অরিত্র দ্বিবেদী
"কবিতা চাই! কবিতা চাই! কবিতা চাই! কবিতা চাই!..." ভদ্রলোককে অনেকেই দেখেছেন, অনেকেই চেনেন। নামটা জেনে ওঠা যায়নি। একটা ফুলহাতা সাদা শার্ট, একটা কালো প্যান্ট, খুব শীতে মাথায় একটা মেটে টুপি আর গায়ে মেরুন রঙের একটা চাদর, ব্যাস। প্রতি বইমেলাতেই লিটিল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন এ ভদ্রলোককে প্রত্যেকটি স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে কবিতা চাইতে দেখা যায়। কেউ কেউ বলেন উনি সত্যি কবিতার খোঁজে আছেন। কারোর কারোর ধারনা কবিদের আর কবিতাদের সংখ্যা অতিরিক্ত রকম বেড়ে গেছে বলে উনি ওভাবে শ্লেষ করেন এসে, বক্রোক্তি করেন।
এখন এটা শ্লেষ, যমক, বক্রোক্তি নাকি অন্ত্যানুপ্রাস তা আমার বোধশক্তির বাইরে। তবে, দেখলাম অনেকের সঙ্গেই কথাও বলছেন, খোঁজ নিচ্ছেন কোনো কোনো মানুষের, তাঁরা এসেছেন কি না। আসতে পেরেছেন কি না!
ভেবেছিলাম, আমি বা আমার এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করব না। অর্থাৎ প্রথম পুরুষকে ব্যতিরেকে লেখাটা নিরপেক্ষভাবে লেখার চেষ্টা করব। শুরু করার পর বুঝলাম এ অসম্ভব। অভিজ্ঞতা ছাড়া ঝুলিতে তো আর কিছুই নেই।
বইমেলা। বসন্তের দামামা। প্রাক বসন্তের চিহ্ন। মিলনমেলা। স্বর্গদ্বার। এরকম বেশ কিছু স্বাভাবিক আর বেশ কিছু চমকে দেওয়া বিশেষণে এ মেলা সেজে ওঠে। তবে, সবকটি বিশেষণই যে যথাযথ, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
নিছক পাঠক, নিজের বাকেট লিস্টে টিক দেওয়া সম্মান লোভী বাঙালী, কবি, লেখক, সাহিত্যিক, বই পাগল, প্রাবন্ধিক, তারকা, পুলিশ, প্রশাসন, দমকল কর্মী কেউই বোধহয় বাদ যান না। মিলনমেলাই বটে।
দু সপ্তাহ, কয়েক কোটি বই, কয়েক হাজার লেখক আর অগুনতি পাঠক। এই হল সারমর্ম।
ঘুরে দেখতে দেখতে যদি ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েন, গাছ পাবেন, ছায়া পাবেন, জল পাবেন। আর আমার মত কপাল ভালো থাকলে শুনতে পাবেন প্রশ্ন,
"কী বাবু! কোথা থেকে আসছ?"
"আজ্ঞে, হুগলি"
"বাহ বাহ বাহ। একাই নাকি?"
"হ্যাঁ ওই আরকি..."
"খাবে কিছু? নাও না গল্প করতে করতে খাও আমার সঙ্গে..."
ভদ্রলোক সত্যি করেই এক প্যাকেট কেক অফার করে বসে রইলেন। ভদ্রতার খাতিরে বার তিনেক না বললুম, তিনি জোর করে ধরিয়ে দিলেন প্যাকেটটা হাতে। খেতে খেতে বলতে লাগলেন,
"আগের জায়গাটাই, মানে ময়দানটাই ভালো ছিল, এখন বড্ড বেশি কর্পোরেট, বড্ড বেশি অর্গানাইজড হয়ে গেছে, অবিন্যস্ত থাকলে একটা আপন, একটা ঘরোয়া ব্যাপার আসে, বুঝলে কিনা, হেঁ হেঁ..."
"না জেঠু, ভালোই তো বেশ, খারাপ কী?"
"আহা! খারাপ বললাম কই! এই যে দেখো তুমি, তোমাকে তো চিনতাম না পাঁচ মিনিট আগেও, তুমিও চিনতে না, এখন দেখো... এই জিনিসটাই বদলে গেছে।"
তবে, আমার মনে হল তার জন্য জায়গা বা ব্যবস্থাপনা দায়ী কিনা জানিনা। মানুষ নিজেই ৯৯% দায়ী। সেটা আর বললাম না। ভদ্রলোক শেষ অবধি একটা ছোটো বই আমাকে গিফ্ট করে তারপর বিদায় নিলেন, যাবেন মুর্শিদাবাদ, অগত্যা...
এত রকম আর এত ধরনের বই, একসঙ্গে পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় কি! কী জানি। তবে এত বাংলা বই নিশ্চয়ই দেখা যায় না। বেছে বেছে চমকে দেওয়ার মত কিছু বই পেলাম। লিভারপুলের তিনকবিকে নিয়ে বই, কল্লোল যুগের হারানো এক কবির বই, পাঁচ টাকায় দু-দুটো নাটকের বই!
লিটিল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে তো জায়গায় জায়গায় জটলা, নির্ভেজাল আড্ডা, হাসি, আলোচনা, কবিতাপাঠ। দুম করে দেখলে মনে হবে, কলেজের বন্ধুদের রিইউনিয়ন। তবে, শুধু বয়স্ক নন, তরুণ, এমনকী কিশোররা পর্যন্ত আছেন সেই দলে। মাঝে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলে মনে হবে, পাঠক হিসেবেই হোক না কেন, এই বিরাট পরিবারের আমিও তো একজন সদস্য। সদালাপী চরিত্র কবিদের অজানা বা অব্যবহৃত কিছু নয়। এসব করার জায়গা ১ থেকে ৯ নম্বর গেটের বাইরে, ভেতরে নয়।
কিছু বই আর অনেক অনেক ভালো ছবি, ভালো অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ভরে ফিরছিলাম। বাসে দুজন হিন্দিভাষী মানুষকে বলতে শুনলাম,
"ইয়ে বাঙ্গালী পাগল হ্যাঁয়, ইতনি কিতাবেঁ কৌন পঢ়তা হ্যায়!"
বেশ ভালোই লাগল শুনতে। রেগে যাওয়ার বদলে হাসি পেল। তবে, বিঁধল দ্বিতীয় জনের উত্তরটা,
"আরে নহি নহি, কুছ লোগ তো বস, সেল্ফি খিঁচওয়ানে আতেঁ হ্যাঁয়, উনকো নাহি মেলে সে মতলব নাহি কিতাবোঁ সে..."
সত্যিই কথা। মুখ নীচু করে বসে বসে ভাবছি, হাতে ধরা বই একটা। ভাবছিলাম যাহ্ এইরকম তেতো মন নিয়ে ফিরব নাকি! পাশেই এক ভদ্রলোক, আমারই বয়সী, বললেন,
"বইটা কোন স্টলে পেলেন?"
কথা বলতে বলতে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অথচ দুজনেই আপাত মুখচোরা। বাসের ভাড়া উনি জোর করেই মিটিয়ে দিলেন, বাড়িও কাছাকাছি দুজনেরই, ট্রেনের টিকিটটা নিয়ে যখন ওঁর কাছে গেলাম, ঠিক করতে লাগলেন, কাকে কাকে ডেকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়! কোথায় দেওয়া যায় আড্ডা।
শুরু যেভাবে হয়েছিল, শেষটুকুও সেইভাবে হল। আক্ষরিক মিলন মেলাই। মাঝে যেটুকু ঝড় ঝাপটা। থাকনা ওটুকু। ওঁরাও তো আমাদেরই। হাতে ধরে শিখিয়ে দেওয়া যাবে'খন বই এর সাথে বন্ধুত্ব কী করে করতে হয়। তবে আজ এটুকুই থাক। অবশ্যই দেখা হচ্ছে পরের বছর। আমি কিন্তু আগ বাড়িয়েই জিজ্ঞাসা করব, "কী কিনলেন মশাই? স্টল নম্বর কত?"