পামেলা ভট্টাচার্য
ট্যাক্সি থেকে নেমে বাবার হাত ধরে টুকটুক করে হেঁটে যাচ্ছিলাম। বাবার সাথে ম্যাচিং করে মা আজ আমায় জিনস আর কোট পরিয়ে দিয়েছে। আমি ঘাড় উঁচু করে বাঁদিকের বড়ো বড়ো বাড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম। একটা নীল রঙের বিশাল বড়ো বাড়ির সামনে এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কার বাড়ি বাবা? বাবা বললো, এটা চ্যাটার্জীদের বাড়ি।
–আর বইমেলা কতদূর বাবা…
বাবা কিছু না বলে আমার হাত ধরে রাস্তা পার করে এসে একটা বড়ো গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো, কী লেখা আছে পড়ো তো…
বানান করে পড়লাম, কলকাতা পুস্তকমেলা ১৯৯৮
মেলায় ঢুকে আমি তো অবাক। কতোওও বই, কতো কতো দোকান… লোকজন, ঠিক যেন দূর্গাপুজো। এর আগে নিয়ম করে মালদা বইমেলায় গেছি। কিন্তু সে তো পুঁচকে মতোন। এমন পুজো পুজো ব্যাপার সেখানে নেই। লোকজন হাসছে, গল্প করছে, বই পড়ছে, কেউ তো আবার গান গাইছে, তার সাথে কেউ আবার নেচে উঠছে। কত আনন্দ… আর আমি তো কোন বইটা কিনবো বুঝতেই পারছি না…
টিনটিন নাকি টুনটুনি… বাবা একটা মোটা বই হাতে নিয়ে খুলতেই কী সুন্দর একটা গন্ধ… বাবা কি বইটা কিনবে, তাহলে আমি রোজ বইটার গন্ধ নেবো…
এক দোকান থেকে আর একটা দোকান… রং বেরঙের বই… একটা বই হাতে নিয়ে বাবাকে দেখাতে যাবো, পাশ ফিরে দেখি বাবা নেই। নেই নেই, কোত্থাও নেই। ছুটে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরেও নেই। এবার কান্না পেয়ে গেলো। আমায় ছেড়ে বাবা কোথায় চলে গেল… হন্যে হয়ে খুঁজছি বাবাকে,
এমন সময় পিছন থেকে কে যেন ডাক দিলো, পামেলা, এই পামেলা… ঘুরে দেখি সোনালি ডাকছে।
—কী রে, তুই এদিকে কখন চলে এলি? আমরা তোকে লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নের কাছে খুঁজছি।
আমি কিছু বলার আগেই সোনালি আবার বলে উঠলো, সন্দীপ গিটার এনেছে, অভিদের পত্রিকাটা প্রকাশের সময় গাইবে। চলে আয়, মমার্তর কাছে ওয়েট করছে সবাই।
ঘোর ভেঙে তাকিয়ে দেখিয়ে দুপুর ঢলে বিকেল নামছে। সল্টলেক স্টেডিয়ামের আলো এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে বইমেলাকে। সোনালির সাথে কথা বলতে বলতে মমার্তর দিকে এগিয়ে গেলাম। অভি তখন ব্যাগ থেকে পত্রিকাগুলো বের করে সাজাচ্ছে। সন্দীপ গিটারের স্ট্রিংগুলো ঠিক করে নিচ্ছে। গান বাজনা শুরু হয়ে গেলো। আমরা সবাই গলা মেলালাম একটু পরে। হঠাৎ দেবিনা বলে উঠলো, এই ৫টা বেজে গেছে। আমায় ৬টার মধ্যে বাড়ি ঢুকতে হবে। সল্টলেক থেকে ফিরতেও তো সময় লাগবে।
আমরা হইহই করে বললাম যে আর একটু বোস, আমরা সবাই তো বাড়ি যাবো।
গানে গল্পে যখন হুঁশ ফিরলো তখন ঘড়িতে সাড়ে ছটা। পড়ি কি মরি করে সবাই ছুট লাগলাম বেরোনোর গেটের দিকে। আজ বাড়িতে ঝাড় নাচছে।
হন্যে হয়ে বেরোনোর রাস্তা খুঁজছি এমন সময় কে যেন হাত ধরে টান দিলো, তাকিয়ে দেখি সমুদ্র। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলছে, “আমি এদিকে তোর হিমু সমগ্রের বিল করাচ্ছি আর পাশ থেকে তুই উধাও। টেনশনে ফেলে দিয়েছিলি মাইরি। প্রথমবার বান্ধবীর সাথে বইমেলায় এসে তাকে হারিয়ে ফেললে সারাজীবন যা কথা শুনতে হবে… টেনশন কমাতে ফিশফ্রাই খাওয়াবি চল”। সন্ধের হাল্কা হলুদ আলোয় সমুদ্রের চোখটা কী মায়াময় লাগছে। কপালে হাল্কা ঘামের রেখা। খুব ইচ্ছে করছিলো ওড়না দিয়ে ওর ঘামটা মুছিয়ে দি। ভেবে একটু লজ্জাও লাগলো। সমুদ্র আমার নাকে একটা টোকা মেরে বললো, কী ম্যাডাম, ফিশফ্রাইয়ের খরচার কথা ভেবে ঘাবড়ে গেলি নাকি… ওসব চলবে না…
–ধ্যাৎ, তোর খালি বাজে কথা… চল খাওয়াচ্ছি।
সমুদ্রের হাতটা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি ফুডকোর্টের দিকে। একটু দূরে সায়েন্সসিটির গোল বিল্ডিংটা দেখা যাচ্ছে। চারদিকে লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে… হঠাৎ দেখি সেই পাবলিকেশনের স্টল, যাদের একটা বই আমি অনেকদিন থেকে খুঁজছি। সমুদ্রকে বললাম, তুই বেনফিশের সামনে গিয়ে দাঁড়া, আমি বইটা তুলেই আসছি।
স্টলে ঢুকে বইটা খুঁজছি। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো। দেখি ফাল্গুনের কল। রিসিভ করে বললাম,
–বল কী খবর?
–লোকজন পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও আর চিনতে পারিস না বল। সহকর্মী প্রাক্তন হয়ে গেলে এতটা বদলে যেতে হয় বুঝি…
–আরে কী আশ্চর্য ডাকবি তো...
–এই তো ডাকলাম, পিছন ফিরে দেখ
ঘুরে দেখি, বাবু একটু পিছনে দাঁড়িয়ে হাসছেন… কাছে যেতে সেইইই রমনীমোহন হাসিটি দিয়ে বললো,
–তা একাই নাকি,
—এই বয়সে আর দোকা কাঁধে নিয়ে বইমেলা আসা পোষায় না রে। তোর খবর কী? অফিস ছাড়ার পর তো একেবারে ভ্যানিশ।
—তুই জানবি কী করে, ফোন টোন তো করিস না। আমি মাঝেসাঝে না খোঁচালে তো আমার নামটাও ভুলে যেতিস। এই নাকি তোর প্রেম…
—আহা পুরো প্রেমটা তো তুইই নিয়ে রেখেছিস, তোর হেফাজতে আছে যখন, আমার চিন্তা নেই। যাক গে, চল চা খাই।
রাতের দিকে গড়িয়ে যাওয়া বইমেলার আধোভাঙা ভীড়ে ফাল্গুনের সাথে হেঁটে যেতে কেমন যেন এক শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছিলো। কী জানি কী বলে তাকে…
একটু পরে ফাল্গুন বললো, তুই এখানে বোস, আমি চা নিয়ে আসি।
আমি অপেক্ষা করছি। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। দেখি পৃথ্বী ফোন করেছে।
–হ্যাঁ কোথায় তুমি?
–তিন নম্বর গেটের সামনে।
–ভেতরে চলে এসো, আমি ঠিক গেটের সামনে আছি।
একটু পরেই দেখতে পেলাম কালো টি-শার্ট পরা আর কালো মাস্কে মুখ ঢাকা পৃথ্বী। কাছে এসে মাস্ক খুলে বললো,
–উফফ এই করুনাময়ীতে পার্কিং পাওয়া এত চাপের জানলে গাড়ি নিয়ে আসতাম না। সেই কোন মুল্লুকে গিয়ে পার্ক করতে হয়েছে। সরি, তোমায় অনেকক্ষণ ওয়েট করতে হলো।
—আরে ঠিক আছে। চলো চা খাই। তোমার বইদুটো আমি তুলে রেখেছি।
—পেয়েছ… উফফ… এই জন্য তোমায় এত ভালোবাসি…
—আচ্ছা হয়েছে হয়েছে… অফিসের কী খবর তোমার..
—বাদ দাও না, কাল থেকে তো সেই তোমার অফিস, আমার অফিস.. তোমার আলাদা বিশ্ব, আমার আলাদা সংসার.. আজ শুধু আমরা থাকি… ধরো আজ সরস্বতী পুজো আর আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে বইমেলায় প্রেম করতে এসেছি।
বলতে বলতেই রবিবারের বইমেলার ওই জমজমাট ভীড়ে আমার হাতটা চেপে ধরে এগিয়ে যায় পৃথ্বী। সত্যিই যেন সরস্বতী পুজোর সন্ধে। আর আমরা দুই বাড়ি থেকে পালানো কিশোর কিশোরী…
হঠাৎ কী একটা মনে পড়তেই পৃথ্বীকে বলতে যাবো, দেখি হাতের মুঠো আলগা হয়ে পৃথ্বী কখন যেন ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
অসংখ্য ভীড়ের মাঝে আমি কেমন অপূর্ব একা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আলো ঝলমলে রাতের বইমেলা। মানুষে বইয়ে মেশামিশি এক মন কেমনিয়া গন্ধে ভরপুর চারদিক। মুখে হাসি, হাতে বইয়ের প্যাকেট। সদ্য ভাঁজ খোলা বইয়ের সুবাস… আহা জীবন… ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় ৮টা। বেরোতে হবে। করুণাময়ী থেকে ফেরা বেশ হ্যাপা। কিন্তু এক্সিট গেট আর খুঁজে পাই না। চারদিকে লুটিয়ে পড়া টুকরো স্মৃতির কনফেটি। কখনও হাসছে, কখনও মনকেমন করছে আবার কখনও অভিমানে গাল ফুলিয়ে হাত ধরছে… বইমেলা তো তাইই, স্মৃতির, প্রেমের, আদরের চক্রবূহ্য। ফেরার চেষ্টা বৃথা জেনে ফিরে আসি আবার। বন্ধুর বই বেরিয়েছে এবছর। নিজের হাত ধরে এগিয়ে যাই তার স্টলের দিকে, হাসিমুখে বলি, বই দে আর সই দে…