দোঁহা

শতদল মিত্রের উপন্যাস

 



আধেকজান

(পর্ব # ৮)

     উদ্দালক আবারও বাস্তবে ফেরে এ কুশল কামনায়— ভালো আছেন?

     উদ্দালক মুখ তোলে। মুখ হাসে তার সামনে চোখে হাসি এঁকে দাঁড়িয়ে পরিচিত কাস্টমার

     --ভালো আছি দিদি। আপনি?

     --চলে যাচ্ছে কোনোরকমে। চালিয়ে নিতে হচ্ছে আর কী? যা দিন এলো?

     --সেই! গোটা বিশ্ব টালমাটাল অসুখে।

     --টালমাটাল বলতে! দেড় বছর ধরে ভয়ে ভয়ে বাঁচা।

     কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না উদ্দালক। অগত্যা সে তার পেশার আশ্রয় নেয়।

     --তা, আমার কাছে কিছু কী দরকার?

     --না, টাকা তুলতে এসেছি। দেখলাম আপনি ফাঁকা, তাই...

     মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা ক্যাশ কাউন্টারের দিকে বাঁক নেন। কে জানে ভদ্রমহিলা আবার কিছু মনে করলেন কিনা! এ ভাবনায় উদ্দালক কথা বোনে। 

     --ছেলের কোন ক্লাস হল?

     --সেভেন। এখন তো আবার অনলাইন। কী হবে কে জানে? ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে মহিলা সে কাস্টমার উদ্দালকের দিকে কথা ভাসিয়ে দেন।

     --বাহ! বড় হয়ে হয়ে গেল তো!

     এর উত্তরে এক মায়ের স্নেহমাখা নীরব হাসি ঝিলিক হানে। অথচ সেদিন, নোটবন্দির সাতদিনের মাথায়ই বোধহয়, এ মায়ের চোখে কান্নার নিঃশব্দ ঝরে পড়া দেখেছিল নিরুপায় উদ্দালক। পুরনো নোট বাতিল। নতুন নোটের যোগান নেই। চারদিকে নগদ টাকার হাহাকার। ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে উপছে পরা মানুষের ভিড়। পুরনো টাকা জমা দেওয়ার। নতুন টাকা তোলার। নতুন টাকাই তো নেই। যাও বা আসছে চাহিদার তুলনায় নেহাত্‍ই নগণ্য তা প্রত্যেককে পাঁচহাজার করে দিলেও দেখতে দেখতে শেষ তাও আজ টাকা এলে কাল যে আসবে তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই ব্যাঙ্কের মধ্যে প্রতিদিন চুড়ান্ত অব্যবস্থা, গণ্ডগোল। এ রকমই এক দিনে ওই ভদ্রমহিলা ব্যাঙ্কে এসেছিলেন টাকা তুলতে সাত সকালেই লাইন দিয়েছিলেন, ব্যাঙ্ক খোলার অনেক আগেই। কিন্তু সেদিন সকালে টাকা আসে নি। কখন আসবে উদ্দালকর জানে না। বারোটা বেজে যায়। চিত্কার-চেচামেচি। মারামারি লাগবে যেন। কেউ কেউ ফিরে যায়। যারা অপেক্ষা করে তাদের বোধহয় খুবই প্রয়োজন টাকার। তাদের মধ্যে একজন ওই ভদ্রমহিলা। একটা বেজে যায়। ভদ্রমহিলা গুটি গুটি ওর টেবিলে আসে। অস্ফুট স্বর কোনোরকমে ফুটে ওঠে।  

     --স্যার, আজ আসবে তো টাকা? নইলে...

     সহসা ভেঙে পড়ে যেন সে স্বর। উদ্দালক মুখ তুলে তাকায়। দেখে সে-নারীর কান্নার নিঃশব্দ ঝরে পড়া। অপ্রস্তুত উদ্দালক কী বলবে ভেবে পায় না। শুধু উপলব্ধি করে, মহিলার নিশ্চয়ই টাকার খুব প্রয়োজন। শশব্যস্ত ব্যাঙ্ককর্মী সে বলে ওঠে,

     --ফোন তো করছি হেড অফিসে। বলছে তো পাঠাবে কিন্তু কখন যে... টাকাটা আজই কী দরকার? কাল আসুন, আমি না হয় আপনার টাকাটা আলাদা করে রেখে দেব

     --আমার ছেলে হাসপাতালে ভর্তি। কাল অপারেশন। আজ টাকাটা হাসপাতালে জমা দিতে হবে। ওরা পুরনো টাকা নেবে না। চেকও নেবে না। আমার স্বামী বাইরে থাকে। আমার একমাত্র ছেলে।

     চোখের জলের সঙ্গে গড়াতে গড়াতে নামে যেন শব্দগুলো।

     --তাহলে তো অনেক টাকা! অত টাকা এখন... কত লাগবে? কোন হাসপাতাল?

     --এখন পঞ্চাশ হাজার। জীবক হসপিটাল। বাকিটা দুদিন পরে...

     --দাঁড়ান আমি একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখে দিচ্ছি। আপনি সই করে দিন। দেখি ম্যানেজারকে বলে। হসপিটালে ভর্তির ডকুমেন্ট কিছু আছে... এনেছেন?

     --হ্যাঁ। জেরক্সও আছে

     যা হোক সেদিন দুটো নাগাদ তাদের ব্রাঞ্চে টাকাটা এসেও যায়। ততক্ষণে অনেক কাস্টমার চলেও গেছে। ফলে ম্যানেজারও তেমন আপত্তি করে না। অবশ্য বিয়ে বা হসপিটাল কেসে প্রয়োজনীয় টাকা তোলার সরকারি ফরমানও ততদিনে জারি হয়েছে। ভদ্রমহিলা টাকাটা পেয়ে যান উদ্দালক তাঁকে টাকাটা পাইয়ে দিতে পেরে মনে একটু তৃপ্তিও পেয়েছিল যদিও তা তাঁর নিজেরই হকের টাকা।

     --কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দিই! ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।

     মহিলা হাত জোড় করেছিলেন তাঁর ভেজা চোখে যেন কৃতজ্ঞতার শান্ত ছায়া ভেসেছিল উদ্দালকও হাত জোড় করে উঠে দাঁড়িয়েছিল।

     --না, না, এ তো আমাদের কর্তব্য, ডিউটি। আপনার ছেলে সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসুক

     --সেই আশীর্বাদ করুন। মহিলার জোড়াহাতের মুদ্রায় ফুলের কুঁড়ি ফুটে উঠতে দেখেছিল উদ্দালক

     --এরপর টাকা লাগলে একটু কষ্ট করে আগেরদিন অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে যাবেন। পরিস্থিতি বুঝতেই তো পারছেন

     সেই থেকে ভদ্রমহিলা যেন কৃতজ্ঞ আজও। ওঃ, তখন যা দিন গেছে! ঘণ্টায় ঘণ্টায় সরকারি নির্দেশ পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। মাসের পর মাস চোদ্দ ঘণ্টা ষোল ঘণ্টা কাজ করতে হয়েছে। লাভ? কালাধন উধাও। রিজার্ভ ব্যাংকের বাজার চালু টাকার চেয়ে বেশি টাকা তার ভাঁড়ারে ফিরে এল কালো টাকা সাদা করার জন্যই কি নোটবন্দি? রাজনীতিকে বিশ্বাস করে না উদ্দালক।

     ভাবনাদের আসাযাওয়া লেগেই থাকে উদ্দালকের অলস মনে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে। ঠাকুরদার কথা ভেসে ওঠে—অলস মস্তিষ্ক শয়তানের বাসা না হোক, ওলো চিন্তার কারখানা তো বটেই!  টিং টিং হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ঢোকে আম্রপালির

     --এই, রিয়েল তুই না কেমন দেখতে ভুলে গেছি আমি!

     --ভার্চুয়াল জগতই ভালো। বেশ উত্তীয় ভাবজগত বলে মনে হয়, যেখানে মিথ্যাই একমাত্র সত্য।

     --এই যে উকিলের নাতি কোকিল! সওয়াল জবাব বন্ধ কর সত্যি বলছি, কতদিন দেখা হয়নি আমাদের!

     --জানিস, কিছুক্ষণ আগে এই কথাটাই ভাবছিলাম আমি। করোনা যে এমন ফাটাফাটি জটিলা-কুটিলার রোল প্লে করবে, কে জানত?

     --দাঁড়া, দাঁড়া।  পাঁজি খুলে দেখি সূর্যটা আজ কোনদিকে উঠেছে তুই আমার কথা ভাবছিলিস!

     --যাক গে, বাদ দে। পরশু আমাদের ব্যাঙ্ক ধর্মঘট। সেদিন দেখা করবো। পরে কথা হবে।

     একটা চুমুর ইমোজি দিয়ে উবে যায় আম্রপালি। কিন্তু যাবেটা কোথায় তারা? আবার সে পুরনো প্রশ্নে এসে থমকায় উদ্দালক। করোনার যা চোখ রাঙানি! কিন্তু আশ্চর্য কেন্দ্রের সরকার এবারে নিজেরা লকডাউন না করে রাজ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। গত বছর পরিযায়ী শ্রমিকদের লংমার্চ-মৃত্যু তার বিশ্বগরিমায় কালি লেপে দিয়েছে বলে? নাকি ভোট, ক্ষমতা? জানে না উদ্দালক। দেশের সব রাজ্যেই লকডাউন—শুধু পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, তামিলনাডু, অসম ছাড়া। যেহেতু এ রাজ্যগুলোতে ভোট। মহান গণতান্ত্রিক উত্সব! মানুষের প্রাণ যায় যাক, গদি আগে। 


ক্রমশ...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন