দোঁহা

বইমেলার জন্য সবকিছু পারি!

 




অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

বইমেলার জন্য সবকিছু করতে পারি। লিখতে বসে মনে পড়ছে ২০১৫ সাল। গ্র্যাজুয়েশন পেরিয়ে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন। তখনও অবধি বইমেলার ঠিকানা ছিল মিলনমেলা প্রাঙ্গন, পার্ক সার্কাস বাইপাসের উপর। যে কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, তার ঠিক বাইরে থেকেই সরাসরি বাস ছাড়ত বইমেলার। কাজেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসা বাবার গল্প, বাস্তবে পরিণত করতে তর সইল না। বইমেলা ২০১৫, ১২দিনের মধ্যে ১২দিনেই গিয়ে হাজির হয়েছিলাম সেই উৎসবে। প্রতিদিন নিয়ম করে ফিরে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট লিখতে বসতাম। প্রাণের বইমেলাকে নিয়ে আবেগ ছিল এতই। কিসের জন্য যে এমন গভীর একখানি টান জন্মিয়ে গেল, আজও বুঝে উঠতে পারিনি। কেবল মনে পড়ে সেই ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের হাত ধরে বইমেলা যাওয়ার কথা। বইমেলা শুরু হলেই বেশ বোঝা যেত একটা কিছু শুরু হয়ে গিয়েছে। বাবাকে প্রায় দিনেই দেরি করে ফিরতে দেখতাম। একদিন কি দুদিন বরাদ্দ থাকত আমাদের তিনজনের। মাও আমাকে ইস্কুলে জমা করে দিয়ে, একেকদিনে ঘুরে আসতেন সেই উৎসব থেকে। পাওনা হিসেবে জুটত নতুন বই। নতুন বইয়ের গন্ধ। ঝকঝকে রঙ আর বাঁধাই-সুখ। পাতা উলটিয়ে পড়তে পেতাম দূর পৃথিবীর খবর। ঘুমপাড়ানি রূপকথার মতোই তাই বইমেলাও, সেই কচি বয়স থেকেই সত্ত্বায় জুড়ে গিয়েছিল। আজও নেশা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।

আমার এক বন্ধু, বিবেক তার নাম। কর্পোরেটে চাকরি করে অনেক পয়সার মালিক। জীবনে টাকার গুরুত্ব বোঝে। সেই একবার বলেছিল আমায়, “জানিস, আমরা যতই নাক-উঁচু কর্পোরেট হই না কেন, টেনশন কি আমাদের জীবনে কিছু কম? বরং বেশি বলতে পারিস। অথচ ওই যে দেখছিস, বোহেমিয়ান, উড়নচণ্ডে ছেলেছোকরাদের দল, অথবা পেনশনভোগী বুড়োবুড়িরা সব সেজেগুজে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে এসে বসেছে। সম্বৎসরের সম্বল অথবা মাসছয়েকের হাতখরচের সবটুকুকেই কাগজ আর ছাপার পিছনে উড়িয়ে দিয়ে জীবনের পথে হেঁটে চলার যে সুখ–ওদের সেই আনন্দটাই বুঝি অন্যরকম। হয়তো ওদের কারোরই হাই ব্লাড প্রেশার নেই। অথবা হবেও না বোধহয়।" বিবেক এখনও বইমেলায় যায়। ভাঁড়ে করে চায়ে চুমুক দেয় আর সুবর্ণরেখা, মণীষা পাবলিশিং অথবা র্যা ডিকাল ইম্প্রেশনের প্লাইউডের তাকগুলোয় খ্যাপারই নেশায় খুঁজে ফিরতে চায় পরশপাথরের হদিস। সেই পরশপাথরের সন্ধান সে পেয়েছে কিনা জানিনে। কেবল জাগতিক সংসারের সঙ্গে এই বইয়ের জন্যই তার বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে।

এই লেখাতে ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ নয়। আবার বাস্তবও নয় সবাই। বইমেলা মানেই যে কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যকার যাতায়াত।

পৃথিবীতে বোধহয় আর এমন একখানিও জায়গা মিলবে না, যেখানে কিনা স্রেফ বইয়ের জন্য, মূলত বিশেষ একটি আঞ্চলিক ভাষার বইয়ের জন্য কেবল যে ১২দিন ধরে কত লক্ষ মানুষ আসেন, কত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়এ–তাই নয়, সেই রাজ্যের জেলায় জেলায় মোটামুটি মাস-দুই ধরে চলতে থাকে আরও অগুন্তি বইমেলার হুল্লোড়। লেকটাউন বইমেলা, তারই পাশাপাশি আবার খাল পার হয়ে বাঙুর বই উৎসব। দমদম বইমেলা, আবার তারই পাশে সিঁথি অথবা বেলঘরিয়াতেও বই নিয়ে হইচই সবার। বাঙালীদের এই বইপ্রেমের বিষয়ে রীতিমতো গবেষণা হওয়া উচিত। নন্দন চত্বরে ৩৫০টিরও বেশি লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আলাদা করে আয়োজিত হয় লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও সাহিত্য সম্মেলন। জেলায় জেলায় এমন সাময়িকীগুলির মোট সংখ্যা যে কত হতে পারে, তার হিসেব মেলে না। উঁচু-নীচু, গরীব-বড়লোক, সাধারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত, সকলেরই বাঁধা রুটিন থাকে–বইমেলায় একদিনের অন্তত হাজিরা বাধ্যতামূলক। যাদের রুটিনে সে হিসেব থাকে না, আমি তাদেরকে বাঙালী বলতে অস্বীকার করি।

এমন বন্ধুকেও আমি জানি, স্রেফ বইমেলার কথা মনে রেখে সুদূর প্রবাস থেকে তারা ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে, বইমেলার ধুলো মাখতে। ২০১৩ সালে প্রথম কলকাতা সাহিত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বইমেলায়। তারপরে অবশ্য নয় নয় করে এখন অনেকগুলি সাহিত্য উৎসবের আয়োজন দেখা যায়। কিন্তু প্রথম সেই সাহিত্য উৎসবে, মনে পড়ে অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলাম ‘শিণ্ডলার্স আর্ক’ উপন্যাসের লেখক থমাস কেনিয়লিকে বক্তব্য রাখতে। এসেছিলেন দেশ-বিদেশের অনেক কবি-সাহিত্যিক-ঔপন্যাসিক। লজ্জিত বোধ করেছিলাম পরে একথা জানতে পেরে যে, সেই উৎসবে নাকি উদ্যোক্তারা স্বয়ং সলমন রুশদিকেও নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। সবরকমের ব্যবস্থাও নাকি সারা হয়ে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে সরকারি বিধিনিষেধের কারণে রুশদিকে আনা যায়নি। পরদিন সাহিত্য উৎসবের মঞ্চে নীরবতা পালন করে আমরা সেই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। রুশদি আজও লিখছেন। ২০২৩এর বইমেলা যখন চলছে, তখন সেই একই সময়ে নতুন উপন্যাস প্রকাশিত হবে তাঁর। মারণ-হামলার মুখ থেকে ফিরে এসে তিনি আবারও লিখতে শুরু করেছেন।

অক্ষর, ভাষা, সাহিত্য, প্রকাশ, মন, গল্প, কথাসাহিত্য, মানুষের অভিব্যক্তি l–এই সবকিছুকেই ছুঁয়ে থাকে বইমেলা। অনেক মানুষের সাথে অনেক মানুষের মিলন ঘটিয়ে দেয়। অমুক স্টল নম্বরে নাকি সেই দারুণ পুরনো ঐতিহাসিক বইখানি আবারও নতুন করে পাওয়া যাচ্ছে, অথবা অমুক প্রকাশনায় নাকি দুষ্প্রাপ্য কোনও ইতিহাসের বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে নতুন রচনা–মেল্টিং পট বলতে যা বোঝায়, বইমেলা আদতে তাই। এখানে পাশাপাশি দোকানেই বিক্রি হতে দেখবেন কাস্ত্রোর বক্তৃতা ও ‘সহজে জেন পদ্ধতি যাপনের উপায়’। সব তত্ত্বেরই অন্তিম মোহনা এসে মেশে এই বইয়েরই উৎসবে কেবল।

২০১৯এ প্রথম নিজের কবিতাকে প্রকাশিত হতে দেখেছিলাম। পত্রিকার মোটাসোটা সেই লেখক কপিটিকে সংগ্রহ করতে গিয়ে, সঙ্গে করে আবার এক বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলাম। হাতে নিয়ে পরেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। বিশাল এই উৎসবের মাঝে তাহলে একমুঠো, একটুকরো হয়েও আমি রয়েছি? আজও লেখা বের হয়। আজও অনুভব করি সেই প্রথম দিনের বিস্ময়। রুশদির কথা ভাবতে ভাবতে নতজানু হই সেই ভাবনার কাছে– যেমনটা রুশদি বলেছেন, “গল্প বলার যে শিল্প, তা আদতে মানবসভ্যতার নিরিখে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এক শিল্প। এই শিল্প প্রত্যেক দুর্বিনীত শাসকের অস্তিত্বকে অতিক্রম করে বেঁচে থাকে!”

…এই শিল্প প্রত্যেক দুর্বিনীত শাসকের অস্তিত্বকে অতিক্রম করে বেঁচে থাকে!

কথাকারেরা সবাই, এই উক্তিকে মনে রাখবেন। আমরা যারা লিখতে চেষ্টা করি, আমাদের দায়িত্ব অসীম। প্রত্যেক দুর্বিনীত একনায়কের অস্তিত্ব লীন হয়ে যাবে, মাটিতে মিশে যাবে সাম্রাজ্যের মদগৌরবমণ্ডিত প্রহসন। থেকে যাবে অক্ষরের হিসেব। পুঁথি থেকে শুরু করে, শিলালিপিতে, শ্রুতিতে–সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে মাধ্যম। রুশদি কথাকার হতে চেয়েছিলেন। মানুষের মুখের কথা, মনের কথা, ভাব প্রকাশের সেই ভাষার মধ্য দিয়ে সার্বিক মনুষ্যত্বের যে প্রকাশ, তার চেয়ে সুন্দর আর কিছুই নয়। তার চেয়ে উদার আর কিছুই নয়। বাঙালী যে ভাষাকে উদযাপন করে, এই বৈশিষ্ট্যই বাঙালীকে বিশেষ করেছে। বইয়ের উৎসবে সেই উদারতার উদযাপন হয়। অক্ষরগুলি ছায়াপথ হয়ে জেগে থাকে। আমরা অবাক চোখে দেখতে পাই, প্রতিবারের মেলাশেষের গান।

মেলাশেষের মুহূর্তে যখন ঘণ্টা বাজানো হয়, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আজকাল যে কোনও উৎসবে বা প্রতিমার বিসর্জনেও এমনতরো গভীর কোনও বেদনাকে কোথাও অনুভব করি না আর। শুধু ভাবি আমি কেবল একলাটি নই। আমার পাশে দাঁড়িয়ে আরও অনেক মানুষ বেদনাক্রান্ত হয়েছেন।

তাঁরা বইমেলার যাত্রী। তাঁরা মানবতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারকে বহন করে নিয়ে চলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন