তে শুরু করেছে। নদীর পাড়ে এসে বসেছিল দুইজনায়। নূর আর টিয়া। টিয়া আর নূর। টিয়ারা খুব শিগগিরই ইণ্ডিয়ায় চলে যাবে। নূরের মন খারাপ। নূরের বয়স এগারো। টিয়ার বয়স আট বছর তিন মাস। টিয়ার বাবা শিক্ষকতা করেন। নূরের বাবা চালকলের মালিক। দুজনেতে খুব ভাব। টিয়া গান করে। নূর ওকে দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে মেলা বসলে পরে রঙিন খেলনা কিনে এনে দেয়। এনে দেয় রঙচঙে বই। টিয়ার বাবা চান টিয়া অনেক দূর অবধি পড়ুক। পড়ার নেশা তৈরি হোক। নূরের পড়াশোনায় মন কম। কিন্তু টিয়ার জন্য নতুন বই এনে দিতে ওর ভালো লাগে। টিয়া ওকে গল্প পড়ে শোনায়। নূর জিজ্ঞেস করছিল।
-“কলকাতায় গিয়ে আমার কথা মনে পড়বে তোর?”
কুলের বিচি চুষতে চুষতে টিয়া জবাব দেয়, “মনে পড়বে না আবার! দেখিস তুই, প্রতি সপ্তাহে একখানা করে চিঠি পাবি।”
-“সত্যি বলছিস?”
-“সত্যি না তো কি মিথ্যে বলছি নাকি আমি?”
-“ঠিকানাটা লিখে নিয়েছিস তো ভালো করে? হারিয়ে ফেলবি না তো?”
-“একটুও না। খুব সাবধানে আমার ডায়েরির ভিতর গোটা গোটা অক্ষরে নিজে হাতে লিখে রেখে দিয়েছি।”
-“যাক, নিশ্চিন্ত হলাম।”
টিয়া ফিক করে হেসে ফেলে এবার।
-“কেমন গম্ভীর হয়ে বললি রে তুই! নিশ্চিন্ত হলাম!” হি হি করে সে হেসে ওঠে। নূর চোখ পাকায়।
-“আমার ঝাঁপাই জুড়তে ইচ্ছে করছে খুব,” নূর আড়মোড়া ভাঙে।
-“এই বেলা শেষের সময় তুই নদীতে নামবি নাকি? ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি। আমি কিন্তু বাড়ি ফিরেই বলে দেব বাবাকে যে, তুই জলে নেমেছিলিস। এখনও শীত কাটেনি।”
-“ভারী তো শীত, আর তেমনি তুই নাইলশেকুটি হয়েছিস। আমার গরম লাগছে। যা গিয়ে যত পারিস নালিশ কর গে যা!” নূর গায়ের ফতুয়াটা খুলে ফেলে। আদুল গায়ে রোদ পড়ে চকচক করে ওঠে হঠাৎ। ছুট্টে এসে সে জলে ঝাঁপ দেয়। প্রথম ফাল্গুনের নরম রোদ জলের উপরে পড়ে পিছলিয়ে যেতে থাকে। নূর ডুবসাঁতার দেয়। অনেকক্ষণ।
টিয়ার একটু একটু ভয় করতে থাকে। এতখানি সময় ধরে কখনও সে নূরকে জলে ডুবে থাকতে দেখেনি। গোধূলির লাল রঙ রক্তের মতো হয়ে নদীর উপরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সে চিৎকার করে উঠতে যাবে, ঠিক এমনি সময়েতেই মাঝনদীতে প্রায় ভুস করে শুশুকের মতোই মাথা তোলে নূর। দাঁত বের করে সে হাসছে। টিয়া প্রায় রেগেমেগেই চিৎকার করে ওঠে। নূর পাড়ের দিকে সাঁতরে চলে এসেছে। ওর চোখদুটো চকচক করে।
-“একেবারে জমি ছুঁয়ে এলাম রে! দেখ কি পেয়েছি তোর জন্য; আর তো আসবিও না কোনওদিন। নে হাত পাত দেখি,” ভেজা শরীরে টিয়ার হাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় নূর।
-“আসব না কে বলেছে তোকে শুনি? আমরা কি পর হয়ে গেলাম নাকি?” টিয়ার গলায় তখনও রাগ। সে জোর করে হাত মুঠো করে থাকে। নূর ভেজা হাতে ওর হাতের মুঠো ছাড়িয়ে নেয়। মুঠির ভিতর কিছু পুরে দেয় সে। টিয়া আবারও হাত মুঠো করে ফেলে। ওর চোখদুটো কেমন জ্বালা করে ওঠে হঠাৎ।
-“আমাদের ঠিক দেখা হবে আবার, দেখিস তুই,” টিয়া যেন জোর করে বলতে চেষ্টা করে, “বাবা তো বলেইছেন, নেতায় নেতায় নাকি আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। আমাদের আর এপার-ওপার থাকবে না। আমরা আবার এক হয়ে যাব...”
হঠাৎ ওদের কানে কিসের যেন চিৎকার ভেসে আসে। উঁচু পাড়ের উপর ইঁট ফেলা মাটির রাস্তা ধরে কারা যেন সব ছুটতে ছুটতে আসছে। হাসান, নকিব, সুকুমারদা, সন্দীপ, রেজয়ানুর কাকা, স্থানীয় ক্লাবের আরও সব বড় বড় লোকজনেরা সবাই। ছুটতে ছুটতেই তারা কি সব যেন বলে চলেছে। সুকুমারদা আর হাসান ওদের কাছে এসে একটু গতি কমায়।
-“টিয়া, এখনই বাড়ি চলে যাও তুমি,” হাসান বলে ওঠে, “নূর, তুইও একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারিস। কিন্তু তারপর অতি অবশ্য করেই সন্ধ্যেয় ক্লাবঘরে চলে আসবি। ঢাকায় গণ্ডগোল বেঁধেছে খুব। আমাদের কাল মিছিল করতে হবে। পোস্টার লিখতে হবে।” নূর তরতর করে পাড় বেয়ে উঠে যায়। পিছু পিছু টিয়াও উঠে আসে। সে শুনতে পায় সুকুমারদা বলছে, “অনেক ছাত্রকেই নাকি মেরে দিয়েছে শুনলাম। মেশিনগান থেকে গুলি চালিয়েছে শয়তানেরা। নেতাদেরকে তো ওরা আগে থাকতেই জেলে বন্দী করে রেখেছে। ফরিদপুরে বনধ শুরু হয়ে গেছে। কাল দেশ জুড়ে মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি এই অপমানের জবাব ওদেরকে দিতেই হবে।”
সেদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি।
দেশজুড়ে গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল...
সেই বিকেলটাকে টিয়ার মনে পড়ে না আর। নূর সেদিন দৌড়তে দৌড়তে ক্লাবের দাদাদের সঙ্গেই চলে গিয়েছিল। পরদিন শহরজুড়ে বিশাল মিছিল হয়েছিল। আবছাটি মনে পড়ে তার। ওর বাবাও সেদিন সেই মিছিলে পা মিলিয়ে ছিলেন। সেই মিছিলের একমাস পর টিয়াদের পরিবার ইণ্ডিয়ায় চলে আসে। কোথা দিয়ে যেন কেটে যায় কাল। নূরের সাথে আবারও টিয়ার দেখা হয়েছিল, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।
[***]
ভাঙা কাচের টুকরোটার উপর আলতো করে হাত রেখেছিল তিয়াস। সাল ২০২২। কলকাতা, গড়িয়াহাট। আটতলারও উপরে সাজানো বারান্দা-ঘর। ‘মেঘমল্লার’ নাম। বাইরে তাকালে শহরের স্কাইলাইন দেখা যায়। অনেক নীচেকার গোলপার্ক উড়ালপুল, ছোটবেলায় যাকে সে তৈরি হতে দেখেছিল। এখন সে কেমন পুরনো হয়ে গেছে। তিয়াস আর পরাগের সঙ্গে কথা বলবে না। ওদের সর্ম্পকটা অনেক দিন ধরেই কেমন যেন গোলাকৃতি, একঘেয়ে, অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। যতখানি না ভালোবাসা অবশিষ্ট ছিল, সময় ভরে উঠেছিল অহেতুক তিক্ততায়। কিন্তু আজ যেটা হলো...
তিয়াস আবারও ভেঙে যাওয়া কাচের শার্শিটার উপর হাত রাখে। তিয়াসের বাবা অধ্যাপক। বাড়ি ফিরতে দেরী আছে এখনও তাঁর। তিয়াসের মা শান্তিনিকেতন গিয়েছেন। আবৃত্তির অনুষ্ঠান। ফিরতে ফিরতে আগামীকাল। পরাগ চলে গিয়েছে। ঝগড়া বাড়তে বাড়তে হঠাৎ করে যে টেবলের উপরে থাকা ওই জিনিসটাকেই সটান তুলে নিয়ে সে জানালায় ছুঁড়ে মেরে বসবে, তিয়াস ভাবতে পারেনি। তিয়াস হাত মুঠো করে। বাতাসের গন্ধ নেয়। বসন্তে নতুন পাতা আসছে। এমনতরো গভীর একেকটা অনুভূতি। কত ছোট ছোট জিনিসের ভিতর, কত লক্ষ বছরেরও স্মৃতি সঞ্চিত হয়ে থাকে বোধহয়। ভাগ্যিস জিনিসটা জানালা গলে নীচে পড়ে যায়নি। ফিজিক্সের নিয়ম? নাকি মানুষের মন? তিয়াস কাঁদছিল।
অনেক নীচেকার অরণ্যে পরাগ হারিয়ে গিয়েছে, বরাবরের মতো। পরাগের সঙ্গে আর দেখা হবে না তার। হাতমুঠো করে তিয়াস দেওয়ালের বড় ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
[***]
সামান্য দুটু্করো পাথরের জন্যও কেউ যে এমন করে প্রতিক্রিয়া দিতে পারে, পরাগের মাথায় আসে না। সেন্টিমেন্টাল এই সমস্ত মানুষদের সে দেখতে পারে না একেবারেই। তবুও কিসের জন্য যে এতদিন এই মেয়েটার পিছনে পড়েছিল...
[***]
জানুয়ারি ১৯৭২। মিস্টার ও মিসেস বোস সরকারি গাড়িতে চেপে সীমান্ত পেরিয়ে যান। স্বাধীন বাংলাদেশ। অনেক বছর পর মিসেস বোস তাঁর মেয়েকে সেদিনের কথা শোনাবেন। কলকাতা থেকে যশোর রোড, সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ। ঢাকা শহর। যেতে যেতে যতদূরেই বা চোখ যায়, কেবল চোখে পড়ে পোড়া, কালো আংরা হয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তুপ। যাওয়ার আগে রাজাকারের কসাইরা সমস্তটুকুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে গিয়েছে। বোস সাহেব সরকারি এঞ্জিনিয়র। বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজে যে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাঁরই গৃহিণী হিসেবে মিসেস বোস কেন জানি না বিশেষ অনুমতি-মোতাবেক তাঁর সঙ্গে এই সফরে যেতে চেয়েছিলেন। একখানি ক্যাম্পের সামনে গাড়িটা এসে দাঁড়ায়।
মুক্তিসেনাদের ক্যাম্প ছিল এখানে। এখন সব ঢাকার পথে। মৃত ও আহতেরা কেবল পড়ে রয়েছে। মৃতদের শনাক্তকরণের কাজ চলছে। আহতদের চিকিৎসা। গোটা জায়গাটা ওষুধ আর কেমন যেন একটা পোড়া গন্ধে ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে। বোসসাহেবের এখানে গাড়ি দাঁড় করানোরও কোনও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু প্রায় তিন, সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে গাড়িটা একটানা চলেছে। এখন একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। মিসেস বোস গাড়ি থেকে নেমে আসেন। ক্যাম্প হাসপাতাল কাছেই। সেখানে পুরোদমে কাজ চলছে। সাদা পোশাক পরা ডাক্তার-নার্স সকলে ছুটোছুটি করছেন। হঠাৎ একটা নাম কানে আসে। বড় পরিচিত শব্দ এক।
বড় পরিচিত স্বর... প্রায় সরগমেরই মতো, হঠাৎ
হাত ভাঁজ করে নূর শুয়েছিল। ডাক্তারেরা আশা দিতে পারেন না। মাথায় গুলির আঘাত রয়েছে। স্মৃতি বলতে প্রায় কিছুই নেই। আংশিক পক্ষাঘাত। মিসেস বোস মুখে রুমাল চাপা দেন। সরে আসেন। ঢাকা শহরের রিফিউজি ক্যাম্পে গুচ্ছ গুচ্ছ ধর্ষিতা মেয়ে-বউয়েদের সামনাসামনি দাঁড়ানোর স্মৃতি, তাঁকে নাড়িয়ে দেয়। নূরের চোখ দুটো খোলা। সটান আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে চোখদুটি। হাত দুটো ভাঁজ করে রাখা, বুকের উপর। বাইরে আবারও সূর্য ডুবছে। এমন অজস্র মুক্তিসেনাদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই স্বাধীনতা এনেছে বাংলাদেশ। মুক্ত, স্বাধীন এক রাষ্ট্র। কিন্তু প্রত্যেক পরিবার, যাদেরকে এই মূল্য চুকিয়ে যেতে হলো...মিসেস বোসের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, সামনে শুয়ে থাকা এই তরুণ যোদ্ধার নিজের পরিবারেরও কি কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি? কেউ কি কখনও দেখতে আসেনি তাকে? এসব প্রশ্ন নিষ্ফল বুদবুদের মতোই তাঁর বুকের ভিতরে, হৃদয়ের ভিতরে, পাঁজরার খাঁচার ভিতরে, নিঃশব্দে, সশব্দে ফেটে চলতে থাকে। নূর তখনও তাকিয়ে থাকে কেবল।
গাড়ি ছুটে চলেছে। হু হু হাওয়াতে, যেন বা সেই হাওয়ারই মতো গতিবেগে পিছনপানে সরে যেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। বোস-দম্পতি এখন স্ব-দেশেরই পথে আবার। স্বাধীন এক রাষ্ট্র থেকে আরেক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভিমুখে। রক্তই কেবল যুগ থেকে যুগান্তরে স্বাধীনতার মূল্য চুকিয়ে দেয়। মিসেস বোস হাতের ভ্যানিটিব্যাগটাকে কোলের উপর থেকে তুলে এনে ড্যাশবোর্ডের উপরটায় রাখেন। ক্লিপ খুলে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেন।
বড় চেনা স্পর্শ এক। বড় পরিচিত সুখ। মসৃণ দুটি তল। দুখানি পাথর। মহানন্দা নদীর বুক থেকে তুলে আনা।
এখনও স্পর্শ করলে জলের গন্ধ পাওয়া যায়।
বোস-জায়া চোখ বুজে ফেলেন।
[***]
অনেক বছর পর, অনেক গোধূলি পেরিয়ে, আরও এক ফেব্রুয়ারিতে সেই টিয়ারানি বসুরই প্রকাণ্ড এক দেওয়াল জোড়া ছবির সামনেটায় দাঁড়িয়ে, চোখ বুজবে অষ্টাদশী তিয়াস। তারও হাতে তখন লেগে থাকবে মহানন্দা-জল।
পাথরও যে কখনও কখনও জলের মতো বইতে পারে। আমরাই কেবল খবর রাখিনা কেউ...